উপকথার রাশিয়া আর কিছু নষ্ট গল্প

সে ছিল শীতের সময়;  মধ্য ডিসেম্বরের এক শান্ত বিকেলে মস্কোয় পা পাতলাম। আমাকে নিতে কেউ আসেনি এয়ারপোর্টে। শুধু একটা গাড়ি পাঠিয়েছিল আয়োজকেরা। চালক শুধুমাত্র জানে যে আমাকে কোথায় পৌঁছে দিতে হবে। শুধুমাত্রএইটুকুই সে জানে। সে নিয়ে যাচ্ছে সে দেশের সংস্কৃতি দপ্তরের একটি কার্যালয়ে। এই  পর্যন্তই। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে একটি চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য। সেখানে আমার গোটা পাঁচেক ছবি নিয়ে একটা রেট্রোস্পেকটি হবে, যার আয়োজক  ছিল রাশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর কালচারাল রিসার্চ আর তত্ত্বাবধানে রাশিয়ান সংস্কৃতি মন্ত্রক। সে সব অন্য কথা।

চোখ ভরে আমি তখন গিলে খাচ্ছি, মেলাচ্ছি, ধাক্কা খাচ্ছি। আমার কৈশোরে সেই যে রূপকথারা স্ব-ভাষায়  অনুদিত হয়ে শিরা ধমনীর ধারায়,  তার সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছি। একটা পলেমিকাল ডিসকোর্সের মধ্যে ঢুকে পড়ছিলাম, একাই। একদিকে এই অধম আর তার সময়, অন্য দিকে আমার পাঠ্য-অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা। সে কথাও এ লেখায় কখনোসখনো উত্থাপিত হবে হয়তো। আপাতত ফিরে যাই পুরনো কথায়।

আলেক্সে অর্থাৎ সেই সরকারি সারথির সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এয়ারপোর্ট থেকে আমার গন্তব্যে যেতে কতক্ষণ লাগবে? তার উত্তর ছিল তিন ঘন্টা,  চার ঘন্টা, পাঁচ ঘন্টা ছয় ঘণ্টা এমনকী সাত ঘণ্টাও লাগতে পারে। অর্থাৎ ট্রাফিক জ্যামের ওপর সবটাই নির্ভর করবে। বুঝলাম এদেশের ব্যাপার স্যাপার খুবই গম্ভীর! প্রকৃতপক্ষে সেবার  পৌঁছাতে লেগেছিল ঘড়ি ধরে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। ট্র্যাফিকের অবস্থা মর্মান্তিক। অসংখ্য গাড়ি আর গাড়ি। পরবর্তীতে জেনেছিলাম মস্কোর প্রান্তে যারা থাকে তারা কেউ গাড়ি নিয়ে মূল মস্কো শহরে ভুলেও যায় না।

অথচ আমার ধারণা ছিল ভিন্ন। শুনেছিলাম মস্কোতে একটি সর্বাঙ্গীণ পরিবহণের সুব্যবস্থা রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে চারটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, নয়টি প্রান্তিক রেলস্টেশন, একটি বিস্তৃত ট্রামলাইন, আছে একটি মনোরেল। এবং সর্বোপোরি মস্কো নগরীতে পাতালরেল  হলো পৃথিবীর বৃহত্তম গণপরিবহণ ব্যবস্থা।  যান-পরিষেবা ও ব্যস্ততাতেও এক নম্বর। সে আমি নিজেই উপলব্ধি করেছি। আর হ্যাঁ,  মস্কো শহরের চল্লিশ ভাগ এলাকাই সবুজ বৃক্ষরাজির ছায়ায় ছায়ায় আবৃত। এই কারণে মস্কো হলো সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে সবুজ নগরীগুলির একটি। এখানে আর একটা কথা লিখে রাখি যে, মস্কো হলো অবিশ্বে অন্যতম ব্যয়বহুল শহর।

শহরের কথায় পরে আসছি। তার আগে একটু গ্রাম-মফস্সলে ঘুরে আসি। সে এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। একরের পর একর জমি ধূ ধূ পড়ে
আছে। কোথাও কোনো চাষবাসের চিহ্নমাত্র নেই। কোথায় গেল যৌথ খামারের গৌরবময় স্বপ্নচিহ্ন? কোথায় সেই রাশান কৃষকের মহিমান্বিত জীবন?রাশিয়ার যাবতীয় খাদ্যখাবার আমদানি হয় নানা দেশ থেকে। আনতেই হয়। কেননা তেল আর গ্যাস খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না! চাল-ডাল-তেল-চিনি-নুন সবই বিদেশ থেকে আসে। শাকসবজি থেকে মাছ মাংস ভায়া ডিম - সব ক্ষেত্রেই রয়েছে বৈদেশিক নির্ভরশীলতা।

প্রকৃতপক্ষে গ্রামগুলো কেমন অসাড়, মানবশূন্য প্রায়। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে গেলে চোখে পড়ে কিছু বয়স্ক মানুষ। তাদের দেখা মেলে গির্জার উপাসনার দিনগুলিতেই শুধু। কেমন একটা শ্মশানের নীরবতা। সামান্য সংখ্যক বখাটে ছেলেছোকরার দেখা মিলেছে। তারা মূলত নেশাভাঙের দিলদরিয়ায় ভেসে যাচ্ছে।

যে কোনো দেশের এই অবস্থা সত্যি দুঃখজনক। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় কৃষি ব্যবস্থা কেন ভেঙে গেল , কেন তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্র বেপরোয়া হলো তার বিশ্লেষণ করা আমার কর্ম নয়। তারজন্য সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনীতির গবেষকরা আছেন। আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত বিস্ময়টুকু প্রকাশ করলাম। আমার সেখানে গিয়ে মনে হচ্ছিল যে , হ্যাঁ,  সেভাবে কোনো বুভুক্ষু মানুষ হয়তো দেখিনি, মানুষ যে এরপরও বহাল তবিয়তে আছে তা ঠিক। কিন্তু এই গ্রামীন মানুষগুলো গ্রাম ছেড়ে গেল কোথায়?

সেই প্রশ্ন খুঁজেছি যখন মস্কো শহরে বেশ কটা দিন কাটিয়ে ছিলাম। বুঝলাম, গ্রামের মানুষ আসলে শহরমুখী। তারা শহরে গিয়ে বাসা বাঁধছে অধিক রোজগারের জন্য। কৃষক ঘরের ছেলেমেয়ে বা প্রকৃতই কৃষকেরা শহরে এসে রাস্তা মেরামত থেকে নানা কন্সট্রাকশনের কাজে যুক্ত হচ্ছে। একেকটা ঢাউস ঘরে চল্লিশ- পঞ্চাশ জন ভাড়া নিয়ে থাকছে ভয়ঙ্কর অবস্থায়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা একই গ্রামের লোক।শুধুমাত্র অধিক রোজগারের কারনে এরা কি সবাই শ্রমিকের জীবন বেছে নিচ্ছে! না, বরং সস্তা রোজগারের গলিঘুঁজি খুঁজে নিচ্ছে। যে যেমন পারছে। সেক্ষেত্রে কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই।

যখন প্রথম রাশিয়ায় যাই, তখন যাবো শুনে বন্ধু চিত্রকর হিরণ মিত্র এক আড্ডায় আমাকে সতর্ক করেছিলেন যে সন্ধ্যার পর যেন একা শহরে না ঘুরে বেড়াই। সে সাবধানবাণীর যৌক্তিকতা টের পেলাম মস্কো শহরে পৌঁছে।

আমি চিরকালই অকুতোভয়। ফলে গুরুজনের উপদেশ অবজ্ঞা করে সন্ধ্যাকালীন ইতিউতি ঘুরে বেড়াতাম। পুরো মস্কো শহরে রাস্তার মোড়ে, রেস্তরাঁর সামনে, মল বা থিয়েটার হলের ফয়ারে দাঁড়িয়ে আছে মহিলারা। এদের অধিকাংশেরই সঙ্গে আছে ব্যয়বহুল গাড়ি। বয়স ষোলো থেকে পঞ্চাশ যা কিছুই হতে পারে। প্রত্যেকের সুতীক্ষ্ণ চোখ, সবাই বিদেশি খুঁজছে। এদের প্রয়োজন ডলার , পাউন্ড আর ইউরো। এরা অসম্ভব আগ্রাসী। সটান চলে আসছে বিদেশি দেখলেই। এইচআইভি মুক্ত বলে কাগজ দেখাচ্ছে। আমারও এমন এক আধটা অভিজ্ঞতা যে হয়নি তা নয়। ভঙ্গিটা প্রায় হামলে
পড়া, বাধ্য করার চেষ্টা। এদের দেখলেই চেনা যায়। সারাক্ষণ দামী দামী মোফোন নিয়ে কথা বলছে নয়তো ছোটো ছোটো দর্পণে প্রসাধনী মেখে চলেছে।

লিখতেই হচ্ছে যে, পুরো শহরটাতেই যেন সন্ধ্যা হলে গণিকাদের হাট বসে। লেনিন থেকে ক্লারা জেটকিনের সেই সব সুচিন্তিত বক্তব্য, লেখালেখি পরিকল্পনা ও কার্যপ্রণালী আজ রাশানদের কাছে ঢঙের ঢেকুরে পর্যবসিত  হয়েছে। সময়ের তালে, নষ্ট হাওয়ায় কতো কী যে উড়ে যায়, মুছে যায়!
সে যাক, কী বা করা যাবে। আসলে এ সমস্তই দেখছিলাম আর কৈশোরের স্মৃতি উদ্বেলিত পাড়ায় পাড়ায়, দেওয়ালে দেওয়ালে, আলোচনা-আড্ডার সেই সব না-বোঝা শব্দগুলো ফিসফিসিয়ে উঠছিল- "সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ"। আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে তার কি কোন সংযোগ আছে? হবেও বা!

সেবারের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লিখে আপাতত শেষ করবো। আগেই বলেছি মস্কো নগরী অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তো সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য খাবারের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, যেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল তার কাছেই ছিল ঐতিহাসিক ভিকট্রি স্ট্যান্ড আর সেখানেই একটি রেস্তরাঁয় সস্তায় খিচুড়ি পাওয়া যায়। গিয়ে দেখলাম, ছিমছাম একটি সাজানো  বাংলাদেশী জয়েন্ট। আধুনিক ও জমজমাট। এখানে সেখানে কিছু মহিলা, ঘুরঘুর করছে।
শরীরী ভাষায় ক্রেতা আমন্ত্রণের নিবেদন আছে ভরপুর।ঢুকেই একটা কফির অর্ডার দিয়ে পরিবেশের সাথে পরিচিত হতে চেষ্টা করতে থাকলাম। চোখে পড়লো এক যুবতী বেশ ছল্লিবল্লি ভাব নিয়ে এ টেবিল থেকে সে টেবিল ছুটে বেড়াচ্ছে। সে যেন কমবেশি অনেককেই চেনে। মানে নিয়মিত আসে সেখানে। খেয়াল করলাম মাঝেমধ্যেই আমার দিকে তাকাচ্ছ। কয়েকবার চোখাচোখিও হলো। এরপর অপ্রত্যাশিত ভাবে মেয়েটি আমার টেবিলে কাছে এসে ভাঙা ইংরেজিতে বলে যে, সে বসতে পারে কিনা। আমি ইংরেজি কায়দায় আর বাঙালি সৌজন্যের খাতিরে তাকে বসতে বলি। বসেই আমি কিছু বলার আগে কফি খেতে চায়। অর্ডার করি। তারপর যথারীতি মামুলি কথা দিয়ে শুরু হয়। কোন দেশের লোক, কী করি (পেশা), এখানে কোথায় থাকি ইত্যাদি প্রভৃতি। বেশি সময় নেয় না সে। বলে, আমি তার সঙ্গে রাত্রি বাস করতে চাই কিনা এবং তার জন্য একশো রুবল দিলেই হবে।বললাম,  এই তো বেশ কথা হচ্ছে । খানিক পরিচিত হতে মন্দ লাগছে না। তবে আমার যে অতো টাকা নেই! সে তখন নাছোড়। একশো রুবল থেকে পঞ্চাশে পৌঁছেছে।

ইতিমধ্যে তার নাম জেনে গিয়েছি। স্লাভায়ান দরিদ্র পরিবারের মেয়ে (তার কথায়)। সে বলতে থাকে তার দারিদ্রের দিন গুজরানের দিনলিপির। মস্কো থেকে অনেকটাই দূরে থাকে সে। বিদেশে যেতে চায় রোজগার করতে। তাই ইংরেজির একটা ক্র্যাশ কোর্স করছে। তার পেশায় কাজে লাগবে। স্লাভায়ান বলে , আজ তার পক্ষে বাড়ি ফেরা কঠিন, রাত বাড়ছে। ফলে আমি যদি তাকে কুড়ি রুবল অন্তত দিই। বললাম, আমন্ত্রিত সফরে এসেছি, আমি ট্যুরিস্ট নই। ফলে আমার কাছে ওই টাকাটাও নেই। দর নামছে ক্রমশ। অবশেষে বলে, তাহলে একটা ভদকা খাওয়াও। বাইরে বেশ ঠান্ডা। এতে আমি রাজি হয়ে গেলাম আরেকটু জানকারির জন্য। একটা ভদকা অর্ডার করলাম। সুন্দরী মহিলা,  কথা বলতে ভালোই লাগছিল। ভদকা আসতেই এক নিমেষে পুরোটা খেয়েই উঠে দাঁড়ায় এবং বিদায় নিয়ে চলে যায়। আমি আমার রাতের খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা খেতে খেতে ভাবতে থাকি স্লাভায়ানের দুর্দশার কথা, রাশান সমাজের ভেঙে পড়া মূল্যবোধের কথা। খাওয়া শেষ করে সেই অতিথি নিবাসের রাস্তা ধরি। হঠাৎ খেয়াল করি পার্কিং লট থেকে ঝাঁ চকচকে একটা গাড়ি চালিয়ে স্লাভায়ান ঝড়ের গতিতে বেড়িয়ে গেল।

আমি তো অবাক! তবে যে এতো দারিদ্র্রের কথা শোনালো!

রাত তখন আরো গাঢ় হচ্ছে।

More Articles