ছোট ছোট অভ্যেস পাল্টে বর্জন করা সম্ভব প্লাস্টিক, জেনে নিন কীভাবে

‘International Plastic bag free day’-তে একবার চটপট দেখে নিই, কীভাবে ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ আমাদের প্লাস্টিকমুক্ত জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

১ জুলাই থেকেই ভারত সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী একক ব্যবহারের প্লাস্টিক উৎপাদন, আমদানি, মজুত, বিতরণ এবং বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিগত বছরের আগস্ট মাসের ১২ তারিখে ‘মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’ প্লাস্টিক দূষণ এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে আইনের কথা বলেছিল, সেই আইন অনুযায়ী চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে বন্ধ করা হয়েছে একক ব্যবহারের প্লাস্টিক।  

রাজ্যে আবার প্লাস্টিক ব্যবহারের ওপর জরিমানাও জারি করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কেবলমাত্র দোকানি নয়, এবার ক্রেতারাও নিস্তার পাবেন না এই জরিমানার হাত থেকে। বিগত বর্ষায় প্লাস্টিকের ব্যাগ হাওড়ার বিভিন্ন নালায় আটকে গিয়ে জলনিকাশি ব্যবস্থায় সমস্যার সৃষ্টি করে, যার কারণে বেশ কিছু ঘর-বাড়ি এবং দোকানেও বৃষ্টির জল ঢুকে যায়। তবে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ৭৫ মাইক্রনের কম প্লাস্টিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও, রাজ্যে ১২৫ মাইক্রনের কম প্লাস্টিকের ওপরেও জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।  

চলুন এবার এক নজরে দেখা নেওয়া যাক, একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বলতে ঠিক কোন জিনিসগুলো বোঝানো হয়েছে। নিষিদ্ধ আইটেমগুলির তালিকায় রয়েছে– এয়ারবাডস, প্লাস্টিকের পতাকা, থালা, গ্লাস, চামচ, ছুরি, ট্রে, স্ট্র, আইসক্রিম স্টিক, মিষ্টির বাক্সের চারপাশে মোড়ানো প্লাস্টিক, সিগারেটের প্যাকেট, বেলুনে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের কাঠি, ১০০ মাইক্রনের কমের পিভিসি ব্যানার।

আরও পড়ুন: প্লাস্টিক দূষণ কমাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আশ্চর্য আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের

এখন প্রশ্ন হলো, শুধুমাত্র আইনের চোখরাঙানিকে ভয় পেয়েই কি আমাদের প্লাস্টিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত? প্লাস্টিক ব্যবহার কীভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছে, তা বোধহয় কম-বেশি আমাদের সকলেই জানা। বিজ্ঞান বলছে, আমার-আপনার ব্যবহার করা একটি পলিথিন ব্যাগ প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে সময় নেয় প্রায় ১০০০ বছর এবং আমাদের ব্যবহার করা প্রায় ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক প্রতি বছর সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করে। সুতরাং, বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে প্রতিটা মানুষেরই প্লাস্টিক প্রত্যাখ্যান যে একপ্রকার নৈতিক কর্তব্যে পরিণত হওয়াটাই কাম্য- তা আর বলার অবকাশ রাখে না। তাই ‘International Plastic bag free day’-তে একবার চটপট দেখে নিই, কীভাবে ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ আমাদের প্লাস্টিকমুক্ত জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে, আমাদের ব্যবহারের একটি প্লাস্টিক ব্যাগ প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে সময় নেয় প্রায় হাজার বছর, তাই ৭৫ মাইক্রনের কিংবা তার বেশি প্লাস্টিক ব্যাগও ব্যবহার না করাই ভালো, পরিবর্তে কেনাকাটা করার সময় বাড়ি থেকেই নিজের ব্যাগ সঙ্গে করে নিয়ে যান। আবার মাছ কিংবা মাংস কিনতে গেলে সঙ্গে একটা বড় টিফিনবাক্স কিংবা ক্যান নিয়ে যেতে পারেন।  

অফিসে টিফিন নিয়ে যাওয়ার সময় ফ্যান্সি টিফিন বাক্সের পরিবর্তে পুরনো দিনের স্টিলের টিফিন বাক্সই হোক আপনার ভরসা। সম্ভব হলে, বাইরে থেকে অর্ডার করা খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো, কারণ আপনি যখনই কোনও খাবার অর্ডার করেন, তখন না চাইতেও রেস্তোরাঁগুলি একটি প্লাস্টিকের বাক্সেই আপনাকে খাবারগুলি পৌঁছে দেয়। নিতান্তই যদি বাইরের খাবারের ওপর আপনাকে ভরসা করতে হয় তবে, একটু কষ্ট করেই না হয় রেস্তোরাঁ কি‌ংবা দোকানে গিয়ে নিজের টিফিন বাক্সে খাবারটা নিয়ে আসুন। একইভাবে, যখন কোনও রেস্তোরাঁয় আপনি খেতে যাবেন, তখন সঙ্গে করে একটি পাত্র নিয়ে যেতে পারেন। অনেকসময়ই আমরা অর্ডার করা খাবার খেতে পারি না, তখন সেগুলো আমরা প্যাক করে বাড়ি নিয়ে আসি আর তখনই না চাইতেই খাবারের সঙ্গে জুড়ে যায় একটা প্লাস্টিকের কনটেনার।  

যে কোনও ধরনের ফ্রোজেন ফুড কেনা থেকে বিরত থাকুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফ্রোজেন ফুডগুলো প্লাস্টিকে মুড়েই বিক্রি হয়ে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে অনেক সময় মনে হয়, সেগুলো কার্ডবোর্ডে মোড়া, কিন্তু একটু খেয়াল করলেই আপনি বুঝতে পারবেন, কার্ডবোর্ডের নিচে পাতলা একটা প্লাস্টিকের আবরণ দেওয়া থাকে। এছাড়াও ফ্রোজেন ফুডের তুলনায় ফ্রেশ ফুড অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। 

সর্বোপরি সুপারমার্কেটকে একটু দূরে সরিয়ে রেখে বাজারে যাওয়ার অভ্যেস তৈরি করুন। এক জায়গায় আপনি হয়তো সবকিছু পাবেন না, খানিক ঘুরে ঘুরেই আপনাকে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি সঞ্চয় করতে হবে। কিন্তু বাজারে গেলে আপনি যেমন সতেজ শাকসবজি কিংবা ফল কিনতে সক্ষম হবেন, তেমনই অনেকাংশেই কমবে প্লাস্টিকের ব্যবহার।

প্যাকেটজাত দ্রব্যের পরিবর্তে খুচরো দ্রব্য কেনার অভ্যেস করুন। অর্থাৎ, রান্নার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন মশলা, শুকনো লঙ্কা, চিনি, ডাল ইত্যাদি বেশিরভাগ জিনিসগুলি বর্তমানে প্যাকেটে বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু আপনি যদি আপনার পছন্দের মশলার ব্র্যান্ডটাকে একটু এড়িয়ে চলে খুচরো মশলা কেনায় বেশি মনোযোগ দেন এবং দোকানির কাছ থেকে সরাসরি কৌটোয় করে মশলা নিয়ে আসেন, সেক্ষেত্রে প্রতি মাসে জনপিছু অনেক প্লাস্টিকের ব্যবহার কমে যাবে। 

আমাদের নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অনেককিছুই কিন্তু আমরা চাইলেই ঘরে তৈরি করে নিতে পারি, আমাদের মা-কাকিমারা কিছুটা সময় আগেও তাই করতেন। দই কিংবা পনির অথবা বিভিন্ন প্রকার আচার কিন্তু খুব সহজেই ঘরে বানানো যায়। আবার বাড়ির উঠোনে বিভিন্ন শাকসবজির চাষ করাও যে খুব কঠিন কাজ, তেমনটা একেবারেই নয়। এক্ষেত্রে দু'টি সুবিধাও রয়েছে। প্রথমত, খুব সামান্য জিনিসের জন্য আপনাকে কথায় কথায় বাজারে যেমন ছুটতে হবে না, তেমনই প্লাস্টিকের ব্যবহারও কমবে আপনার হাত ধরেই। 

সাজসজ্জার বিভিন্ন দ্রব্যেও আজকাল প্লাস্টিক স্থান কেড়েছে। এক্ষেত্রে হয়তো শ্যাম্পুর বোতল রিপ্লেস করা সত্যিই কঠিন, কিন্তু শাওয়ার জেল-এর পরিবর্তে আমরা খুব সহজেই সাবান ব্যবহার করতে পারি। আবার চাইলে ঘরোয়া পদ্ধতিতে শ্যাম্পু তৈরিও করা যায়, যা আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী চুলের জন্য উন্নত উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। এছাড়াও, প্লাস্টিকের চিরুনির বদলে কাঠের চিরুনি ব্যবহার করা যেতে পারে আবার বাঁশের টুথব্রাশ ব্যবহৃত হতে পারে প্লাস্টিকের টুথব্রাশের পরিবর্তে। 

এই ছোট ছোট বিষয়গুলো যদি আমরা জীবনে একটু মেনে চলি, তাহলে প্লাস্টিকের মতো আধুনিক দৈত্যের কবল থেকে সহজেই রেহাই পাওয়া সম্ভব। প্লাস্টিক ব্যবহার কমলে, পৃথিবীর ল্যান্ডফিল কমবে আর ল্যান্ডফিল কমলে পৃথিবীর তাপমাত্রা কিংবা অস্বাভাবিক জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে মুক্তি মিলবে আমাদের সকলের। তাই পৃথিবীর এই খারাপ সময়ে নিজেরাই বরং দায়িত্ব নিয়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার যতখানি সম্ভব কমানোর চেষ্টা করি।

 

More Articles