হ্যারি পটারের গাড়ি দাপিয়ে বেড়ায় কলকাতায়!

কেমন লাগবে বলুন তো, যদি হঠাৎ সামনে দেখেন, হ্যারি পটারের নীল উড়ন্ত ফোর্ড এ্যাংলিয়া ১০৫ই ডিলাক্স গাড়িটি কলকাতাতে আপনার সামনে এসে হাজির হয়েছে? ভাবছেন, এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। আর এই কলকাতার রাস্তায় যদি একটু চোখ-কান খোলা রাখেন, দেখবেন, হ্যারি পটারের গাড়িটি আপনার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে, তবে তার রঙ নীল নয়, ছাদটা লাল আর দেহ সাদা। কলকাতাতে সবেধন নীলমণি একটি-ই এই গাড়ি আছে।

নীল ফোর্ড এ্যাংলিয়া গাড়ির দৃশ্যত আগমন 'হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অফ সিক্রেটস' ছায়াছবিতে, ২০০২ সালে। ওয়েসলি পরিবারের রন, ফ্রেড আর জর্জ উঠে-পড়ে লেগেছে তাদের ঘরবন্দি বন্ধু হ্যারিকে অভিশপ্ত বাড়িটি থেকে বের করে আনতে। নীল ফোর্ড অ্যাংলিয়া আকাশে উড়ে এল আর হ্যারিকে মুক্ত করল। ওয়েসলি গৃহস্বামী তার সাধের গাড়িটিকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে, যাতে আটজন যাত্রী অনায়াসে বসতে পারে। সঙ্গে থাকবে ছ'-টা ট্রাঙ্ক, দুটো প্যাঁচা, আর একটা ইঁদুর। মেঘের মধ্য দিয়ে রাতের বেলা ছুটে চলেছে ফোর্ড আর তার সঙ্গে ছোটদের মনও উড়ে যাচ্ছে দূর থেকে বহুদূরে।

কলকাতার রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে লাল-সাদা ফোর্ড অ্যাংলিয়া ১০৫ই ডিলাক্স। চালক অমৃতেন্দু রায় আর পাশে বসে ১২ বছরের পুত্র আরমান। আরমান গাড়িপাগল। এই গাড়িটিতে বসলেই ওর মন হ্যারির মতো উড়তে থাকে। ও স্বপ্ন দেখে, রাস্তা ছেড়ে গাড়ি কখন মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে; পার হচ্ছে মেঘের পাহাড়, মেঘের রাজপ্রাসাদ।

আরও পড়ুন: বুড়ো হাড়ে ভেলকি! ভিনটেজ ল্যান্ডরোভার পাড়ি জমাবে হিমালয়ে

ফোর্ড অ্যাংলিয়া ১০৫ই ডিলাক্সের জন্ম ইংল্যান্ডে। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৮- এই সময়ের মধ্যে ১,০০,০৪,৭৩৭টি গাড়ি বিক্রি হয়েছিল। এখনও ইংল্যান্ডে প্রতি বছর ফোর্ড অ্যাংলিয়া রেস হয়। নানা রঙের অ্যাংলিয়া দাপিয়ে বেড়ায় ইংল্যান্ডের রাস্তা। দু'-পাশে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান চালকদের। ফিরে যান ছয় দশক আগের ইংল্যান্ডে।


জে. কে. রাউলিংয়ের জন্ম ১৯৬৫ সালে। ছোটবেলাতে তিনি দেখতেন, তাঁর এক প্রতিবেশী ফোর্ড অ্যাংলিয়া চালিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। সারাজীবন সেই স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে, আর তাই লেখিকা রাউলিং তার গল্পে স্মৃতির সরণি বেয়ে ফোর্ড অ্যাংলিয়াকে নিয়ে এসেছেন।

সাধারণ মধ্যবিত্ত ইংরেজ পরিবারের সদস্য ছিল এই গাড়ি। খুব শক্তপোক্ত আর যে-কোনও রাস্তা দিয়ে অনায়াসে চলতে পারে।

ফুটবলার সুভাষ ভৌমিকের কথা কার না মনে আছে! সম্প্রতি লোকান্তরিত এই ফুটবলার কলকাতা ময়দান কাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন গত শতকের সাতের দশকে। সুভাষবাবুর গাড়ির শখ ছিল এবং কাস্টমস থেকে তিনি এই ফোর্ড অ্যাংলিয়া ১০৫ই ডিলাক্স গাড়িটি কেনেন। কলকাতা ময়দানের বহু খেলোয়াড় ফোর্ডে চড়েছেন।

সুভাষবাবু গাড়িটি বিক্রি করে দেন এবং কালের প্রভাবে অ্যাংলিয়া বসে যায়। বহুদিন তাকে আর দেখা যায়নি। কলকাতার গাড়িপ্রেমীরা ভাবতে শুরু করেন ১৯৬৪ সালে তৈরি অযান্ত্রিক হয়তো চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে।

হারিয়েই যেত, যদি শ্রীবর্ধন কানেরিয়ার হাত তাকে স্পর্শ না করত। শ্রীবর্ধন গাড়ির জগতের পি. সি. সরকার। ও জাদু জানে আর পুরনো গাড়িকে নতুন জীবনদানে ওর মুন্সিয়ানা সর্বজনজ্ঞাত।

শুরু হল ফোর্ড অ্যাংলিয়ার নতুন যাত্রা। ইঞ্জিনের কাজ থেকে ইলেকট্রিকাল ওয়ারিং, গিয়ার বক্স, কারাবোরেটার সারানো হল একটু একটু করে, এমনভাবে, যেন গাড়ির অরিজিনালিটি নষ্ট না হয়ে যায়। এবার তাকে রঙ দিয়ে সাজানোর পালা। সাদা বডির ওপর মানানসই লাল রঙের ছাদ। যখন উনি সেজেগুজে গ্যারেজ থেকে বেরোলেন, তখন তার সৌন্দর্য আর লাবণ্য তাক লাগিয়ে দিল সবাইকে।

“দ্যাখ দ্যাখ এটা হ্যারি পটারের ওই গাড়িটা না!”– রাস্তায় একটি সুবেশা তরুণী বলে উঠল। কী ভাগ্য! অ্যাংলিয়া ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে আর প্রাণভরে ছবি তুলছে কিছু তরুণ-তরুণী। এমনই স্মার্ট ফোর্ড অ্যাংলিয়ান ১০৫ই ডিলাক্স।

অমৃতেন্দুবাবুর ধ্যান-জ্ঞান সংগীত। সে ভারতীয় মার্গসংগীত হোক বা আধুনিক গান, লোকগান হোক বা বিথোভেন মোর্জাটের সিম্ফনি– গান তার রক্ত-মজ্জায়-হাড়ে। গাড়িটি তার ছেলে আরমান বা হ্যারি পটারের জন্য কেনা। ওকে আনন্দে রাখতেই নবজন্ম দান এই গাড়িটির। পিতা-পুত্র যুগলবন্দি দেখার মতো। বাবার হাতে স্টিয়ারিং আর অ্যাংলিয়া ছুটে চলেছে কলকাতার রাস্তা দিয়ে আর ছেলে উপভোগ করছে গাড়ির যাত্রা। মনে পড়ে যায়, ছোট্ট নরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা। ১৪ বছরের ছেলেকে পিতা বিশ্বনাথ একটি আরবি টাট্টু ঘোড়া কিনে দিয়েছিলেন এবং নরেন্দ্রনাথ টাট্টু ঘোড়া চেপে দাপিয়ে বেড়াতেন সিমলা পাড়া, দু'-চোখে স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন তাঁকে একদিন বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছিল। ভারতকে উপহার দিয়েছিল স্বামী বিবেকান্দকে।

More Articles