প্লাস্টিক দূষণ কমাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আশ্চর্য আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের
ব্যাকটেরিয়া থেকে পাওয়া যাওয়া এই এনজ়াইমগুলোর সাহায্যে প্লাস্টিক নিধনের কাজ বাস্তবায়িত হয়নি বিভিন্ন কারণে।
মেশিন লার্নিং এবং এ.আই-এর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা এবার এমন একটি এনজা়ইম বা উৎসেচক বানালেন, যার সাহায্যে বেশ কিছু ধরনের প্লাস্টিককে মাত্র সাতদিনে নষ্ট করা যাবে। 'ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস', অস্টিনের বিজ্ঞানীদের এই গবেষণা খুব সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নেচার জার্নালে।
ড. হ্যাল অ্যালপারের তত্ত্বাবধানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বানানো হাইড্রোলেজ় এনজা়ইম কেবল ঘরের সাধারণ তাপমাত্রাই নয়, পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অবধি কাজ করবে। সাধারণত পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির সেলসিয়াস তাপমাত্রার ওপরে যে কোনও উৎসেচক বা এনজা়ইম তার কার্যক্ষমতা হারায়।
হাইড্রোলেজ় হলো এমন একটি এনজা়ইম, যা জলের সাহায্যে কোনও যৌগের রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে ফেলে। ফলে, মূল যৌগটি ভেঙে গিয়ে, তার জটিল রাসায়নিক গঠন হারিয়ে কতগুলো সরল গঠনযুক্ত রাসায়নিক পদার্থে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন: মেন্থল সিগারেট নিষিদ্ধ করছে আমেরিকা, কারণ জানলে ঘুম ছুটবে ধূমপায়ীদের
বিজ্ঞানীরা পুনর্নিমিত হাইড্রোলেজ় এনজা়ইমটির নাম দিয়েছেন, FAST-PETase। আর সেই এনজা়ইমই PET বা পলি-ইথিলিন টেরেফথেলেটের পলিমারকে ভেঙে, তারই ছোট ছোট একক, অর্থাৎ মনোমারে পরিণত করবে- বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে ডিপলিমারাইজে়শন (Depolymerization)।
মূল প্লাস্টিক নষ্ট হওয়ার পর তৈরি হওয়া পদার্থকে পুনরায় অন্য কোনও পদার্থে পরিণত করা যাবে, বা অন্য কোনও জিনিস তৈরিতে কাজে লাগানো যাবে।
খুব স্পষ্ট কথায় বললে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং মেশিন লার্নিং-এর সাহায্যে তৈরি এই হাইড্রোলেজ় এনজা়ইম বা FAST-PETase প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেলের পদ্ধতিকে আরও অনেক বেশি সহজসাধ্য এবং বাস্তবে প্রয়োগের উপযুক্ত করে তুলল। এযাবৎ প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার ও পুনর্নবীকরণ করে সার্কুলার কার্বন ইকোনমি বজায় রাখা কেবল তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব ছিল।
সার্কুলার কার্বন ইকোনমির মূল মন্ত্র হল কার্বনের ব্যবহার ও বাতাসে কার্বনের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা। আর তার জন্য চারটি বিষয় অবলম্বন করতে হয়: কার্বন-জাত দ্রব্যের ব্যবহার কমানো (Reduction), কার্বন-জাত দ্রব্যের পুনঃর্ব্যবহার (Reuse) ও পুনর্নবীকরণ (Recycle) এবং তাদের অপসরণ (Remove) করা।
পৃথিবীর মোট বারো শতাংশ প্লাস্টিকের আবর্জনার অন্যতম উপাদান PET বা পলি-ইথিলিন টেরেফথেলেট। জলের বোতল, সাধারণ বোতল, সোডার বোতল থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের ট্রে, এই সবেরই মুখ্য উপাদান PET।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে পুনর্নিমিত হাইড্রোলেজ় এনজা়ইম বা FAST-PETase-এর সাহায্যে এবার প্লাস্টিকের সার্কুলার কার্বন ইকোনমি বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে, বিশাল পরিমাণ প্লাস্টিককে মাস স্কেলে বা বিপুল হারে পুনর্নবীকরণ করা।
ড. অ্যাল্পার ফোর্বস ম্যাগাজি়নকে জানিয়েছেন, বর্তমানের আবর্জনা নিয়ন্ত্রণ শিল্পের বাইরেও, নতুন এই এনজা়ইম বিভিন্ন ধরনের শিল্পকে নিজেদের বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের আবর্জনাকে রিসাইকেল বা পুনর্নবীকরণের সুযোগ দেবে। এবং পুনর্নবীকরণের অত্যাধুনিক এই পদ্ধতির বাস্তবে প্রয়োগের অনেক বেশি সুযোগও ছোট থেকে বড় শিল্পগুলো পাবে।
হাইড্রোলেজ়় আমাদের শরীরে একাধিক জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যে কোনও এনজা়ইমের মতো হাইড্রোলেজও তার সর্বোচ্চ কর্মক্ষমতা দেখায় নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও পিএইচের পরিসীমার মধ্যে। সেই পরিসীমার থেকে একটু এদিক-ওদিক হলেই যে কোনও এনজা়ইম তার কার্যক্ষমতা হারায়। হাইড্রোলেজ় ইনজাইমের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয় না।
ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এযাবৎ যতবারই হাইড্রোলেজ়় এনজা়ইম প্রয়োগ করে প্লাস্টিককে ভেঙে সরল অণুতে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে, ততবারই হাইড্রোলেজ় তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে, প্লাস্টিককে ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে।
অন্যদিকে যখনই কৃত্রিম পরিবেশে উপযুক্ত তাপমাত্রা ও পিএইচ বজায় রেখে হাইড্রোলেজ এনজা়ইমের সাহায্যে PET-কে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই বিক্রিয়া কিন্তু সফল হয়েছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বানানো হাইড্রোলেজ় এনজা়ইম বা FAST-PETase-এর, FAST শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই এনজা়ইমটির সমস্ত গুণাবলি; FAST অর্থাৎ Functional (F) বা কার্যকরী, Active (A) বা সক্রিয়, Stable (S) বা স্থিতিশীল, Tolerent (T) বা সহনশীল। এনজা়ইমটি যাতে উচ্চ তাপমাত্রা এবং বিস্তৃত একটি পরিসরের মধ্যে কাজ করতে পারে, তাই মূল এনজা়ইমটির বেশ কিছু অংশে মিউটেশন বা রাসায়নিক পরিবর্তন এনেছেন গবেষকরা। আর তাতেই পুনর্নির্মিত হাইড্রোলেজ় এনজা়ইমটি, গতানুগতিক হাইড্রোলেজ় এনজা়ইমের থেকে হয়ে উঠেছে অনেক আলাদা।
প্রতি বছর প্রায় চারশো মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পৃথিবীর বুকে জমা হয়। তার মাত্র ১০ শতাংশ প্লাস্টিকের আবর্জনা পুনর্ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের আবর্জনা আমরা যে তৈরি করেছি; যে আবর্জনা মাটি, জল, বাতাস এমনকী, আমাদের রক্তকে বিষিয়েছে, সেই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের আবর্জনাকে কৃত্রিম পরিবেশে নিধন করা অসম্ভব। আর তাই দরকার হয়ে পড়েছিল একটি বিকল্পের।
ড: অ্যালপারের মতে আমরা যখন পরিবেশকে আবর্জনামুক্ত করার কথা ভাবব, তখন আমাদের এমনই এনজা়ইম ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া উচিত, যা পরিবেশের সাধারণ তাপমাত্রাতেও সমানভাবে কার্যকর থাকে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে এই উৎসেচকটি প্লাস্টিকের আবর্জনাপূর্ণ জায়গায় প্রয়োগ করে, প্লাস্টিককে বাস্তবেই সাতদিনে নষ্ট করা যাবে এবার। নতুন পদ্ধতিতে তৈরি এই এনজা়ইমটি রঙবিহীন প্লাস্টিকের পাশাপাশি, রঙিন প্লাস্টিককেও ভাঙতে পারে।
এর আগে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন ব্যকটেরিয়া থেকে পাওয়া এনজা়ইম বা উৎসেচকের সাহায্যে পলি-ইথিলিন, পলিস্টাইরিন, পলিপ্রোপিলিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসি, পলিথিলিন টেট্রাফথ্যালেটকে ল্যাবরেটরির কৃত্রিম পরিবেশে নষ্ট করা যায়। প্লাস্টিক নির্মাণের জন্য মূলত এই উপাদানগুলোকেই ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু ব্যাকটেরিয়া থেকে পাওয়া যাওয়া এই এনজ়াইমগুলোর সাহায্যে প্লাস্টিক নিধনের কাজ বাস্তবায়িত হয়নি বিভিন্ন কারণে। তার মধ্যে অন্যতম কারণ, এনজ়াইমগুলোর নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও পিএইচের বাইরে কাজ করতে না পারা। পূর্বের গবেষণাগুলো বাস্তবায়িত না করা গেলেও, তারা ভবিষ্যতের প্লাস্টিক-নিধন সম্পর্কিত গবেষণাকে পথ দেখিয়ে গিয়েছিল নিঃসন্দেহে।
বহু দিন পথ চেয়ে থাকার পর, অবশেষে মেশিন লার্নিং এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে হাতিয়ার করে অবশেষে বাস্তবায়িত হতে চলেছে পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ।