রহস্যময় মৃত নক্ষত্রদের থেকেই তৈরি মানুষ! কীভাবে মৃত্যু হয় তারাদের?

Nuclear Fusion: ‘নিউক্লিয়ার পাস্তা’ই এখনও পর্যন্ত মহাবিশ্বের সব থেকে কঠিনতম পদার্থ, যা ভাঙা একেবারেই অসম্ভব। এক ইঞ্চি উঁচু পাস্তাই হিমালয়ের চেয়ে ভারী হতে পারে।

“আমাদের ডিএনএতে নাইট্রোজেন, আমাদের দাঁতে ক্যালসিয়াম, আমাদের রক্তে লোহা, আমাদের আপেলের পাইয়ের কার্বনগুলি ভেঙে যাওয়া তারাগুলির অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছিল। আমরা তারার অংশ বিশেষ দিয়ে তৈরি।”

 ক্যার্ল সাগান

 

আগেকার দিনে মানুষ সূর্যের দিকে তাকিয়ে ভাবতো যদি সূর্য কখনও নিভে যায় মশাল বা লণ্ঠনের মতো! তাহলে আমাদের কী হবে? আমাদের চারপাশের জগৎ কি মিশে যাবে নিকষ ঘন কালো অন্ধকারে? ক্ষণিকের গ্রহণ লাগলে তো মানুষের কপালে ভাঁজ পড়ে যেত! ভাবতো, এইরে সূর্যের জ্বালানি শেষ হয়ে গেল না তো? আবার কখন দেখা মিলবে সূর্যিমামার? ঝলমল করে উঠবে আমাদের চারপাশের গাছ, পাতা, ফুল ও ফল! হেসে উঠবে ধরণী! আপাত দৃষ্টিতে এই আশঙ্কা অর্বাচীন মনে হলেও এর শিকড় প্রোথিত আছে অনেক গভীরে।

সময়ের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের কৌতূহলী মনকে নাড়িয়ে দিল। তাঁরা খুঁজতে থাকলেন সেই অর্বাচীন জিজ্ঞাসার সদুত্তর। আর শুধু সূর্য নয়, তাঁরা সন্ধান করতে লাগলেন বিভিন্ন ধরনের নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু ও জীবনচক্রের হেঁয়ালির। যদিও বিংশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত সে বিষয়ে নিখুঁত কোনও ধারণা পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, তারাদের মৃত্যু তার আকারের ওপর নির্ভর করে। যার আকার যত বেশি, তত তাড়াতাড়ি জ্বালানি খরচা করে সে। সে দিক থেকে আমাদের সূর্য বেশ ছোট আকারের নক্ষত্র। তাই তার পতনও বিশাল বিশাল তারকাদের মতো অত জাঁকজমক ভরা নয়। কোন তারার জ্বালানি কবে শেষ হবে, তাদের অন্তিম দশা কী হবে, এসব জানতে গেলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে একটি নক্ষত্রের জ্বালানি আসে কোত্থেকে? এ বিষয়ে ১৯২০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন একটা প্রাথমিক ধারণা দেন। পরবর্তীকালে, ১৯৩৮-৩৯ সালে জগৎ বিখ্যাত পদার্থবিদ হানস্ বেথে ও ফন উইসজেইকার জানান, তারাদের হেঁশেলের ইন্ধনের যোগান আসে 'নিউক্লিয়ার ফিউশন' অর্থাৎ 'নিউক্লিও সংযোজন' থেকে। মানে দুটো হালকা পারমাণবিক ভর বিশিষ্ট নিউক্লিয়াস মিলিত হলে যে শক্তি নির্গত হয়, তাইই জ্বালিয়ে রাখে আমাদের দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সমস্ত তারকাদের। নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণের উপর এই অসামান্য অবদানের জন্যে নোবেল কমিটি, তার প্রায় তিন দশক পরে, ১৯৬৭ সালে বেথেকে পুরস্কৃত করেন! যাক সে কথা। আমরা বরং দেখি কী এই 'নিউক্লিও সংযোজন'?

‘নিউক্লিও সংযোজনের’ শুরুটা হয় প্রকৃতির সর্বপেক্ষা সরল পরমাণু হাইড্রোজেনকে দিয়ে। এই অতি সাধারণ একমাত্র ‘প্রোটন’ বিশিষ্ট পরামাণুই তারাদের হেঁশেলের প্রথম খড়িকাঠ! এর পরে আসে দ্বি-‘প্রোটন’ বিশিষ্ট পরমাণু হিলিয়ামের পালা- যার কেন্দ্রকে ঘিরে বনবন করে ঘুরতে থাকে দু’টি ইলেকট্রন। ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট প্রোটনগুলো তড়িৎ বিকর্ষণের জন্যে একে অপরকে সহ্য করতে না পেরে পরস্পর থেকে ছিটকে যেতে চায়। তাদেরকে হিলিয়াম পরমাণুর কেন্দ্রে শক্ত করে বেঁধে রাখে দু’টি নিউট্রন। সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু এ নিউক্লিও সংযোজন হয় কেমন করে? তারাদের মধ্যে মহাকর্ষও তো কাজ করে!

তারাদের হেঁশেলে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো প্রবল বেগে ছোটাছুটি শুরু করে, তাদের ভেতরে বিরাজমান মহাকর্ষ বলের জন্যে। তার ফলে নিজেদের মধ্যে অবিরত ঠোকাঠুকি হতে থাকে। এই ঠোকাঠুকির এক পর্যায়ে, যখন হাইড্রোজেন পরমাণুর বেগ একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করে, তখন জোরপূর্বক একটি হাইড্রোজেন পরমাণু অপর একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রে ঢুকে পড়ে। এভাবে একে একে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সংযুক্তির মাধ্যমে জন্ম নেয় একটি হিলিয়াম পরমাণু। আর বাদবাকি দু’টি প্রোটন রূপান্তরিত হয় নিউট্রনে। সাধারণত হিলিয়াম পরমাণুর কেন্দ্রকের ভর দু’টি নিউট্রন ও দু’টি প্রোটনের সম্মিলিত ভর থেকে ০.০০৭ ভাগ কম। প্রোটন ও নিউট্রন সহযোগে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়ার সময় যেটুকু ভরের বৈষম্য তৈরি হয়, পদার্থ বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে বলে 'ভর ত্রুটি'। আইনস্টাইনের 'ভর-শক্তির' তুল্যতা অনুসারে এই বাড়তি ভর রূপান্তরিত হয় শক্তিতে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পোশাকি নাম 'নিউক্লিও সংযোজন’। এবং বাকি তারাদের মতো আমাদের সূর্যেরও হেঁশেলের প্রয়োজনীয় জ্বালানি আসে এখান থেকেই। সূর্য থেকে ৪০,০০,০০০ টনের মতো হাইড্রোজেন বিকিরণের আকারে নিঃশেষিত হচ্ছে প্রতিক্ষণে। আর সে কারণেই সূর্যের আলোর এত তেজ ও তীব্রতা।

হিলিয়াম ধীরে ধীরে জমা হয় তারাদের কেন্দ্রে। হিলিয়াম পরমাণুর ভর হাইড্রোজেনের তুলনায় বেশি হওয়ায়, ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকে নক্ষত্রের কেন্দ্র। এই বাড়তি ভরের দরুণ বেশি পরিমাণ তাপ শক্তি তৈরি হয় তারাদের অন্দরে। এই তাপ বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে, নক্ষত্রের চাপ ও তাপমাত্রা যখন একটি সীমান্ত মানে পৌঁছয়, হিলিয়াম পরমাণুদের ভিতর তখন শুরু হয় 'নিউক্লিয়ার ফিউশন'। এই নিউক্লিও সংশ্লেষণের এক পর্যায়ে তৈরি হয় প্রকৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, কার্বন।

যে সমস্ত তারারা আমাদের সূর্যের থেকে সর্বোচ্চ দেড়গুণ বেশি ভারি, তারা হিলিয়াম পরমাণুর সংশ্লেষণের প্রয়োজনীয় তাপের যোগান দিতে পারে না- ফলত তাদের ক্ষেত্রে কার্বন উৎপন্ন হয় না। এদের মৃত্যুও হয় খুব সাদামাটা। হাইড্রোজেন যখন শেষ হওয়ার পথে, তখন মহাকর্ষের চাপে তারার ব্যাস সময়ের সঙ্গে কমতে থাকে, কিন্তু আবার সংকোচনের ফলে বিপুল পরিমাণ তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা তারার বাইরের পৃষ্ঠের হাইড্রোজেনগুলোকে নিউক্লিয়ার সংযোজন চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। বিপুল গতিশক্তি সঞ্চারের দরুণ যখন হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে, নক্ষত্রের বাইরের স্তরটি তখন ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এই অবস্থায় জ্যোতিপদার্থবিদরা তারাকে ডাকেন ‘রেড জায়ান্ট’ বা ‘লাল দৈত্য’ নামে।

আরও পড়ুন- পৃথিবীর মতো নক্ষত্রেও হয় ভূমিকম্প? মহাকাশ থেকে যে তথ্য পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা

রেড জায়ান্ট স্টার

যখন তারাদের আকার আরও বড় হয়, তার তাপশক্তি চারপাশে ছড়িয়ে যেতে থাকে, ফলে তাপমাত্রাও কমতে থাকে প্রতিনিয়ত। ফলত, নক্ষত্রটির ভর হ্রাস পেতে শুরু করে। যদিও এর কেন্দ্রটি সুরক্ষিত থাকে। এই কেন্দ্রটিই তারাটির পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের অন্তিম ধাপ। যার পোশাকি নাম ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ’। অপরদিকে সূর্যের দেড় থেকে চারগুণ পর্যন্ত ভারী তারাদের বেলায় কার্বন ও অক্সিজেন প্রায় একসঙ্গে তৈরি হয়। তাই শেষ সময়ে এই তারাগুলিই কার্বন ও অক্সিজেনের একটি হোয়াইট ডোয়ার্ফে রূপান্তরিত হয়। আমরা স্কুলে ভৌতবিজ্ঞান পড়ার সময় জেনেছি, প্রবল চাপ ও তাপে কার্বন হিরেতে রূপান্তরিত হয়। তাই এ ধরনের 'হোয়াইট ডোয়ার্ফ' মহাশূন্যে টিকে থাকে এক বিরাট আকারের হিরে হিসেবে।

হোয়াইট ডোয়ার্ফ

যেসব তারারা সূর্যের চেয়ে অন্তত দশগুণ ভারী, তাদের শক্তি এতটাই বেশি যে তারা কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন থেকে শুরু করে নিউক্লিও সংযোজনের মাধ্যমে সিলিকনও তৈরি করতে পারে, যাদেরকে বিজ্ঞানীমহল চেনে ‘সুপারজায়ান্ট তারা’ নামে। এই সিলিকনগুলিই আবার সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি করে আয়রনের মতো পরমাণুকে। একবার আয়রন তৈরি হতে শুরু হওয়া মানে তারাটির পতন খুবই সন্নিকটে। কারণ, এই পর্যায়ে এসে তারাটির সংসার চালাতে যে শক্তির প্রয়োজন হয়, তা নিউক্লিও সংযোজনে উৎপন্ন শক্তির থেকে অনেক বেশি। সামাল দেবে কোত্থেকে? ওদেরও তো হিসেব করে চলতে হয় নাকি! আর এই আয়রন তৈরির সময় এর থেকে বিপুল হারে শক্তি বিকিরিত হয়। কারণ, আমরা জানি যে কোনও ভারী তারার অন্দরমহলের গঠন অনেকটা পেঁয়াজের খোসার মতো, বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে ‘ওনিয়ন লাইক স্ট্রাকচার’-যার বিভিন্ন শেলে অবস্থান করছে একে একে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, কার্বন, অক্সিজেন ও সিলিকন। তারার একবারে বাইরের পৃষ্ঠে হিলিয়াম সংশ্লেষিত হচ্ছে হাইড্রোজেন থেকে, এর নীচের স্তরে হিলিয়াম থেকেই তৈরি হচ্ছে কার্বন, তারপর সেখান থেকে অক্সিজেন। আরও ভিতরে সিলিকন, কেন্দ্রে সেই সিলিকন পরিণত হচ্ছে আয়রনে। আর এ সব কিছুরই নেপথ্যে 'নিউক্লিয়ার সংযোজন'! আয়রন সংশ্লেষিত হয়ে আর কোনও নতুন ভারী পরমাণুর জন্ম হয় না, কারণ এর জন্য যে পরিমাণ শক্তির দরকার সুপারজায়ান্ট নক্ষত্রদেরও তা নেই। ফলত মহাকর্ষের প্রচণ্ড টানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো আর কোনও শক্তিই যখন অবশিষ্ট থাকে না, তখনই কিছু রহস্যময় মজার ঘটনা ঘটতে শুরু করে।

তারাদের অন্দরে মহাকর্ষের চাপে ইলেকট্রন ও প্রোটনগুলো সংশ্লেষণের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয় নিউট্রনে, যারা আবার পারস্পরিক প্রবল চাপের কারণে নিষ্পেষিত হয়ে নিজেদেরকে ছোট্ট জায়গায় আবদ্ধ করে রাখে। ব্যাপারখানা এমন, বিশাল বড় একখান ধাতব লোহার তৈরি গ্রহকে চেপে যেন আমাদের কলকাতার মতো এক নগরে ভরে দেওয়া হয়েছে! তবে এই ঘটনা যে শুধু আয়রন কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ঘটে এমন নয়; আস্ত একটা নক্ষত্রকেই মহাকর্ষ কেন্দ্রের দিকে টেনে ধরে, যার বাইরের স্তরটি প্রায় আলোর বেগের চার ভাগের এক ভাগ বেগে কেন্দ্রের পানে ছুটে চলে। এবং এই প্রবল বেগে চলতে চলতে যখন আয়রনের কেন্দ্রের সঙ্গে ধাক্কা খায়, তখন তা বিপরীত প্রতি-ধাক্কার দরুণ প্রবল এক ‘শক’-তরঙ্গের জন্ম দেয়, যা কিনা তারার সর্বপেক্ষা বাইরের স্তরটিকে মহাশূন্যে নিক্ষেপ করে। এই বিরল আশ্চর্যজনক ঘটনার নাম ‘সুপারনোভা বিস্ফোরণ’, যা গোটা নক্ষত্রপুঞ্জ জুড়েই দেখতে পাওয়া যায়। নক্ষত্রের কেন্দ্রের এই অবশেষকেই বলে ‘নিউট্রন স্টার’ বা ‘নিউট্রন তারা’। প্রকৃতির সব থেকে ভারী ও ঘন পদার্থ দিয়ে ঠাসা এই তারার এক চা-চামচের ভর প্রায় এক বিলিয়ন টন!

নিউট্রন স্টার

যদি এই তারা আরেকটু ঘন হয়, তাহলে তা নিজেই পরিণত হবে এক ‘ব্ল্যাক হোলে’! এর মহাকর্ষিয় টান এত বেশি যে তাকে উপেক্ষা করে আলোরও পযর্ন্ত বেরিয়ে আসার জো নেই। সেজন্য এটি দৃশ্যমান নয়, তাই এর নাম 'ব্ল্যাক হোল' বা 'কৃষ্ণ গহ্বর'। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের’ দৌলতে সম্প্রতি ১২ মে বাস্তবে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে ‘Sagittarius-A’ নামক ব্ল্যাক-হোলের অস্তিত্ব ধরা পড়ে।

Sagittarius-A' ব্ল্যাক হোল

নিউট্রন তারার অভ্যন্তরীণ স্তরগুলো অনেকটা আমাদের পরিচিত গ্রহের মতো। তরল কেন্দ্রকের উপরে একটি শক্ত কঠিন আস্তরণ থাকে যেটি কিনা সুপারনোভার পর অবশিষ্ট আয়রন সহযোগে তৈরি, যারা আবার অভ্যন্তরীণ প্রবল চাপে কেলাসকার গঠন তৈরি করে। যতই ‘কোর’ তথা অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রকের নিকটে যাওয়া যায়, প্রোটনের সংখ্যা ততই কমতে থাকে, কারণ অধিকাংশই ততক্ষণে নিউট্রনে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কঠিন আস্তরণের অনেক ভিতরের স্তরে পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো মহাকর্ষের প্রবল চাপে পরস্পরের পাশাপাশি অবস্থান করে। এভাবে অগণিত সংখ্যক প্রোটন ও নিউট্রন (প্রায় কয়েক মিলিয়ন) মিলে বিরাট আকৃতির এক নিউক্লিয়াস গঠন করে, যা দেখতে অনেকটা স্প্যাগেটির মতো। পদার্থবিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে বলেন ‘নিউক্লিয়ার পাস্তা’ দশা। এই ‘নিউক্লিয়ার পাস্তা’ই এখনও পর্যন্ত মহাবিশ্বের সব থেকে কঠিনতম পদার্থ, যা ভাঙা একেবারেই অসম্ভব। এক ইঞ্চি উঁচু পাস্তাই হিমালয়ের চেয়ে ভারী হতে পারে। এর নীচেই নিউট্রন তারার কেন্দ্র। এত কল্পনাতীত উচ্চচাপে এই কেন্দ্রের বস্তুর অবস্থা কেমন হতে পারে, নিউক্লিয়ার জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানীরা সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন। প্রোটন ও নিউট্রন এখানে সম্ভবত কোয়ার্কের সাগরে বিলীন হয়ে যায়, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘কোয়ার্ক-গ্লুয়োন প্লাজমা’।

আরও পড়ুন- সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে ‘পদার্থ’? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া

নিউক্লিয়ার পাস্তা দশা

নিউট্রন তারাগুলি নিজের অক্ষকে কেন্দ্র করে প্রবলবেগে ঘুর্নায়মান থাকে। এই ঘূর্ণনের জন্যে একটা স্পন্দন তৈরি হয়, কারণ নিউট্রন তারার চুম্বকক্ষেত্র রেডিও তরঙ্গ তৈরি করে, যা কিনা আবার প্রতি ঘূর্ণনে ক্রমাগত বিকিরিত হতে থাকে, এরাই আসলে 'রেডিও পালসার'। ছায়াপথে এরকম হাজার দু’য়েক নিউট্রন তারার সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, যাদের চুম্বকক্ষেত্র আমাদের পৃথিবীর তুলনায় প্রায় কোয়াড্রিলিয়ন গুণ বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে। এই বিপুল চৌম্বক শক্তির প্রভাবে কোনও পরমাণু এর ধারে কাছে এলে বেঁকে যায়।

রেডিও পালসার

আবার এই মহাবিশ্বে আরেক ধরনের নিউট্রন তারা বিদ্যমান, যারা কিনা জোড়ায় জোড়ায় নিজেদের মধ্যে প্রবল বেগে ঘুরতে থাকে। এভাবে তারা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের দ্বারা শক্তি বিকিরণ করতে করতে স্থান-কালকে ক্রমান্বয়ে তরঙ্গায়িত করতে থাকে। ক্রমাগত তারা কাছাকাছি চলে আসে এবং অবশেষে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এইভাবে যে বিস্ফোরণটি হয় তাকে আমরা বলি 'কিলোনোভা'। এরকমই একজোড়া নিউট্রন তারার সংঘর্ষ থেকে ২০১৫ সালে লিগো অবজারভেটরিতে প্রথমবার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরা পড়ে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই বিস্ফোরণের সময়ে পদার্থ এতটাই চরম দশায় পৌঁছয় যে, তারা আরও ভারী পরমাণু গঠন করতে পারে। এরা কিন্তু নিউক্লিয়ার সংযোজন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট নয়, কেবল বিপুল পরিমাণ ছিটকে যাওয়া নিউট্রন পাদার্থের পুনর্বিন্যাস মাত্র। এইভাবেই জন্ম হয়েছে ইউরেনিয়াম, প্লাটিনামের মতো মহাবিশ্বের অধিকাংশ ভারী পরমাণুর! এরকম ভারী পরমাণুর জন্ম দিতে একটি ‘সুপারজায়ান্ট তারা’কে দু’বার মৃত্যুবরণ করতে হয়! এইভাবেই ‘সুপারনোভা’ ও ‘কিলোনোভা’ বিস্ফোরণে ‘নিউট্রন তারা’ থেকে ছিটকে বের হওয়া পদার্থগুলো বহু বছর ধরে নক্ষত্রপুঞ্জে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে, কোনও এক সময় মহাকর্ষের প্রভাবে জমাট বেঁধে মেঘের মতো একটা স্তর গঠন করে, যা থেকে আবার নতুন কোনও তারার সৃষ্টি হয়। এর চারিদিকে অনেকগুলি গ্রহও তৈরি হয় এবং সেগুলো আবার নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। আমাদের চারপাশের সৌরজগত এমন করেই তৈরি হয়েছে।

সুপারনোভা

 

কিলোনোভা

আমরা আমাদের চারপাশে যত ধরনের জটিল কিম্ভুতমার্কা মৌল দেখতে পাই, তার সবই সুদূর প্রাচীনকালে কোনও না কোনও নিউট্রন তারার মৃত্যুর সময়ে তৈরি। আমাদের দেহ যে পদার্থগুলোর সমন্বয়ে গঠিত, কোনও এক সময় তাও কোনও না কোনও তারাদের অংশ ছিল! ভাবা যায়?

 

 

ঋণ স্বীকার:

১. ছবি: সৌজন্যে 'নাসা'

২. বিশ্বজিবনী..ডঃ মনি ভৌমিক

৩. The first three minutes... Steven Wienberg

৪. Nuclear Astrophysics. A course of Lecture. Dr. Md. A. Khan

৫. বিভিন্ন তথ্যসূত্র.. আন্তর্জাল

More Articles