বয়স ষাট, কলকাতার লাল-সাদা স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড লজ্জায় ফেলে ইনোভা-জাগুয়ারকেও

চারটি নাইলনের চাকা, মনকাড়া র‌ং- কালীঘাটের ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট দিয়ে যখন সে বের হয়, তখন তার ঠাটবাটই আলাদা। কে বলবে, মাঝখানে ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। 

মহাতীর্থ কালীঘাট। একান্নটি সতীপীঠের একটি কালীঘাটের মন্দিরে প্রতি বছর ভারত-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে ভক্তরা আসেন মাকে দর্শন করতে। কালীঘাট সর্বধর্মসমন্বয়ের কেন্দ্র। একদিকে হিন্দুদের মন্দির, অন্যদিকে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ, মসজিদ, গুরুদ্বারা কালীঘাটকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। ২০১১ সাল থেকে কালীঘাটেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আবাস। প্রাচীন এই জনপদের নবতম সংযোজন লাল সাদা টু-ডোর স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড। 

১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর মাঝামাঝি কলকাতার রাস্তায় স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড ছিল ছিমছাম, আধুনিক পরিবারের গাড়ি। প্রথমে দু'-দরজা ও পরে চার দরজার হেরাল্ড গাড়ি অ্যাম্বাসাডর এবং ফিয়াটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত। মুম্বাইয়ের ফিয়াট, পশ্চিমবঙ্গের অ্যাম্বাসাডর আর মাদ্রাজ, অধুনা চেন্নাইয়ের স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডের ছিল একচেটিয়া বাজার। হেরাল্ডের ছাদ খুলে দিয়ে গরমকালে হাওয়া খেতে বেরতেন গাড়ির মালিকেরা। এখনকার গাড়ির মতো হেরাল্ডে এয়ার কন্ডিশনার ছিল না, ছিল না পাওয়ার স্টিয়ারিং, কিন্তু গরমকালেও হেরাল্ডে চেপে কোনও কষ্ট হতো না। স্টিয়ারিং এত সুন্দর যে, অল্প জায়গাতে কাটাতে কোনও অসুবিধা হতো না। বহু হিন্দি সিনেমায় নায়ক-নায়িকাদের হেরাল্ডে চড়েই প্রেম করতে দেখা গিয়েছে। 

১৯৫১ সালে মাদ্রাজের স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি স্ট্যান্ডার্ড ভ্যানগার্ড তৈরি করা বন্ধ করে দেয়। ১৯৫৫ সালে তারা বাজারে ছাড়ে স্ট্যান্ডার্ড এইট ও স্ট্যান্ডার্ড টেন। ছোট্ট এই দুই গাড়ি অতি-জনপ্রিয় হয়েছিল। কিছুদিন হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে, কলকাতার রাস্তায় তখন বড় বড় আমেরিকান গাড়ি ট্যাক্সি হিসেবে চলত, যেমন শেভ্রোলে, পনটিয়াক, ডজ। ডা. বিধানচন্দ্র রায় স্ট্যান্ডার্ড এইট ও টেনকে ট্যাক্সির অনুমতি দিলেন এবং নাম দিলেন বেবি ট্যাক্সি। ১৯৯০-এর মাঝামাঝি দক্ষিণ কলকাতাতে একটি কালো-হলুদ স্ট্যান্ডার্ড এইট বেবি ট্যাক্সি দেখা যেত। 

আরও পড়ুন: অ্যাম্বাসাডর চালানো শেখো, বাঙালি যুবকদের বলতেন বিধান রায়

১৯৫৯-'৬০-এ বাজারে এল স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড মার্ক ওয়ান। দুটো দরজা। স্টিয়ারিং গিয়ার নয়, ফ্লোর শিফট গিয়ার, যাকে চলতি ভাষায় লাট্টু গিয়ার বলে। ফিয়াট বা অ্যাম্বাসাডরে স্টিয়ারিং গিয়ার ছিল। এক হাজার সিসি-র, চার সিলিন্ডারের ইঞ্জিন। স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড মার্ক ওয়ান আসত নানারকম চোখ ধাঁধানো রঙে। নীল, সবুজ, আবার এক-একটা গাড়িতে দু'টি রঙেরও ব্যবহার হয়েছে, যেমন গ্রিন গ্রে, রেড অ্যান্ড হোয়াইট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকানরা প্রথম দু'-রঙা গাড়ি বের করে। ভারতে স্ট্যান্ডার্ডই প্রথম দু'-রঙা গাড়ি নিয়ে আসে। 

১৯৬৬-তে আসে স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড ফোর ডোর বা চার দরজার গাড়ি, যা চলেছিল ১৯৭১ পর্যন্ত। তারপর স্ট্যান্ডার্ড গ্যাজেল, সেটিও চার দরজার গাড়ি। 

Standard Herald

গ্রাফিক্স: দীপ হাওলাদার

 

শুভজিৎ কুমারদের কালীঘাট অঞ্চলে বাস দুশো বছরের। পুরনো কলকাতার ইতিহাসের একনিষ্ঠ সেবক শুভজিৎ একটি স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড মার্ক ওয়ান কেনেন ২০১৫-'১৬ সালে। ১৯৬৩ মডেলের এই গাড়িটি যৌতুকে এক ডাক্তারবাবু পেয়েছিলেন। তার খুব প্রিয় ছিল গাড়িটি। এই গাড়ি চেপে তিনি চেম্বারে যেতেন। আটের দশকের গোড়ায় মারুতি বাজারে এল। কমতে শুরু করল ফিয়াট, অ্যাম্বাসাডর আর স্ট্যান্ডার্ডের বিক্রি। ডাক্তারবাবুর গাড়ি কালের নিয়মে অস্তাচলে চলে গেল। তিনি এতটাই গাড়িটিকে ভালবাসতেন যে, তাঁর উত্তরসূরিদের বলে যান, তাঁর জীবিতকালে যেন গাড়িটিকে বিক্রি করে না দেওয়া হয়। 

শুভজিৎ যখন গাড়িটিকে বাড়িতে আনেন, তখন প্রায় দু'-যুগ গাড়িটিকে ব্যবহার করা হয়নি। গাড়িটির প্রত্যেকটি পার্টস অরিজিনাল, কিন্তু বহুদিন না ব্যবহারের ফলে ইঞ্জিন, সাসপেনসন, গিয়ার বক্সের কাজ ছিল। ষাট বছরের পুরনো অযান্ত্রিককে সাজিয়ে গুছিয়ে আবার রাস্তায় নামানো খুব ধৈর্যর ব্যাপার। কাজ শুরু হলে একটা না একটা সমস্যা বেরিয়ে আসে, আর তখন মনে হয় দরকার নেই এগোনোর। পুরনো বাড়ি যেমন সংরক্ষণ করা অত্যন্ত কঠিন, কারণ ঠিকঠাক রাজমিস্ত্রি পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনই এখন পুরনো গাড়ি সারানোর মানুষ পাওয়া কঠিন। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা এতটাই বৃদ্ধ যে, তাঁদের অনেকেই পুরনো গাড়িতে হাত দিতে চান না। 

Standard Herald

ছবি সৌজন্য: লেখক

শুভজিৎ প্রায় দেড় বছর ধরে হেরাল্ড মার্ক ওয়ানকে দাঁড় করান। ব্যাক লাইট দু'টি নষ্ট হয়ে যায়, তাই বিলেত থেকে তাদের আনানো হয়। গাড়ি যখন আবার রাস্তায় চলতে শুরু করল, তখন ভাবনাচিন্তা আরম্ভ হল কী রঙ লাগানো যায়। শেষে রেড অ্যান্ড হোয়াইট- ছাদ সাদা, দেহটি লাল এবং সাদা বর্ডারে মোহময়ী হয়ে উঠল হেরাল্ড মার্ক ওয়ান। যেহেতু দু'টি দরজা, তাই সামনের বাঁদিকের সিটটি ভাঁজ করে পিছনে গিয়ে বসতে হয়। গাড়ির ছাদে আটটি নট আছে, যেগুলো খুলে দিলেই হুডখোলা পক্ষীরাজে পরিণত হয় লাল আর সাদায় মেশানো ছোট্ট সোনামণি। 

গাড়িটি এই পর্যন্ত ৮০,০০০ মাইল চলেছে। চারটি নাইলনের চাকা, মনকাড়া র‌ং- কালীঘাটের ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট দিয়ে যখন সে বের হয়, তখন তার ঠাটবাটই আলাদা। কে বলবে, মাঝখানে ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। 

দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ লেকের ধারে তিনি হাওয়া খেতে যান, ঘুরে বেড়ান নিউটাউনের রাস্তায়। হুশ করে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ইনোভা বা জাগুয়ার থমকে যায় স্ট্যান্ডার্ড মার্ক ওয়ানের রূপ আর চলন দেখে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ আত্মবিশ্বাসের। ইতিহাসের সাক্ষী অযান্ত্রিক নিঃসন্দেহে দক্ষিণ কলকাতার গর্ব।

 

More Articles