নীল পাখি থেকে 'এক্স' : টুইটার হাতবদলের সাতকাহন

Twitter, Elon Musk: তার পর কোত্থেকে কি হইয়া গেল! হাত বদলে টুইটার এল ইলন মাস্কের হাতে। বদলে গেল খোলনলচে। এমনকী ঘুচে গেল সাধের নাম এবং লোগোও।

আজ যে রাম, কাল সে শ্যাম। আজ যে অসীম, কাল সে সনাতন। এমন তো আখছার ঘটছে। এই ছিল ইলাহাবাদ, হয়ে গেল প্রয়াগরাজ। এই ছিল মোঘলসরাই, হয়ে গেল দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর। এই ছিল টুইটার, হয়ে গেল এক্স। ঠিক যেন এই ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল।

গত কয়েক বছর ধরে চর্চার কেন্দ্রে টুইটার, থুড়ি এক্স। কখন সিইও বদলে যায়, কখন অফিস উঠে যায় আর কখন যে নাম পাল্টে যায়, তা ঠাওর করে বলা 'গেছো দাদা'-র অবস্থান জানার চেয়েও কঠিন। ২০০৬ সালে তৈরি এই সোশ্যাল মিডিয়ায় গত কয়েক বছরে ব্যাপক বদল ঘটেছে। বদলেছে পলিসি, নিয়মকানুন। কর্মী ছাঁটাই থেকে অফিসের টেবিল চেয়ার বিক্রি, দফতরে তালা, কী দেখেননি টুইটার কর্মীরা। প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে হাজির হয়েছেন টুইটারের মালিক ইলন মাস্ক।

আরও পড়ুন: নীল পাখি উড়ে গিয়ে চলে এল কুকুর! কেন রাতারাতি টুইটারের লোগো বদল ইলন মাস্কের?

খুব বেশিদিন আগে নয়। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে টুইটারের অধিগ্রহণ করেন স্পেসএক্স ও টেসলার সিইও ইলন মাস্ক। প্রতিদ্বন্দ্বী অবশ্য কম ছিল না তাঁর। অ্যালফাবেট ইনক থেকে শুরু করে মাইক্রোসফট, ওয়াল্ট ডিজনি- কে ছিল না সেই দৌড়ে। কিন্তু তাদের সকলকে পিছনে ফেলে স্বত্ত্ব যায় ব্রিটিশ এই ধনকুবেরের হাতেই। তবে সেই অধিগ্রহণ নিয়েও কম নাটক হয়নি। বছরখানেকের টালবাহানার পর শেষমেশ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিময় হাতবদল হয় টুইটার। আর এসেই টুইটারের প্রাক্তন সিইও পরাগ আগওয়ালকে টুইটারচ্যুত করেন ইলন। তার সঙ্গে ছাঁটাই করা হয় বহু শীর্ষস্থানীয় কর্মীকেই।

২০০৬ সালে জ্যাক ডরসি, নোয়াহ গ্লাস, বিজ স্টোন এবং ইভান উইলিয়ামস মিলে বানিয়ে ফেলেছিলেন একটা দুর্দান্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। যা কার্যত সে সময় ছিল বৈপ্লবিক। তখন সবে সবে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে সোশ্যাল মিডিয়ার ধারণা। ফলে টুইটারের জনপ্রিয় হতে দেরি হয়নি। নেতামন্ত্রী থেকে অভিনেতা, গায়ক, খেলোয়াড়- সকলেরই প্রায় পয়লা নম্বর পছন্দ এই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি। তার পর কোত্থেকে কি হইয়া গেল! হাত বদলে টুইটার এল ইলন মাস্কের হাতে। বদলে গেল খোলনলচে। এমনকী গেল সাধের নাম এবং লোগোও।

এবার থেকে আর টুইটার নয়। জনপ্রিয় এই সোশ্যাল মিডিয়াকে ডাকা হবে 'এক্স' নামে। ছোট্ট নীল পাখির যে লোগোটি এতদিন ধরে মানুষের চোখে বসে গিয়েছে, সরানোর পালা সেটিকেও। নীল-সাদা থিমের বদলে টুইটারের নয়া থিম এখন কালো। লোগো বদলে সাদায়-কালোয় বসেছে ইংরেজি বর্ণমালার 'এক্স' বর্ণটি। নয়া ইউআরএলও ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন টুইটার কর্তা ইলন মাস্ক। এতদিন twitter.com-এ ক্লিক করেই টুইটারে পৌঁছে যাওয়া যেত, এবার তার পাশাপাশি X.com-এও ক্লিক করেও পৌঁছে যাওয়া যাবে ওই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে।

না, এই প্রথম নয়। মাঝখানে নিজের পোষ্য সারমেয় অর্থাৎ শিবা ইনু ব্রিডের একটি কুকুরের ছবি টুইটারের লোগো হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব এনেছিলেন ইলন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল ব্যাপারটি নিয়ে। শেষপর্যন্ত অবশ্য সেই ভাবনা থেকে 'এক্স'-এ গিয়ে থেমেছেন টুইটার কর্তা। 

এর পূর্বপ্রস্তুতি কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। মাস কয়েক আগের কথা। হঠাৎ করেই সানফ্রান্সিসকোয় টুইটারের সদর দফতরের নানা জিনিসপত্র নিলামে তোলা শুরু করে টুইটার কর্তৃপক্ষ। চেয়ার টেবিল, কফি মেশিনের পাশাপাশি নিলামে ওঠে টুইটারের লোগো স্থাপত্যটিও। নীল পাখির মূর্তিটি অফিস থেকে বিদায় নেয় অচিরেই। মাঝখানে নিজের পোষা সারমেয়টির ছবি দিয়ে টুইটারেই একটি পোস্ট দিয়েছিলেন ইলন। সেখানে লিখেছিলেন, 'টুইটারের নয়া সিইও'। স্বাভাবিক ভাবেই হইচই পড়ে গিয়েছিল পোস্টটিকে ঘিরে। নিন্দুকরা বলে বসেন, আদতে টুইটারের প্রাক্তন সিইও পরাগ আগরওয়ালকে ঠুকেই ওই পোস্টখানি করেছিলেন ইলন। তখন থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটির খোলনলচে বদলে ফেলার মনস্থির করেছেন বোধহয় টেসলাকর্তা।

আঁচ করা কঠিন নয়, নিজের এরোস্পেস সংস্থা 'স্পেসএক্স' নামের অনুপ্রেরণাতেই টুইটারের নাম 'এক্স' রেখেছেন ইলন। সম্ভবত সেটাকেই ব্র্যান্ড হিসেবে তুলে ধরতে উঠেপড়ে লেগেছেন তিনি। লোগো বদলের পরেই তাঁর ঘোষণা, খুব শিগগিরই টুইটার ব্র্যান্ডটিকেই বিদায় জানাবেন তাঁরা। আসলে গোড়া থেকেই টুইটার বা মাইক্রোব্লগিং সাইটে নিজের অস্তিত্ব সব দিক থেকেই জানান দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন ইলন। তা বেলাগাম কর্মীছাঁটাই করে হোক বা অফিসে তালা ঝুলিয়ে। টুইটারের মাথা থেকে বিশ্বস্ত কর্মীদের ছেঁটে ফেলা থেকে শুরু করে সংস্থার এতদিনকার সব জিনিসপত্র নিলামে তোলা, সব কিছুতেই প্রকাশ পেয়েছে সেই আগ্রাসন। কিছুদিন আগেই ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট অর্থাৎ ব্লু টিকের জন্য টাকা নেওয়ার কথা ঘোষণা করে দেন টুইটারকর্তা। স্বাভাবিক ভাবেই ইলনের একের পর এক তুঘলকি সিদ্ধান্তকে ভালো ভাবে নেননি টুইটারকর্মীরা। কিন্তু ছাঁটাইয়ের ভয়ে তা মাথা পেতে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ ছেড়েও গিয়েছেন সংস্থা। কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি হননি ইলন। এমনকী বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গেও বিবাদে জড়িয়েছেন টেসলাকর্তা। যার জেরে হাক ফস্কেছে বহু বিজ্ঞাপন। ক্রমশ ফাঁকা হয়েছে সংস্থার কোষাগার। অফিসে তালা ঝুলিয়ে, অফিসের টেবিল-চেয়ার বেঞ্চ বেচে খরচ সামলেছেন। এমনকী ব্যবহারকারীদের ইউজার নেম পর্যন্ত নিলামে তুলেছেন ইলন সংস্থার আয় বাড়াতে।

সব মিলিয়ে টুইটার অধিগ্রহণ করে থেকে কার্যত নাকানিচোবানি খেয়েছেন ইলন মাস্ক। একের পর এক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা কার্যত সংস্থা এবং সংস্থার কর্মীদের হিতের বিপরীতে গিয়েছে। এর পরে বদলালো টুইটারের নাম। বহুদিন ধরেই নানা বৈপ্লবিক পরিকল্পনার কথা জানিয়ে এসেছেন ইলন। 'অলরাউন্ডার' অ্যাপ বানানোর কথা এর আগেও একাধিকবার জানিয়েছিলেন টেসলা প্রধান, যেখানে টাকার লেনদেন থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার, ম্যাপ দেখা, মেসেজ এমনকী অনলাইন শপিং পর্যন্ত সম্ভব হবে। ইলনই প্রথম নয়, 'অলরাউন্ডার' অ্যাপ পরিকল্পনার দিকে এগিয়েছে মেটা, আমাজনের মতো বহু সংস্থাই। ওটিটি থেকে পেমেন্ট, শপিং থেকে মিউজিক, সমস্ত সুবিধাই দিচ্ছে আমাজন। একই সুবিধা এনে ফেলেছে মার্ক জুকেরবার্গের সংস্থা মেটাও। শপিং থেকে পেমেন্ট সব কিছুই এখন হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের মাধ্যমে। তেমনভাবেই টুইটারকেও 'অলরাউন্ডার অ্যাপ' বানাতে উঠেপড়ে লেগেছেন ইলন।

আর এই 'এক্স' নামের মধ্যে নানা মুনি খুঁজে পেয়েছেন নানা মত। বীজগণিতে 'এক্স' ধরে অঙ্ক কষার কথা তো সকলেই জানেন। অনেকে বলছেন, এমন অলরাউন্ডার অ্যাপের জন্য এর থেকে ভালো অ্যাপ আর কী-ই বা হতে পারে। কেউ আবার পর্ন ওয়েবসাইটের সঙ্গেও মিল খুঁজে পেয়েছেন X.com ইউআরএলে। কেউ কেউ মনে করছেন, ওয়েবসাইটের ট্র্যাফিক বাড়ানোর জন্যই এমন পরিকল্পনা এঁটেছেন ইলন। ইতিমধ্যেই এ সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়াও সব সারা হয়ে গিয়েছে। ফলে এখন আর টুইটারকে 'এক্স' বলতে আইনি স্তরে কোনও বাধা নেই।

আরও পড়ুন: টুইটারের সাজানো বাগান কীভাবে তছনছ করলেন এলন মাস্ক

শেকসপিয়র বলেছেন 'নামে কী-ই বা আসে যায়'! এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সম্পূর্ণ একটি অন্য ঘটনার কথা। দক্ষিণ কলকাতার রুবি হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তাটি দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত রুবির মোড় হিসেবে। বছর খানেক আগে অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতাল জানপ্রাণ লড়িয়ে চেষ্টা করেছিল তাঁদের হাসপাতালের নামে রাস্তাটিকে চেনানোর। বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গিয়েছিল চারধার। তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি। সম্প্রতি সেখানে বড় বড় করে আলোজ্বলা সাইনবোর্ড বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই এলাকাটির নয়া নাম নাকি 'রবিঠাকুরের মোড়'। কিন্তু অটোয় উঠুন বা বাস, ওই এলাকার পরিচিতি এক নামেই। রুবির মোড় নামেই মগজে সেঁটে গিয়েছে জায়গাটির অস্তিত্ব। যাকে হঠানো সহজ ব্যপার নয় মোটেই। ঠিক যেমন ভাবে ইলাহাবাদ আছে ইলাহাবাদেই, মোঘলসরাই রয়ে গিয়েছে মোঘলসরাইয়ে। টুইটারও ঠিক তেমন ভাবেই থেকে যাবে না তো টুইটারেই!

More Articles