টুইটারের সাজানো বাগান কীভাবে তছনছ করলেন এলন মাস্ক

Elon Musk: এলন মাস্কের খামখেয়ালিপনা কোথায় নিয়ে চলেছে টুইটারকে?

ঘটনাটা ২৮ অক্টোবরের। ঠিক আগের রাতে এলন মাস্ক টুইটার কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করে নিলেন। ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওই চুক্তির মাধ্যমে টুইটারের সমস্ত মালিকানা চলে এল মাস্কের হাতে। এটি কয়েক ঘণ্টা পর সান ফ্রান্সিসকো শহরে টুইটারের প্রধান কার্যালয় প্রতিষ্ঠানটির মানব সম্পদ বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করলেন এলন মাস্ক। সেখানে ব্যাপক পরিসরে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রস্তুতি নিতে বললেন এলন। জানিয়ে দিলেন, অবিলম্বে টুইটারের কর্মীসংখ্যা কমাতে হবে। আর যারা ছাঁটাই হবেন, তাদের ১ নভেম্বরের যে বোনাস দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হবে না।

মানব সম্পদ বিভাগের নির্বাহীরা টুইটারের নতুন মালিককে সরাসরি সতর্ক করে দিলেন, তাঁর এই পরিকল্পনা শ্রম আইনের লঙ্ঘন এবং কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করতে পারে। ছাটাই হওয়া কর্মীরা মামলা পর্যন্ত করতে পারেন। তখন এলন মাস্কের উপদেষ্টারা জানালেন, মাস্কের আদালতে যাওয়ার এবং জরিমানা দেওয়ার অভ্যাস রয়েছে, তাই এটা নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না তাঁর। সেই মতো টুইটারের মানবসম্পদ এবং আইন বিভাগ মাস্কের নির্দেশনা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বিষয়টি সম্পর্কে অবগত তিন জন ব্যক্তি জানিয়েছেন, ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা যদি মামলা করেন তাহলে তার পরিচালনা এবং জরিমানা-বাবদ কত খরচ হতে পারে, সেই বিষয়ে দুই দিন পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে জেনে নেন এলন মাস্ক। কোন কর্মীকে ছাঁটাই করা হবে, তা নিয়ে ব্যবস্থাপকদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় এই প্রক্রিয়া শুরু করতে দেরি হলেও, টুইটার কেনার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই মাস্কের টুইটারে শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা। বোঝা যায়, তাঁর অবিলম্বে কর্মী ছাঁটাইয়ের নির্দেশ, এবং কর্মীদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত একেবারেই ভালো প্রভাব ফেলেনি। টুইটার কীভাবে চলা উচিত, তা নিয়ে ৫১ বছর বয়সি এলন মাস্কের মাথায় অনেক ধরনের চিন্তাভাবনা ছিল, তবে এসব চিন্তা-ভাবনা কীভাবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়িত করা যায়, সে ব্যাপারে কোনও ধারণা ছিল না। ফলে মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত টুইটার নিয়ে নানারকম ব্যবসায়িক এবং আইনি জটিলতায় পড়ে যান মাস্ক।

আরও পড়ুন: টুইটারের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? খামখেয়ালি এলন মাস্ক যে প্রশ্ন তুলে দিলেন

তবে, টুইটার কিন্তু শুরু করা হয়েছিল একটা অন্য লক্ষ্য নিয়ে। ২০০৪ সাল থেকেই এই টুইটারের ধারণার সূত্রপাত। চলুন জেনে নেওয়া যাক, কখন কীভাবে কেন এই মাইক্রো ব্লগিং সার্ভিস শুরু হয়েছিল?

টুইটারের ইতিহাস
২০০৪ সালে Odeo নামের একটি পডকাস্ট সার্ভিস কোম্পানি আত্মপ্রকাশ করে যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইভান উইলিয়াম। ইভান ছিলেন গুগলের একজন প্রাক্তন কর্মী এবং Blogger ও Medium-এর মতো কিছু ব্লগিং ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সঙ্গে এই ব্রডকাস্ট সার্ভিস কোম্পানিতে যোগ দেন তাঁর এক সহকর্মী বিজ স্টোন এবং আমেরিকান উদ্যোগপতি নোয়া গ্লাস। তবে, ২০০৫ সালে অ্যাপেল তাদের আইটিউন প্লাটফর্মে ব্রডকাস্ট শুরু করার ঘোষণা করার পরেই Odeo-র প্রতিষ্ঠাতা চিন্তায় পড়ে যান, কারণ তাঁরা জানতেন, অ্যাপেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।

তাই তাঁরা শুরু করেন একটি সাইড প্রোজেক্ট, যেখানে, তাঁরা তাঁদের কর্মচারীদের নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করেন। তখন সেই কোম্পানির কর্মচারী তথা ইঞ্জিনিয়ার জ্যাক ডরসি একটি শর্ট মেসেজিং সার্ভিস চালু করার প্রস্তাব দেন। নোয়া এই সার্ভিসের নাম প্রস্তাব করেন Twittr। ২০০৬ সালের জুন মাসে জ্যাক ডরসি প্রথম টুইট করেন, "Just Setting up my Twittr"। ওই বছরই জুলাই মাসে এই সার্ভিসের পূর্ণ ভার্সন চালু হয়। কিন্তু Odeo-র বিনিয়োগকারীরা এই সাইড প্রোজেক্টটিকে খুব একটা ভালো চোখে গ্রহণ করেননি। তাই ইভান উইলিয়াম Odeo কোম্পানির সমস্ত শেয়ার কিনে নেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে নোয়া-কে ফায়ার করেন।

টুইটার লঞ্চ হওয়ার ছয় মাসের পরে এর নামের সঙ্গে একটি E যুক্ত হয়ে নামকরণ হয় Twitter। ২০০৭ সালে সাউথ বাই সাউথ ওয়েস্ট ইনটারক্টিভ কনফারেন্স চলাকালীন এই টুইটার প্ল‍্যাটফর্মটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতে শুরু করে। সেই সময় প্রতিদিন ৬০০০০টি করে টুইট করা হতো সেই প্ল‍্যাটফর্মের মাধ্যমে। সেখান থেকেই ত্বরান্বিত হয় টুইটার প্ল‍্যাটফর্মের যাত্রা। ওই বছরই প্রথম ডরসি কোম্পানির প্রথম চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন।

টুইটার মূলত চালু হয়েছিল মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য। এর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ব্রেকিং নিউজ সকলের মাঝখানে ছড়িয়ে দেওয়া যেত এই টুইটার প্ল‍্যাটফর্মের মাধ্যমে। মূলত টুইটারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছিল বিভিন্ন ব্রেকিং নিউজ প্রচারের কারণেই। আর তা প্রচার করেছিলেন সাধারণ মানুষই। টুইটার একটি সংক্ষিপ্ত টেক্সটভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম হওয়ার কারণে এখানে যাঁরা ঢুকে থাকেন, তাঁদের শুধুমাত্র খবরের হেডলাইন পড়ার ইচ্ছে থাকে। সেই কারণে টুইটার প্ল‍্যাটফর্মটির ব্যবহার শুরু হয় ব্যাপকভাবে। ২০০৯ সালে আমেরিকার হাডসন নদীতে প্লেন ক্র্যাশের নিউজটি একজন ফেরি প্যাসেঞ্জার ছবি তুলে টুইটারে শেয়ার করেছিলেন, যা মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে উঠেছিল ভাইরাল। ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বারাক ওবামা টুইটার প্লাটফর্মের ব্যবহার করে এই প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিলেন। এখনও পর্যন্ত বারাক ওবামার কাছে টুইটারের ফলোয়ারের সংখ্যা প্রচুর। বিভিন্ন ইভেন্টেও টুইটার একাই বাজিমাত করে চলেছিল ধারাবাহিকভাবে।

তবে এত কিছু করার পরেও ২০০৯ সাল পর্যন্ত টুইটারের আয় ছিল শূন্য। তাই ২০০৯ সালেই কোনও না কোনও একটা ব্যবস্থা নিতেই হতো। সেই বছরই বিং এবং গুগলের সঙ্গে ১০ এবং ১৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে টুইটার। তাদের সার্চ ইঞ্জিনে টুইট যোগ করা হয়। অর্থাৎ, এখন সার্চ করলে টুইটার এবং টুইট রেজাল্টে আসবে। ২০১৫ সালের ডেস্কটপে চলে আসে এই ফিচার। ২০১০ সালে তারা প্রোমোটেড টুইট নামের আরেকটি সার্ভিস চালু করেন, যেখানে টাকা দিয়ে কোনও কোম্পানির বা ব্যক্তির টুইট ছড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়।

কিছুটা ফেসবুক বিজ্ঞাপনের মতো এই বিষয়টি কাজ করলেও ২০১৫ সালে এই সার্ভিস দিয়ে তারা ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে। এইটা ছিল টুইটারের প্রথম এত বড় মানের আয়। আর ২০২২ সালে এই আয় গিয়ে পৌছায় ১.১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। শেয়ার মার্কেটেও টুইটার দারুণ ব্যবসা করে। ২০১৩ সালে শেয়ার মার্কেটে আইপিও লঞ্চ করে পাবলিক কোম্পানিতে পরিণত হয়েছিল টুইটার এবং তহবিল তৈরি হয়েছিল ১.৮ বিলিয়ন ডলারের। এর মার্কেট ভ্যালু দাঁড়িয়ে ছিল ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে টুইটারে অনেকগুলো ফিচার যুক্ত হয় যার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ছিল টুইট এক্সপ্লোর।

টুইটারের বর্তমান অবস্থা
টুইটারের এইভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পরেও কীভাবে এই প্ল‍্যাটফর্মের সঙ্গে এলন মাস্ক ঢুকে পড়লেন, তা জানতে হলে আমাদের টুইটারের চিফ একজিকিউটিভ অফিসারদের সমস্যা নিয়ে জানতে হবে। টুইটারে প্রথম চিফ একজিকিউটিভ অফিসার ডরসি-কে প্রায় কোম্পানি থেকে বের করে দিয়ে আবার এই কোম্পানির মাথায় এসে বসেছিলেন ইভান উইলিয়াম। কিন্তু, ডরসি কখনওই বসে থাকার মানুষ ছিলেন না। ২০১০ সালে টুইটার থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ভেতরে ভেতরে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে গোপন মিটিং করে সেই বছরই আবারও সিইও পরিবর্তন করান তিনি।

টুইটারে নতুন সিইও হিসেবে নিযুক্ত হন ডিক কস্টেলো। এর আগে তিনি ছিলেন COO পদে। ২০১৫ সালে আবারও ডরসি তাঁকে সরিয়ে দিয়ে হয়ে যান CEO। তবে ২০২১ সালে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। টানা ছয় বছর সিইও থাকার পরে বিনিয়োগকারীদের চাপে সরে যেতে হয় ডরসি-কে। নতুন চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার নিযুক্ত হন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইঞ্জিনিয়ার পরাগ আগরওয়াল। তবে পরাগের কার্যকাল খুব একটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ওয়ার্ল্ড স্ট্রেট নিউজের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ডরসি নাকি এলন মাস্ককে উৎসাহিত করেছিলেন, যাতে তিনি টুইটার কেনেন। আর তিনি টুইটার কেনার পর, তাঁকে সমর্থন করে একটি টুইট করেছিলেন ডরসি। কিন্তু এলন মাস্ক টুইটারের মাথায় বসার পরই শুরু হয় সমস্যা।

টুইটারের বর্তমান এবং প্রাক্তন কর্মী মিলিয়ে ৩৬ জন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তি এবং সংস্থাটির অভ্যন্তরের নথিপত্র ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে হওয়া আলাপচারিতা থেকে বোঝা যায়, মাস্ক টুইটার কিনে নেওয়ার কারণেই অনেকে ছিলেন ক্ষুব্ধ। টুইটারের মাথায় বসার পরেই শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নির্বাহী কর্মকর্তাকে ইমেলের মাধ্যমে চাকরিচ্যুতির কথা জানিয়ে দেন মাস্ক। কয়েকশো কর্মীকে ছাঁটাই করতে বলার পর প্রকৌশল বিভাগের একজন ব্যবস্থাপক বমি পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এছাড়াও মাস্কের নির্দেশনা পূরণের লক্ষ্যে কঠোর সময়সূচি মেনে কাজ করতে গিয়ে কর্মীদের কেউ কেউ টুইটার কার্যালয়ে ঘুমিয়েও রাত পার করছেন। ফলে কর্মীদের মধ্যে বাড়তে থাকে অসন্তোষ।

পরিবর্তনের টুইটার
টুইটার এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে আর্থিক চাপের মুখে পড়েছিল। তার মধ্যে আবার বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ। তবে এরপরও একমাস আগে টুইটার যেরকম ছিল এখনকার টুইটারের সঙ্গে সেই টুইটারের কোন মিল পাওয়া যায় না। গত সপ্তাহে এলন মাস্ক টুইটারের ৭,৫০০ জন কর্মীর মধ্যে অর্ধেককে ছাঁটাই করেছেন। নির্বাহী কর্মকর্তাদের পদত্যাগ চলছে অবিরত। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচন ঘিরে টুইটারে গুজব ছড়িয়েছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এলন মাস্ক যেখানে টুইটারের স্বচ্ছতা নিয়ে সামনে এসেছিলেন, সেই বিষয়টি নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার মাধ্যমে আয় করার যে পরিকল্পনা মাস্ক গ্রহণ করেছেন সেটাও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কিছু বিজ্ঞাপনদাতা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন এই পরিস্থিতিতে। এলন মাস্ক সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, "যারা কঠোর পরিশ্রম করতে পারেন তাদের জন্য টুইটার একটি ভালো জায়গা। আর যারা এটা করতে পারেন না তারা জেনে রাখুন, টুইটার আপনাদের জন্য নয়।"

এলন মাস্ক সাম্প্রতিক একটি বৈঠকে টুইটারের কর্মীদের বলেছিলেন, টুইটারের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তবে এর পরে অবশ্য তাঁর মন্তব্য চেয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল কিন্তু তাতে কোনওরকম সাড়া তিনি দেননি। নিউ ইয়র্ক টাইমস এর হাতে আসা ওই বৈঠকের একটি রেকর্ডে এলন মাস্ক-কে বলতে শোনা যায়, "নগদ আয় ব্যাপকভাবে কমেছে এবং টুইটারের দেউলিয়া হওয়ার বিষয়টিও কিন্তু খারিজ করে দেওয়া যায় না।" তাই টুইটারের ভবিষ্যৎ কী হবে সেই নিয়ে দ্বন্দ্বে রয়েছেন সকলেই।

দ্রুত বদলেছে চিত্র
গত ২৬ অক্টোবর টুইটারের সান ফ্রান্সিসকো কার্যালয়ে গিয়েছিলেন এলন মাস্ক। তিনি একটি সাধারণ সিঙ্ক হাতে কাচের দরজা ঠেলে ভবনে ঢুকেছিলেন এবং সেই সময় তিনি টুইট করেছিলেন, "লেট দ্যাট সিঙ্ক ইন"। টুইটারের প্রধান বিপরণ কর্মকর্তা লেসলি বারলান্ড এই সময় এলন মাস্ককে স্বাগত জানাতে কর্মীদের উৎসাহ দেন এবং তিনি তাঁকে সঙ্গে করে টুইটারের কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেই সময় প্রতিষ্ঠানের কফি বারে কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এলন মাস্ক।

এরপর চিত্রটি অত্যন্ত দ্রুত বদলে যায়। এই ঘটনা সম্পর্কে অবগত দুই ব্যক্তি জানিয়েছিলেন, পরদিন টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তথা সিইও পরাগ আগারওয়াল এবং প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা সিএফও নেড সেগাল অফিসে ছিলেন। বিকেলে তাঁরা যখন জানতে পারেন টুইটারের মালিক হতে চলেছেন এলন মাস্ক, তখনই তাঁরা অফিস থেকে বেরিয়ে যান। নতুন মালিক কী করবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল তাঁদের মধ্যে। এর কিছুক্ষণ পর এই দু'জনেই ইমেল পান, যাতে বলা হয় তাঁদের বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে টুইটারের আইন এবং নীতি-বিষয়ক প্রধান নির্বাহী বিজয়া গাড্ডে এবং টুইটারের জেনারেল কাউন্সিল শন এডগেটকে চাকরি থেকে বিতাড়িত করা হয়।

২৮ অক্টোবর টুইটারে মানব সম্পদ বিভাগের নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক করেন এলন মাস্ক। তিনি সরাসরি জানিয়ে দেন অবিলম্বে তিনি টুইটারের কর্মী ছাঁটাই করতে চান, আর সেটা করতে চান ১ নভেম্বরের আগে। কারণ ওই দিন টুইটারের কর্মীদের বিশেষ একটি বোনাস দেওয়ার কথা ছিল। এরপর টুইটারের একটি দল কাজ শুরু করে কর্মী ছাঁটাইবাবদ কত খরচ হবে, সেই নিয়ে। আরেকটি দলের দায়িত্ব পড়ে কর্মী ছাঁটাই করা হলে মাস্ককে কোন আইনি প্রক্রিয়ায় কী পরিমাণ ফি এবং জরিমানা গুনতে হবে, তা বের করার। এরপর গত ৩০ অক্টোবর মাস্ককে জানানো হয়, তিনি যদি এভাবে হুটহাট কর্মী ছাঁটাই করেন তাহলে তাঁকে কয়েক বিলিয়ন ডলার গুনতে হতে পারে, যে অঙ্ক নির্ধারিত বোনাস-সহ কর্মীদের ছাঁটাই করলে যে খরচ হবে, তার থেকে অনেক বেশি। এই শুনে কর্মী ছাঁটাই পিছিয়ে দেন এলন মাস্ক।

কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর একটা শর্ত ছিল। বোনাস দেওয়ার আগে মাস্ক এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলেন। টুইটারের কর্মীরা সত্যিকারের মানুষ কি না, সেটা যাচাই করে দেখতে বলেন তিনি। মাস্ক বলেন, ভুতুড়ে কর্মীদের অর্থ দেওয়া উচিত হবে না। তাই ব্যবস্থাপকদের যাচাই করতে বলা হয়, টুইটারের যে সমস্ত কর্মীকে তাঁরা চেনেন তাদেরকেই চিহ্নিত করা হবে ব্যক্তি হিসেবে।

বিজ্ঞাপনদাতাদের আস্থার সংকট
টুইটারে ব্যবস্থাপকরা যখন কর্মীদের মধ্যে কাদের ছাটাই করা হবে সেই তালিকা গুছিয়ে আনেন, সেই সময় বিজ্ঞাপন দাতাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলেন এলন মাস্ক। কারণ একদিক থেকে দেখতে গেলে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে এই টুইটারের আয়ের একটা বড় অংশ আসে। বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করার পর মাস্ক এমন কয়েকটি প্রস্তাব দেন যেখানে টুইটার ব্যবহারকারীরা বিশেষ একটি ব্যবস্থায় তাদের সামনে যে সমস্ত কনটেন্ট আসবে সেগুলো পছন্দ করতে পারবেন। এতে করে বিভিন্ন ব্র্যান্ড নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীর কাছে নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন দিতে পারবে বলে জানিয়ে দেন মাস্ক। এর মাধ্যমে টুইটার ব্যবহারকারী এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের আরো বেশি সুনির্দিষ্ট সেবা দেওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করেন এলন মাস্ক।

কিন্তু নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক টুইটারের দুই নির্বাহী কর্মকর্তা বারল্যান্ড এবং জেপি মাহেউ টুইটার ছেড়ে চলে যাওয়ায় মাস্কের এই প্রস্তাব বিশ বাঁও জলে চলে যায়। এই দুজনই ছিলেন বিজ্ঞাপন দাতাদের মহলে অত্যন্ত সুপরিচিত।

বিজ্ঞাপন বিভাগে দীর্ঘদিন নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করা লু পাস্কালিশ বলেন, "টুইটারের এই দুই নির্বাহের সঙ্গে ফরচুন ৫০০ তালিকায় ফরচুন ম্যাগাজিনের শীর্ষ কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠানগুলির বেশ ভালো যোগাযোগ ছিল। তারা দুজনে খুবই স্বচ্ছ এবং সবাইকে নিয়ে কাজটা করতে চাইতেন। তাই এরা দুজন টুইটার থেকে সরে যাওয়ার কারণে এখন বিজ্ঞাপন দাতাদের কাছে টুইটার খুব একটা ভালো প্লাটফর্ম নয়। সেই কারণে টুইটারের বিজ্ঞাপনের বিষয়টি নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।"

ভক্সওয়াগন, জেনারেল মটরস এবং ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স এর মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, আপাতত টুইটারে বিজ্ঞাপন দেওয়া তারা বন্ধ রাখবে। মাস্কের মালিকানায় টুইটার কেমন হবে, তা পর্যালোচনা করার পরই তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত বদল করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। এলন মাস্ক টুইটারের কিছু ব্যবস্থাপককে বড় দায়িত্বে নিয়ে এসেছেন। এস্থার ক্রফোল্ডকে টুইটারে নতুন চালু করা টুইটার ব্লু নামের সাবস্ক্রিপশন সেবা পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। টুইটারের এই সেবা নতুন আঙ্গিকে নিয়ে আসতে চাইছেন মাস্ক। যাতে মাসে ৮ ডলারের বিনিময়ে গ্রাহকরা বিশেষ ফিচার এবং নীল টিক পেয়ে যান। এতদিন বিশেষ পরিচিতি আছে এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ব্লু টিক দেওয়া হতো। কিন্তু এখন অনেকেই এই ব্লু টিক পেতে পারবেন।

তবে ব্লু টিক নিয়ে মাস্কের এই সিদ্ধান্ত কতটা ভালো সেই নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। অনেকে মনে করছেন ব্লু টিক নিয়ে এই সিদ্ধান্তের কারণে অনেকেই টুইটারের কাছ থেকে ব্লু টিক ক্রয় করবেন। কিন্তু, এই ব্লু টিক যেহেতু সকলেই পেতে পারেন তাই টুইটারের এই টিকের গ্রহণযোগ্যতা এবং মান্যতা অনেকটাই হ্রাস পাবে। তাই হয়তো টুইটার কিছুটা ভ্যালু পেলেও, টুইটারের ব্লু টিক আদতে আর কোনও ভ্যালু পাবে না।

কর্মী ছাঁটাই
এলন মাস্ক টুইটারের মাথায় বসার পরই টুইটারের কর্মী ছাটাই ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। টুইটারের ব্যবস্থাপকদের প্রাথমিকভাবে ২৫ শতাংশ কর্মী ছাটাই করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু টেসলার যে সব প্রকৌশলী টুইটারের কোড পর্যালোচনা করেন, তারা প্রকৌশলী দল থেকে আরও বেশি কর্মী ছাটাই এর নিদান দিয়েছিলেন। টুইটারের অন্য বিষয়গুলো যে সমস্ত নির্বাহীরা দেখতেন তাদের ছাটাই এর তালিকা আরো বড় করতে বলা হয়। এছাড়াও টুইটারের নির্বাহ ঈদের সেই তালিকা এমন ভাবে পর্যালোচনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যাতে করে ভারসাম্যহীনভাবে শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণের কর্মীদের ছাঁটাই করে আইনি কোন ঝুঁকির মধ্যে না পড়তে হয়। কিন্তু এলন মাস্কের হয়ে যারা এই কাজ করছিলেন তারা এই পরামর্শ একেবারেই পাত্তা দেননি।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, টুইটারে ৩৭৩৮ জন কর্মী অর্থাৎ মোট কর্মীর অর্ধেককে ছাটাই করা হতে পারে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই। নিউইয়র্ক টাইমসে এই বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হবার সাথে সাথেই বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে বিজ্ঞাপন কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন মাস্ক। ওই বৈঠকে টুইটারের মানবসম্পদ বিভাগ এবং মাস্কের অন্য কোম্পানির কর্মীরা ছিলেন।

প্রকৌশল বিভাগের একজন ব্যবস্থাপক মাস্কের উপদেষ্টাদের মুখোমুখি হন। এ সময়ের তালিকায় কয়েকশো কর্মীর নাম দেখে কার্যত বমি করে দেন তিনি। পরদিন তিন নভেম্বর টুইটারের কর্মীরা একটি ইমেইল পান। স্বাক্ষরের জায়গায় টুইটার লেখা ওই ইমেইলে বলা হয়, "টুইটারকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য আমরা বিশ্বজুড়ে কর্মী কমানোর একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাব।"

এরপরই শুরু হয় বিপর্যয়। শুরু হয় বিশৃঙ্খল একটি পরিস্থিতি। যদিও এর আগেই মেইলে বলা হয়েছিল, চাকরি আছে কিনা এ সম্পর্কে কর্মীরা পরের দিন সকালে একটি নতুন মেইল পাবেন। কিন্তু অনেকেই দেখেন তাঁদের ইমেইল অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বার্তা আদানপ্রদানের গ্রুপে আর তাঁরা নেই। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় এই সমস্ত কর্মীদের চাকরি আর নেই। এদিকে যারা অভ্যন্তরীণ বার্তা আদান-প্রদান অ্যাপ স্ল্যাকে অবস্থান করতেন তাঁরা সবাই সহকর্মীদের বিদায় দিতে শুরু করেন। আর সেখানেই টুইটারের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। একসাথে প্রকৌশলী দলের ৮০ শতাংশ কর্মীকে ছাঁটাই করেন এলন মাস্ক। পরবর্তীতে অতিরিক্ত চাপ দিতে শুরু করেন বাকি কর্মীদের উপর। যার প্রভাব পড়ে টুইটারের সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনার ওপরে। ছাঁটাই না হলেও এলন মাস্কের এই নীতির চাপে পড়ে ইস্তফা দিতে শুরু করেন কর্মীরা। যার ফলে তালা পড়ে যায় টুইটারের কর্মক্ষেত্রে।

পরিণাম
টুইটারের এইভাবে কর্মী ছাঁটাই হওয়ার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর প্রযুক্তি খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলি এই সুযোগ কাজে লাগাতে শুরু করে। ফেসবুকের প্রধান কোম্পানি মেটা এবং গুগলের শীর্ষস্থানীয় ব্যবস্থাপকদের অনেকেই টুইটারে বেশ কয়েকজন কর্মীকে প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে আসতে বার্তা পাঠান। এই পুরো প্রক্রিয়াতে এলন মাস্কের অধস্থান কর্মীরা ছিলেন একেবারে নিশ্চুপ। কিন্তু ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট কালাকানিস টুইটারে ক্রমাগত নিজের উদ্বেগ জানিয়ে আসছিলেন।

এই ঘটনাটির ব্যাপারে জানেন এমন চারজন ব্যক্তি বলেন, মাস্কের উপদেষ্টারা খুবই দ্রুত বুঝতে পারেন, এই কর্মী ছাটাই এর প্রভাব হবে অনেক বেশি। এমন ভাবে কর্মী ছাটাই হতে থাকলে টুইটারের সমস্ত কাজকর্ম পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে আর কেউ টুইটার প্লাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে ভয় পাবেন। তাই যদি টুইটারের কাজ আবারও চালু করতে হয়, তবে, প্রকৌশলী, ডিজাইনার এবং প্রোডাক্ট ম্যানেজারদের আবার কাজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানাতে হবে মাস্ককে। টুইটারে রাজস্ব বিভাগের গোল্ডবার্ডে ছাটাই হয়েছেন এমন কর্মীদের আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ওই কর্মীরা প্রতিষ্ঠানের আয়ের জন্য প্রধান প্রধান যেসব পণ্য রয়েছে সেগুলো নিয়ে কাজ করতেন, এবং তাঁরা ছাড়া ওই কাজ আর কেউ করতে পারবেন না। আর যদি সেরকমটা না হয়, তবে টুইটারের পতন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

More Articles