এই গাড়ি চড়েই দেশ ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা ছিল সুভাষচন্দ্রের
Car of Netaji Subhas: সুভাষচন্দ্র মত পরিবর্তন করেন এবং ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪১ জার্মান ওয়ান্ডারার গাড়ি নিয়ে কলকাতা থেকে গোমা যান, সে এক অন্য ইতিহাস।
আর ছ’বছর পরেই ওঁর জন্মশতবর্ষ। কিন্তু কে বলবে, উনি সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। যখন গর্জন করে ওঠেন, আর কলকাতার রাস্তা দিয়ে মাটি কামড়ে চলেন, তাঁর ঠাটবাটই আলাদা। গ্রিনিশ গ্রে রঙের আট সিলিন্ডারের স্টুডিবেকার বলে দেয়, তার আভিজাত্য আর মর্যাদার কথা। সারা পৃথিবীতে ১৯২৮ সালের স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট এইট একটিই গাড়ি বেঁচে আছে আর সেটার বাসস্থান দক্ষিণ কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোডে। সালটা ১৯২৮। কলকাতার ফ্রেঞ্চ মোটর কোম্পানি আমেরিকার স্টুডিবেকার কর্পোরেশনের দু'টি গাড়ি নিয়ে আসে প্রদর্শনীর জন্য। একটি গাড়ি স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট এইট আর অন্যটি একটি হুড খোলা ট্যুরার গাড়ি।
বহু আগেই কলকাতা তার কৌলীন্য হারিয়েছে। ১৯১১ সালে রাজধানী চলে গেছে দিল্লিতে আর তাই কলকাতা আর সেকেন্ড সিটি আফটার লন্ডন নয়। কিন্তু শিক্ষায়-দীক্ষায়-কৃতিতে কলকাতা ভারতের অন্য শহরগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে। আর এগিয়ে দামি, শৌখিন গাড়ি কেনাতে। এই জন্য পাশ্চাত্যে নতুন কোনও গাড়ি বাজারে এলেই কলকাতাতে তা প্রথম প্রদর্শিত করা হত, ক্রেতাদের বাজিয়ে দেখার জন্য।
আরও পড়ুন: বাঙালির হাতে নতুন করে জন্ম নিল রাজস্থানের পরিত্যক্ত গাড়ি
কাশিমবাজারের জমিদারবাবু কুমার কমলারঞ্জন রায় যখন এসেছেন স্টুডিবেকারটিকে দেখতে, একে একে সবাই বিদায় নিলেন, শুধু দাঁড়িয়ে আছেন ২২ বছরের কুমারসাহেব। ঘর ফাঁকা হতেই তিনি ম্যানেজার সাহেবকে বললেন, স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট এইট গাড়িটি তাঁর চাই। কাশিমবাজারের ধুলোমাখা পথে এই গাড়িটিই সঠিক বাহন। কুমারসাহেব যখন বলেছেন, এই গাড়িটি তাঁর চাই, তখন তাঁর চাইই চাই। তাঁর হ্যাঁ মানে হ্যাঁ আর না মানে না। অনেকক্ষণ ভেবে মাথা চুলকে ম্যানেজারবাবু বললেন, "তা কী করে হয় স্যর! এই গাড়িটা আমরা প্রদর্শনীর জন্য এনেছি, বিক্রির জন্য নয়। আপনাকে ঠিক এর জোড়া গাড়ি আমেরিকা থেকে আনিয়ে দিচ্ছি।" যুবক কুমারসাহেবের গোঁ– না, ওটাই লাগবে আমার। শেষমেষ কুমারবাহাদুরের জয় হল, বাড়ি আলো করে এল স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট এইট।
বিশাল গাড়িটার রূপই আলাদা। রাস্তা দিয়ে গেলে সবাই চেয়ে দেখে। গাড়ির চালকের সঙ্গে যাত্রীদের মাঝখানে আছে একটি কাচের পার্টিশন। ইন্টারকমের মাধ্যমে চালককে নির্দেশ দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা, কারণ চালক যেন যাত্রীদের কথোপকথন শুনতে না পান। ছিল কাট গ্লাসের ফুলদানি, ফ্যান, এবং বই পড়ার রিডিং লাইট। যাত্রীদের আরামের যেন কোনও খামতি না হয়, সেদিকে সর্বদা নজর ছিল স্টুডিবেকার কর্পোরেশনের। এই গাড়িটির বৈশিষ্ট্য ছিল, ভারতে চলবে বলে স্টিয়ারিং ছিল ডানদিকে অর্থাৎ রাইট হ্যান্ড ড্রাইভ।
গাড়িটিতে ছিল বিউগল হর্ন। সুরেলা এই হর্নটি শোনার জন্য মানুষ ভিড় করত, ফলে হর্ন দিয়ে তাদের সতর্ক করার বদলে হর্ন বাজালেই তারা গাড়ির কাছে চলে আসত। কলকাতা পুলিশের কর্তারা এক মহা সমস্যায় পড়লেন। শেষে কুমারবাহাদুরকে অনুরোধ করলেন, হর্নটি পাল্টানোর জন্য। কুমার কমলারঞ্জন রায় দু'টি স্টুডিবেকারের একটি কিনেছিলেন। অন্য গাড়িটির কী হলো, সেটা এখন সাসপেন্স থাক, লেখার শেষে জানাব। ইতিহাস সত্যিই অনবদ্য এক বিষয়, কোথায় যে তার বাঁক, কীভাবে তার চলন, এ বোঝা সত্যিই দায়।
গত নব্বই বছরের বেশি সময় ধরে রায় পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে স্টুডিবেকার। রায় পরিবারের প্রথা, নববধূ এই গাড়ি চেপে রায়বাড়িতে আসবে। এইভাবে ছয়ের দশকের গোড়ায় কমলারঞ্জনের পুত্র প্রশান্তকুমার নববধূকে নিয়ে এই গাড়ি করে রায়বাড়িতে এসেছিলেন। ব্যতিক্রম হয়নি প্রশান্তবাবুর পুত্র পল্লববাবু এবং তাঁর পুত্রর ক্ষেত্রেও। সত্যিই এ যেন এস ওয়াজেদ আলির বিখ্যাত উক্তি- সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলে আসছে, কোথাও তার পরিবর্তন হয়নি, এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
পল্লববাবুর বহু স্মৃতি আছে এই অযান্ত্রিককে নিয়ে। তার মধ্যে আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে কীভাবে নির্বিঘ্নে স্টুডিবেকার তাঁকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে। পল্লববাবু পড়তেন পার্ক সার্কাসের ডন বসকো স্কুলে। সাতের দশকে বর্ষাকালে ডন বসকো-র সামনে অসম্ভব জল জমত। ডন বসকো স্কুলের ফাদাররা অত জল জমলেও স্কুল ছুটি দিতেন না। এই অবস্থায় একমাত্র বাঁচাতে পারে স্টুডিবেকার। ঠিক সময়মতো নাতি পল্লবকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন স্কুলে, একদিনের জন্য পল্লবকে কোনও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি।
সব পুরনো জিনিসই একদিন তার ছন্দ, গতি হারায়। স্টুডিবেকারও তার ব্যতিক্রম নয়। একদিন সেও বসে পড়ল। বহু ক্ষেত্রে পুরনো গাড়িরা হারিয়ে যায়, আর তাদের হদিশ পাওয়া যায় না। স্টুডিবেকারের ক্ষেত্রে তা ঘটল না, পল্লববাবুর উৎসাহ আর পারিবারিক বৃদ্ধ পিতামহর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার জন্য।
পল্লববাবুর চোখ খুলে দিল আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার গাড়ির মিউজিয়াম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, গাড়িটি কেমন ছিল। খুব দামি কার্পেট ছিল, যেটি পাদানি হিসাবে ব্যবহার করা হত। গাড়ির বহুমূল্য সিলিংটি ছিল মানানসই। স্টুডিবেকার কোম্পানি এই গাড়িটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে সবরকম ব্যবস্থা করেছিল। সে যুগে স্টুডিবেকার আমেরিকাতে বহু একর জমি, পাহাড় কেনে এবং নতুন কোনও গাড়ি তৈরি হলে সেই গাড়িকে বহু মাইল ছোটানো হতো, যাতে যিনি কিনবেন, তিনি প্রথম দিন থেকেই গাড়িটিকে একেবারে বুক ঠুকে চালাতে পারেন। ঠান্ডা দেশের গাড়ি, তাই যাত্রীরা যাতে পা দু'-টি গরম কাপড়ে ঢেকে রাখতে পারেন,সেই ব্যবস্থাও ছিল গাড়িটিতে। পল্লববাবু পাঁচ বছর সময় নেন স্টুডিবেকারটিকে আবার তার হারিয়ে যাওয়া যৌবন ফিরিয়ে দিতে। একটি একটি করে জিনিস জোগাড় করে তাকে সাজিয়ে তোলা হল। এল সিলিংয়ের দামি কাপড়, কার্পেট, যুক্ত হল রিডিং লাইট, সিগারেট লাইটার আর কাট গ্লাসের ফুলদানি। নানা গহনায় সেজে উঠলেও তার হিরের নাকছাবিটি হল গ্রিনিশ গ্রে রংখানি। রংটিই বাড়িয়ে দিল তার আকর্ষণ, খুলে গেল তার রূপ।দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে প্রায় তিনি চলেন তাঁর গুরুগম্ভীর চালে। রাস্তায় মানুষজন সসম্ভ্রমে দেখেন শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই গাড়িটিকে।
লেখাটি শেষ করি অন্য যে স্টুডিবেকারটি ১৯২৮ সালে কলকাতাতে এসেছিল, সেটিকে দিয়ে। দ্বিতীয় গাড়িটি কিনেছিলেন নেতাজির সহোদর শরৎচন্দ্র বসু। শরৎবাবু হুডখোলা স্টুডিবেকার গাড়িটিকে খুব ভালবাসতেন। কেবল হাই কোর্ট পাড়াতেই নয়, গোটা কলকাতার মানুষ বলত বোস সাহেবের গাড়ি। কথা ছিল, সুভাষচন্দ্র ১৯৪১ সালের গোড়াতে এই গাড়িটি ব্যবহার করবেন। সেইমতো গাড়িটিকে ট্রায়াল রান করানো হয়, কিন্তু বর্ধমানে গিয়ে গাড়িটি বিকল হয়ে যায়। এমনভাবেই ব্রেকডাউন হয়েছিল যে, সেটিকে সারানো যায় না। পরে সুভাষচন্দ্র মত পরিবর্তন করেন এবং ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪১ জার্মান ওয়ান্ডারার গাড়ি নিয়ে কলকাতা থেকে গোমা যান, সে এক অন্য ইতিহাস।
জার্মান অডি কোম্পানি পল্লববাবুর সঙ্গে কথা বলেন ওয়ান্ডারার গাড়িটিকে পুনর্জীবন দান করার জন্য। তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন স্টুডিবেকারটিকে দেখে এবং সেই কারণে পল্লববাবুকে তাঁরা মনোনীত করেন। শেষ অবধি মিলে গেল ১৯২৮ সালের দুই স্টুডিবেকার– একটি হুডখোলা আর অন্যটি রায় পরিবারের স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট এইট।