ইংরেজদের হাত থেকে বাঁচতে যেতে হয়েছিল মাটির তলায়, এখনও চলা থামেনি সেই গাড়ির
জমিদার মানিকলাল দে মহাশয়ের মন একদম ভালো নেই। একে তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, খবরের কাগজ খুললেই শুধু মৃত্যু আর ধ্বংসের খবর। কেউ কেউ বলছে, যে কোনওদিন কলকাতাতে বোমা ফেলবে জাপানিরা, সেই চিন্তাও জমিদারবাবুকে নাড়া দিয়েছে।
আজ যে খবর মানিকলালবাবু পেলেন, তা তার মন ভেঙে দিল। তাঁর কাছে খবর এসেছে ছোটলাটের দপ্তর থেকে, যে, তার প্রিয় জার্মান অ্যাডলার গাড়িটি ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট নিয়ে যাবে তাদের আর্মি অফিসারদের ব্যবহারের জন্য। বুঝেই উঠতে পারছেন না, কী করবেন জমিদারবাবু। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ডেকে পাঠালেন এস্টেটের ম্যানেজারবাবুকে। গম্ভীরভাবে বললেন, “বরানগরে বাগানবাড়িতে অ্যাডলারকে নিয়ে যাও, আর মাটি খুঁড়ে ওকে কবর দিয়ে দাও। আর দেখো একটা চাঁপা গাছ পুঁতে দেবে, যেন জায়গাটা চেনা যায়। যেখানে অ্যাডলার ঘুমিয়ে থাকবে।" ম্যানেজারবাবু তো অবাক! গোটা গাড়িটা কবর দেওয়া হবে, এও কি সম্ভব! জমিদারবাবুর হুকুম তো তামিল করতেই হবে। মানিকবাবুর সাফ কথা, আমি বেঁচে থাকতে অ্যাডলার অন্য কেউ চড়ে বেড়াবে, সে আমি সহ্য করতে পারব না। ১৯৩৮ সালে মানিকবাবু অ্যাডলারটি কিনেছিলেন। জার্মান গাড়ি। খুব তেজ তার। চোখের জলে বিদায় দিলেন অ্যাডলারকে। এদিকে বরানগরের বাগানবাড়িতে তখন হইহই রইরই কাণ্ড চলছে। মাটিতে বিরাট গর্ত তৈরি হল, কবর দেওয়া হল অ্যাডলারকে।
বিশ্বমহাযুদ্ধ ১৯৪৫-এ থেমে গেল। ভারত ভাগ হল ১৯৪৭ সালে। জমিদারবাবুও বৃদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু অ্যাডলারকে কবর থেকে তোলার বাসনা আর তাঁর নেই। ও কি আর এতদিন আছেস? আর সে কোনওদিন চলবে না, বিলাপ করেন মানিকলালবাবু।
আরও পড়ুন: গোটা দেশের সবেধন নীলমণি লাল টুকটুকে হিলম্যান
১৯৬৫ সালে মানিকবাবুর নাতি গদাইচন্দ্র হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় পাশ করেছেন। পিতা হরিমোহন দে গদাইবাবুকে ডাকলেন, আর হাতে একটা চাবি দিয়ে বললেন, "এটাই তোমার পরীক্ষার পাশের পুরস্কার। যাও, বরানগরের বাগানবাড়িতে যাও, দেখো কিছু করতে পারো কি না।"
বাগানে গিয়ে গদাইবাবু উত্তেজনায় কাঁপছেন। বুড়ো মালি তাঁকে দেখিয়ে দিলেন সেই চাঁপা গাছ, যার নীচে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে অ্যাডলার। এক রবিবার লোক-লস্কর নিয়ে বাগানে পৌঁছলেন গদাইবাবু। এদিকে খবর চাউর হয়ে গেছে, আজ মাটির নীচ থেকে গাড়ি তোলা হবে। তাই সকাল থেকেই জমতে শুরু করল উৎসাহী জনতার ভিড়। মাটি খুঁড়ে, ক্রেন দিয়ে তোলা হল ঘুমন্ত অ্যাডলারকে। সারা গায়ে মাটি। ইঞ্জিন মাটিতে ঢেকে গেছে, চাকা বসে গেছে। গদাইবাবুর মনে পড়ছে পারিবারিক স্মৃতি। এই গাড়ি চড়ে দাদামশাই ঘুরে বেড়াতেন। দে পরিবারের ঐতিহ্য আর ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল অ্যাডলার।
এরপর আগামী এক বছর চলল অ্যাডলারের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙানোর পালা। মাটি পরিষ্কার করতেই বেরিয়ে পড়ল অ্যাডলারের রূপ। বিশালদেহী, ফ্রন্ট হুইল ড্রাইভ গাড়িটি জার্মান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। গদাইবাবুর একান্ত চেষ্টায় একদিন জেগে উঠল 'স্লিপিং লেভিয়াথান'। ইঞ্জিন পরিষ্কার হয়ে গেছে, তেল ঢালতেই ডেকে উঠল অ্যাডলার, কাইজারের উত্তরাধিকারী। তার গর্জন, ঠাটবাটই আলাদা। নতুন টায়ার পরানো হয়েছে, নতুন কাপড়ের হুডে সুন্দর অ্যাডলার রাজার মতো দাঁড়িয়ে আছে। স্টিয়ারিংয়ে বসে গদাইবাবু অ্যাক্সিলেরেটরে পা দেওয়ামাত্র চলতে শুরু করল অ্যাডলার, তিন দশকের ঘুম ভেঙে।
এখনও নিয়মিত চলে সে। বিভিন্ন পুরনো গাড়ির প্রতিযোগিতা আর শো-তে অংশ নেয় সে। দে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য অ্যাডলার। যেখানেই যায়, সেখানেই শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রম আদায় করে সে।
গদাইবাবুর রক্তে-মজ্জায় গাড়ি। কীভাবে তিনি একটি পুরনো গাড়ির সন্ধান পেলেন এবার সেই গল্প শোনাব।
গদাইবাবু তখন ভবানীপুর থানার অফিসার ইন-চার্জ। যে থানাতেই দে-মশাই গেছেন, সেখানেই অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করেছেন। সত্যিই তাঁর ভয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় “ডাকাইত তোমার ভয় নিরস্ত্র ছিল, তস্কর তোমার ভয় এস্ত ছিল।"
একদিন রাতে রেডে বেরিয়ে গদাইবাবু একটি চোরকে তাড়া করছেন। চোর ছুটছে, উনি তাড়া করছেন। একসময় চোরটি একটি পুরনো বাড়ির পাঁচিল টপকে তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। গদাইবাবু চারদিক খুঁজছেন। চোরের কোনও পাত্তা নেই। হঠাৎ দেখেন, একটা কাচের মধ্যে থেকে একজোড়া উজ্জ্বল চোখ। কাছে যেতেই দেখেন একটি পুরনো, ভাঙা গাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে চোরবাবাজি। তাকে তো ধরা গেল। কিন্তু দারোগা মশাইয়ের মনপ্রাণজুড়ে তখন ওই ভাঙা, পুরনো অযান্ত্রিক।
গাড়িটি ১৯৩১ সালের স্ট্যান্ডার্ড লিটল ৯। ব্রিটিশ গাড়ি। অর্ধেকের বেশি মাটির তলায় চলে গিয়েছিল গাড়িটি। গাড়ির মালিককে রাজি করিয়ে গাড়িটি কেনেন গদাইবাবু। তারপর শুরু হয় তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনার লড়াই। তার দেহ অনেকটাই ক্ষতবিক্ষত। বহুদিন ব্যবহার হয়নি, তাই ইঞ্জিন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত। বহু মিটার খোয়া গেছে ততদিনে।
গদাইবাবু হার মানার পাত্র নন। একটু একটু করে সারিয়ে তুললেন লিটল ৯-কে। সত্যিই সে ছোট, লিটল। প্রতিটি অংশ অতি সাবধানে, যত্নে, সন্তর্পণে পুনর্নির্মাণ করা হল। সে স্টার্ট নিল এবং গড়গড় করে চলল।
আজ গদাইবাবুর কাছে চারটি 'প্রপিতামহ' আছেন, সকলেরই বয়স ৮৩ থেকে ৯১ বছরের মধ্যে। ১৯৩৮ সালের অ্যাডলার, ১৯৩৯ সালের মরিস ৮, গাড়িটি শিকারে যেত নিয়মিত; স্ট্যান্ডার্ড লিটল ৯ ১৯৩১ আর অস্টিন টেন ফোর ১৯৩৪। গদাইবাবুর বক্তব্য, “বেশ আছি ওদের নিয়ে। সকলেরই বয়স হয়েছে। ওদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হয়। রাস্তায় বের করলে ওদের মতো করে নিয়ে যাই, গর্ত বাঁচিয়ে, ভিড় এড়িয়ে নিয়ে যেতে হয়। ওদের সাংঘাতিক অহংকার– বুড়ো বললে হয়তো রেগে গিয়ে রাস্তায় থেমে গেল, তখন আবার চালু করা যে অনেক সাধ্যসাধনার ব্যাপার।"