বাঙালির হাতে নতুন করে জন্ম নিল রাজস্থানের পরিত্যক্ত গাড়ি
কথায় বলে না, যে খায় চিনি, তাকে যোগায় চিন্তামণি। ২০১৭ সালে একটা খবর এল রাজস্থানের চুরু শহরে একটা ১৯৪৮ সালের এম.জি.টি.সি. পড়ে আছে, অনাদরে, অবহেলায়।
হাই কোর্টের তরুণ আইন-ব্যবসায়ী রূপক ঘোষ মশাই কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছেন না। সব ঠিকঠাক চলছিল এমন সময় বাধ সাধল একটা ঝাঁ চকচকে এম.জি.টি.সি গাড়ি। সালটা ২০১০-'১১, রূপকবাবু স্ত্রীকে নিয়ে চলেছেন একটা কাজে। অন্যদিনের মতো নিজেই ড্রাইভ করছেন। মা ফ্লাইওভারের কাছে ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়িটা দাঁড়িয়েছে, এমন সময় পাশে এসে দাঁড়াল একটা এম.জি.টি.সি। চকচকে চেহারা। আর বাতি সবুজ হতেই এক নিমেষে হারিয়ে গেল।
ব্যস, আর যায় কোথায়! রূপকবাবুর মাথা গেল ঘুরে। বাড়ির কাজ করছেন, ছেলের সঙ্গে খেলছেন, আদালতেও যাচ্ছেন, কিন্তু মন পড়ে আছে এম.জি-তে। যদি পুরনো গাড়ি কিনতেই হয়, তবে একটা এম.জি. কিনব। মাস যায়, বছর যায় কিন্তু এম.জি.-র কোনও হদিশ নেই।
কথায় বলে না, যে খায় চিনি, তাকে যোগায় চিন্তামণি। ২০১৭ সালে একটা খবর এল রাজস্থানের চুরু শহরে একটা ১৯৪৮ সালের এম.জি.টি.সি. পড়ে আছে, অনাদরে, অবহেলায়। রূপকবাবুর মামার বাড়িতে একসময় নানারকম গাড়ি ছিল– ১৯৪৭-এর আমেরিকান ঢাউস গাড়ি ওল্ডসমোবিল, শেভ্রোলে ফ্লিটমাস্টার, এমনকী, স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড আর ল্যান্ডমাস্টারও ছিল। গাড়ি-প্রীতি মামাবাড়ি থেকেই পাওয়া।
আরও পড়ুন: বিধানচন্দ্র রায় থেকে জ্যোতি বসু, এই মডেলের ফিয়াট পছন্দ ছিল সকলেরই
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল এম.জি-টি তখনও আছে, আর দেরি না করে একজন মেকানিককে পাঠানো হলো রাজস্থানে নিজের চোখে গাড়ির চেহারাটা দেখে আসতে। মেকানিক ভদ্রলোক যা বললেন, তাতে রক্ত হিম হয়ে যাবার কথা। একটি বড় হাভেলির পিছনে তিনি পড়ে আছেন। বহু বছর কোনও যত্ন নেওয়া হয়নি। শোনা গেল, ওই হাভেলির মালিকেরা একসময় গাড়ির স্পেয়ার পার্টসের ব্যবসা করতেন, এবং দক্ষিণ ভারত থেকে গাড়িটিকে রাজস্থানে নিয়ে যান। বেশ কিছু বছর গাড়িটি চড়েন আর তারপর শুরু হয় অযান্ত্রিকের ওপর নানা ভয়ংকর পরীক্ষা। প্রথমেই টু সিটার গাড়িকে ফোর সিটার বানানোর চেষ্টা হয়। এম.জি-র ইঞ্জিন ফেলে দিয়ে ফিয়াটের ইঞ্জিন বসানো হয়, সঙ্গে তার গিয়ার বক্স। দেখতে ভালো হবে, এই আশায় জিপসির স্টিয়ারিং লাগানো হয়। ইঞ্জিন বক্স, গিয়ার বক্স- যেগুলো এম.জি-র ছিল, সেটিকে গাড়ির পাশে ফেলে রাখা হয়। সবাই রূপকবাবুকে বলল, এই আপদটি নেবেন না, কারণ একে চালানো বা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া ড্যাশবোর্ডের মিটারগুলো হাওয়া হয়ে গেছে আর তাই এটিকে কলকাতাতে না নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
কথায় বলে বাঙালির বুলডগের গোঁ ; একবার যেটা মাথায় ঢুকবে, সেটি বাস্তবে রূপ না দেওয়া অবধি ঠান্ডা হতে পারবে না। স্বামীজি নিজের গোঁ কে বুলডগের গোঁ বলতেন।
২০১৭ সালে ট্রাকে করে সুদূর চুরু শহর থেকে তিনি এলেন। 'খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে'– না, এই প্রবাদবাক্যটিকে ভুল প্রমাণ করে ছেড়েছেন রূপকবাবু। সবাই বলেছিল, এই গাড়ির কোনও ভবিষ্যৎ নেই, কিছুই করা যাবে না এটিকে নিয়ে। এই জগদ্দল দাঁড়িয়েই থাকবে আর তারপর একদিন মল্লিকবাজারে কাটাই হতে চলে যাবে।
এবার রূপকবাবুর আসল পরীক্ষা শুরু হল। দু'টি সাইট পাওয়া গেল– মস মোটরস আর অ্যাবিংটন স্পেয়ারস যেখানে এম.জি পার্টস পাওয়া যায়। এই গাড়ি তৈরি বন্ধ হয়ে যায় পাঁচের দশকের গোড়াতেই, তাই সব পার্টস পাওয়া যাবে কি না, সেটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবুও চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি রূপকবাবু। মেলে পরিচয় হল কিছু সাহেবের সঙ্গে, তাঁরা আশ্বস্ত করলেন যে, চেষ্টা করবেন পার্টস জোগাড় করে দিতে।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। বেশ কিছু আমেরিকান সেনা অফিসার ইংল্যান্ড থেকে নিজের দেশে এম.জি.টি.সি. কিনে নিয়ে যান। আমেরিকায় তখন ঢাউস গাড়ির রাজত্ব– ক্যাডিলাক, বুইক, লা সেল, প্যাকার্ড, পনটিয়াক, হাডসন, ডজ, স্টুডিবেকার। এই গাড়িগুলো খুব আরামদায়ক, সোজা হাইওয়েতে চলেও চমৎকার কিন্তু এদের দিয়ে মোটর রেসিং হবে না। অন্যদিকে এম. জি. টি. সি. চমৎকার চলে আর শনিবার রবিবার রেস করা যায়। সোজা রাস্তা দিয়ে বাঁই বাঁই করে এম. জি ছোটে। ছয় সিলিন্ডার, আট সিলিন্ডারের আমেরিকান গাড়ি পিছনে পড়ে থাকে। ১৯৪৯-'৫০ থেকে আমেরিকাতে শুরু হয় এম.জি-র জয়যাত্রা এবং এখনও তা অব্যাহত। এরই মধ্যে বহু এম. জি ক্লাব তৈরি হয়েছে যারা শনি-রবি বা বিশেষ ছুটির দিনে গাড়ির রেস করে।
রূপকবাবুর মনে হলো, তিনি এবার একটু করে আলো দেখতে পাচ্ছেন। কিছু পার্টস ইংল্যান্ড থেকে এল এবং তাঁর মনে হতে লাগল, ৭৫ বছরের যুবকটিকে নতুন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে আবার রাস্তায় নামানো যাবে।
২০২০ সালের গোড়াতে করোনা অতিমারীর কারণে শুরু হল লকডাউন। আইন-আদালত বন্ধ হয়ে গেল। রূপকবাবু এই অবকাশকে কাজে লাগালেন এম.জি-কে নতুনভাবে প্রাণ দান করতে। এখন পুরনো গাড়ির ক্ষেত্রে বলা হয়, পুনরুত্থান (restoration) নয়, পুনঃপ্রতিষ্ঠা (resurrection)।
নতুন সাজে সেজে উঠল এম.জি। সব পার্টস লাগানোর পরে ইঞ্জিন ডেকে উঠল। সেদিন রূপকবাবু আর তার দলের মেকানিক সদস্যদের আনন্দ আর ধরে না। যে গাড়িকে সবাই বাতিলের মধ্যে ধরেছিল, এবং কিছু মানুষ এসে জানতে চাইতেন, “আচ্ছা! এই পুরনো গাড়িটা যে আপনি নিলেন, সেটা চলে না এখনও বসে আছে”– সেই গাড়িটা আজ জেগে উঠেছে। এম.জি সাজল ক্লিপার ব্লু রঙে। এটি অসাধারণ একটি রঙ। এম. জি-র রূপ এই রঙ ব্যবহার করার ফলে শতগুণ খুলে গেল।
হুডখোলা দু'-সিটার এম.জি.টি.সি. তখন উত্তর কলকাতার সম্পদ। বেথুন কলেজের পিছনে বেথুন রো দিয়ে যখন তিনি অভিসারে বের হন, তখন রাস্তায় ভিড় জমে যায়। সবাই অবাক হয়ে ওঁকে দেখে। ওঁর রূপের তারিফ না করে উপায় নেই, আর সে গতি ঝড়কেও হার মানায়।
এখন রূপকবাবু প্রায়ই এম.জি.টি.সি. নিয়ে বের হন। “ওর বয়স তো অনেক হলো, তাই খুব ধরে চালাতে হয়। গর্তে পড়লে আমারই কষ্ট হয়, মনে হয় আমার পাঁজরে লাগল”, বলেন রূপকবাবু। পুরনো গাড়ি মানে চলমান সময়ের সাক্ষী। তাই ওঁকে অনেক যত্ন করতে হয়, তুইয়ে-বুইয়ে চালাতে হয় আর বেশি জোরে চালালে উনিও শাসন করেন চালককে; এইভাবে তৈরি হয় প্রাচীনের সাথে নবীনের মেলবন্ধন, বন্ধুত্ব, ভালবাসা।
ছবি সৌজন্য: লেখক, গ্রাফিক্স: দীপ হাওলাদার