সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে 'পদার্থ'? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া
Anti Matter: বিগ-ব্যাংয়ের সময় সম পরিমাণ 'পদার্থ' ও 'প্রতিপদার্থ' উৎপন্ন হওয়ার কথা যারা কিনা একে অপরকে বিনাশ করে কেবল শক্তির জন্ম দেবে অর্থাৎ জগতে শুধু শক্তি থাকার কথা।
চারপাশে আমরা যা দেখি, বা আমাদের চারপাশটা যা দিয়ে গড়া তাই-ই ‘পদার্থ’। আর এদের সঙ্গে ‘বল’ ও ‘শক্তির’ কী রকম সম্পর্ক সেটারই পোশাকি নাম ‘পদার্থবিদ্যা’। আমাদের চারপাশের পরিচিত জগৎ অণু-পরমাণু দিয়ে গড়া, যা কিনা আবার ‘ইলেকট্রন’, ‘প্রোটন’ ও ‘নিউট্রনের’ সমন্বয়ে তৈরি। কিন্তু আজ থেকে প্রায় নয় দশকেরও আগে জগৎ বিখ্যাত পদার্থবিদ পল ডিরাক সর্ব প্রথম ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ইলেকট্রনের প্রতি কণার ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। এর ঠিক চার বছর পরে, এক তরুণ বিজ্ঞানী কার্ল এন্ডারসনের ক্লাউড চেম্বারে যার অস্তিত্ব ধরা পড়ে তার ভর, ইলেকট্রনের ভরের সমান, কিন্তু আধান বিপরীত। বিজ্ঞানীরা তার নাম দেন ‘পজিট্রন’।
ডিরাকের তত্ত্ব এত শীঘ্রই সাফল্যের মুখ দেখায়, কণা পদার্থবিদরা মেতে ওঠেন আরও অন্যান্য কণার প্রতিকণার সন্ধানে। এবং সেই কাজে নিমগ্ন থাকে বিজ্ঞানীদের দু’টি দল, যার একটির মাথায় ছিলেন এডওয়ার্ড লোফেগ্রীন ও অপরটির যৌথ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ এমিলিও সেগরি এবং চেম্বারলেন। এই দু’টি দল মুখ্যত নিয়োজিত ছিল প্রোটনের প্রতিকণার সন্ধানে। অবশেষে ১৯৫৫ সালে এই দ্বিতীয় দলটির গবেষণায় সন্ধান মেলে ত্রিশ জোড়া ‘অ্যান্টি প্রোটন’-এর। পরের বছরেই লরেন্সের ‘বার্কলে’ জাতীয় পরীক্ষাগারে, ব্রাস কর্কের তত্ত্ববাধানে হদিশ মেলে ‘অ্যান্টি নিউট্রনের’ও। আবারও ডিরাকের তত্ত্ব সাফল্য পায়, আর প্রোটনের ‘প্রতিকণা’ আবিষ্কারের মতো যুগান্তকারী কাজের জন্যে নোবেল কমিটি সেগরি ও চেম্বারলেনকে ১৯৫৯ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করে। অতএব, ইলেকট্রনের মতো প্রোটন ও নিউট্রনের দোসরের সন্ধান মিলল, যাদেরকে বিজ্ঞানীরা ডাকেন ‘অ্যান্টি প্রোটন’ ও ‘অ্যান্টি নিউট্রন’ নামে। তার মানে সব ‘প্রতিকণা’রই নামের শুরুতে একটা ‘অ্যান্টি’ আছে, কেবলমাত্র ইলেকট্রনেরই প্রতিকণা ‘পজিট্রন’।
‘প্রোটন’ আর একটি ‘পজিট্রন’ দিয়ে তৈরি হয় একটি ‘অ্যান্টি হাইড্রোজেন’। সুতরাং একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি তার সবকিছুরই একটি ‘অ্যান্টি’ থাকা সম্ভব, এবং পদার্থবিদরা কণাত্বরক যন্ত্রে সেই সব হরেকরকমের ‘প্রতি পদার্থ’ তৈরি করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। কণা পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের মূল উপাদান হলো ‘ইলেকট্রন’, ‘প্রোটন’ ও ‘নিউট্রন’। এরা আবার 'আপ', 'ডাউন', 'স্ট্রেঞ্জ', 'চার্ম', 'টপ', 'বটম' কোয়ার্ক নামক মৌলিক একক সহযোগে তৈরি। যেমন নিউট্রন তৈরি হয় একটি 'আপ' কোয়ার্ক ও দু’টি 'ডাউন' কোয়ার্ক দিয়ে যার পোশাকি নাম 'udd'। 'প্রোটন' তৈরি হয় দু’টি 'আপ' কোয়ার্ক ও একটি 'ডাউন' কোয়ার্ক সহযোগে, যাকে বিজ্ঞানীরা ডাকেন 'uud' নামে।
আরও পড়ুন- বিবর্তনের টাইমমেশিন আবিষ্কার! চিকিৎসায় নোবেলজয়ী প্যাবোর গবেষণা বদলে দেবে ইতিহাস
পদার্থ ও প্রতি পদার্থের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে যখন তারা পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তারা একে অপরকে বিনাশ করে শক্তির জন্ম দেয়। আইনস্টাইনের কালজয়ী সমীকরণ e=mc´2 অনুযায়ী সে শক্তির হিসেব আমরা সহজেই করতে পারি। অতএব সমস্ত সৃষ্টিই যেহেতু ‘কণা’ ও তাদের ‘প্রতিকণা’ দিয়ে তৈরি কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি জগতে আমরা যেরকম পদার্থ দেখব সেরকম প্রতি পদার্থও দেখতে পাব। কিন্তু এখানেই যত গোলমাল! কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের চেনা জগৎ পুরোটাই তৈরি হয়েছে পদার্থ দিয়ে, এখানে প্রতি পদার্থের কোনও প্রকাশ নেই বা হয়তো কোথাও লুকায়িত আছে যা দেখবার অবকাশ নেই। কারণ পদার্থের সংস্পর্শে এলেই তো আবার সে শক্তির জন্ম দেবে।
এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছিল বিগ-ব্যাং নামক মহা বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে কিন্তু ভর শক্তির সংরক্ষণ সুত্রানুসারে, বিগ-ব্যাংয়ের সময় সম পরিমাণ 'পদার্থ' ও 'প্রতিপদার্থ' উৎপন্ন হওয়ার কথা যারা কিনা একে অপরকে বিনাশ করে কেবল শক্তির জন্ম দেবে অর্থাৎ জগতে শুধু শক্তি থাকার কথা। এই গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি কিছুই থাকার কথা নয়, থাকার কথা শুধু শক্তির। কিন্তু আমাদের এই মহাবিশ্বে গ্রহ, নক্ষত্র সবই বিরাজমান। যেন কোনও এক অজানা কারণে, 'প্রতি পদার্থ', 'পদার্থের' কাছে হেরে গেছে, আর কিছু বাড়তি পদার্থ রয়ে গেছে আমাদের দৃশ্যমান জগতকে সাজানোর জন্য। কিন্তু এসবের সৃষ্টির কারণ এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে অধরা। এই পদার্থ ও তার দোসর ‘প্রতি পদার্থের’ পরিমাণগত বৈষম্য আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে এক রহস্যময় ধাঁধা। এই বৈষম্য যে উপায়ে তৈরি হয় তার পোশাকি নাম ‘বেরিওজেনেসিস’। প্রতিপদার্থের কণাগুলো সহজে তৈরি করা যায় না। একমাত্র কণাত্বরক যন্ত্র ও তেজস্ক্রিয় ভাঙ্গন থেকে একক প্রতিকণা তৈরি করা যায়। অনেক প্রচেষ্টার পরে, সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে অ্যান্টি-হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করতে পেরেছেন। এটাই এখনও পর্যন্ত তৈরি করা সব থেকে জটিল প্রতিকণা।
আরও পড়ুন- কোয়ান্টাম মেকানিক্সে সাড়া জাগানো এই আবিষ্কারই নোবেল এনে দিল তিন পদার্থবিজ্ঞানীকে
পদার্থবিদ্যার সঙ্গে কম-বেশি পরিচিত সকলেই 'LHC' বা লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের নাম শুনেছে, যা কিনা বিপুল অর্থ ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের সীমানা বরাবর ২৭ কিলোমিটার পরিধি জুড়ে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী, কোনও বস্তুর গতিবেগ, আলোর গতিবেগের খুব কাছাকাছি বা সমান হলে, তার ভর প্রায় অসীমে পৌঁছায়। সে জন্যে সে কখনই আলোর বেগে চলতে পারেনা, বড় জোর তার কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। এই যেমন 'LHC'-কণা ত্বরকের ভিতরে 'প্রোটন' ৯৯.৯৯৯৯৯৯ গুণ আলোর বেগ নিয়ে চলতে পারে, পুরোপুরি ১০০% কিন্তু নয়। এল.এইচ.সির এই বিপুল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা পদার্থবিদ্যার অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন।
পরিশেষে পদার্থবিদ্যার বহুদিনের একটি পর্যবেক্ষণের কথায় আসি। ধরি, একটি ‘ইলেকট্রন’ ও তার প্রতিকণা ‘পজিট্রন’ একে অপরের দিকে তেড়ে এসে যে কোনও মোড়ের মাথায় ধাক্কা খেয়ে শক্তি তৈরি করল, অপরদিকে একটি ইলেকট্রন আগের ঘটনার ইলেকট্রনের প্রারম্ভিক বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে মোড়ের মাথায় পৌঁছে সময়রেখার উল্টো দিক বরাবর যাত্রা শুরু করে 'পজিট্রনের' প্রারম্ভিক বিন্দুতে পৌঁছল। পদার্থবিদ্যার নিরিখে ঘটনা দু’টির ভেতরে কোনও ফারাক নেই। অর্থাৎ, 'প্রতি পদার্থ' হচ্ছে সময়ের উল্টোদিকে বহমান 'পদার্থ'। অনেকটা নেগেটিভ সংখ্যার মতো। একটা পজিটিভ সংখ্যা ও একটি নেগেটিভ সংখ্যা যোগ করলে যেমন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, ঠিক সেরকম পদার্থের সঙ্গে প্রতি-পদার্থ মিলিত হলে দুটোই অদৃশ্য হয়ে যায়! জন্ম দেয় শুধুই শক্তির। বিগ-ব্যাং তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতি পদার্থের গুরুত্ব অপরিসীম। অদূর ভবিষ্যতে এই প্রতি-পদার্থের অস্তিত্ব হয়তো অনেক অজানা কৌতূহলের দাঁড়ি টানবে।