লেপচারা অনেক আগেই 'গীতবিতান' অনুবাদ করে ফেলেছে

ঠিক এই সময়টায় আরেকটি বড়সড় প্রতিরোধ  সংগঠিত হচ্ছিল তিস্তার ওপর সতেরোটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের প্রতিবাদে। নতুন প্রজন্ম সেই সময় লাগাতার অনশন করেছে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বন্ধু তথ্যচিত্রকার দাওয়া লেপচা প্রায় একশো দিন অন...

সেই সময় পাহাড় বেশ উত্তপ্ত। লেপচা জনগোষ্ঠী তাদের নানাবিধ দাবিদাওয়া নিয়ে তখন আন্দোলনে মুখর। দার্জিলিং জেলার নানা অঞ্চল থেকে শুরু করে, সুদূর সিকিমের জঙ্গু থেকে শুরু করে, ওদিকে নেপাল অবধি ছড়িয়ে আছে এই লেপচা জনগোষ্ঠী। এদের জীবনযাত্রা, এদের সংস্কৃতি, এদের ইতিহাস, এদের ভাষা ইত্যাদি বিষয়াদি নিয়ে পাঁচটা তথ্যচিত্র করেছিলাম। সেই কারণেই এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছুটে বেড়াতে হচ্ছিল, জানতে হচ্ছিল, মিশতে হচ্ছিল। আমার সঙ্গে যে গবেষকরা ছিলেন, তাঁরাও অত্যন্ত দঢ় ও মেধাবী। কিন্তু আমার জানা আমার ছবি সরেজমিনে...  বই তার চালিকাশক্তি।

তো সেই রাজনৈতিক গরমাগরম পরিস্থিতিতেই আমার সঙ্গে আলাপ হয় লেপচা নেতা তামসাং-এর। তিনি তখন লেপচা সংগঠনের সভাপতি। অত্যন্ত প্রো-অ্যক্টিভ নেতা। একসময় ব্রিটিশ আর্মিতে কাজ করেছেন। স্পষ্ট উচ্চারণে ইংরেজি ও হিন্দি বলতে পারেন এবং হ্যাঁ,  ভাল কথা বলতে পারেন। খুব সুন্দর যুক্তি দিয়ে লেপচাদের দাবিদাওয়া নিয়ে বলতে পারেন। ভেতরে ভেতরে রাগের একটা ভদ্রজনোচিত প্রকাশও রাখেন তাঁর নিজস্ব বাচনভঙ্গিতে। তিনিই ছিলেন আমার লেপচা জনজীবন সম্পর্কে জানা-বোঝা-পড়ার প্রথম মাস্টারমশাই। তামসাং আমার ঘনঘন সিগারেট খাওয়া দেখে বলেছিলেন ধূমপান কিন্তু লেপচাদের ক্ষেত্রে ট্যাবু। লেপচাদের নিয়ে কাজ করতে এসেছ তো? তাই সাবধান।


ঠিক এই সময়টায় আরেকটি বড়সড় প্রতিরোধ  সংগঠিত হচ্ছিল তিস্তার ওপর সতেরোটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের প্রতিবাদে। নতুন প্রজন্ম সেই সময় লাগাতার অনশন করেছে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বন্ধু তথ্যচিত্রকার দাওয়া লেপচা প্রায় একশো দিন অনশনে ছিল। ফলে আমার জন্য একটা ক্ষেত্র তৈরিই হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি কাজের মধ্যে লেপচাদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েও একটি তথ্যচিত্র নিজেদের পকেটের পয়সা দিয়ে করেছি। তার কারণ, সম্ভবত লেপচাদের দিনের পর দিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া। আসলে সে লড়াইয়ের জোর ছিল। মানুষের জোর। যৌথতার জোর।


আরও পড়ুন: জীবনপুরের পথিক… ঘর ছেড়ে ভবঘুরে হওয়ার নিয়মকানুন


এমনিতে লেপচারা যোদ্ধা ও কর্মী। নগরায়নের গ্রাস গতি বাড়ালেও এখনও লেপচাদের নিজস্ব তৈরি করা বাড়িগুলো পাহাড়ের আনাচেকানাচে, পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। অসাধারণ দেখতে সেই কাঠের বাড়ি। কী শক্তপোক্ত! অথচ একটাও পেরেক ব্যবহার করা হয়নি। হ্যাঁ, লোহার পেরেকও লেপচাদের ক্ষেত্রে ট্যাবু।


এই তামসাং-এর এক কাকা হলেন সোনম লেপচা। ইনি একজন চমৎকার লেপচা মিউজিসিয়ান। গীতিকার, সুরকার। পদ্মশ্রী-সহ দেশের অন্য আরও বড় বড় পুরস্কার পেয়েছেন। সোনম অত্যন্ত বিনয়ী ও সহজ মানুষ ও শিল্পী। তিনি নানা ধরনের তারযন্ত্র, ফুযন্ত্র ও তালবাদ্য বাজাতে পারতেন। কালিম্পং-এর অনতিদূরে সোনম নিজের উদ্যোগে তার বাড়ির পাশে একটি লেপচা মিউজিয়াম নির্মাণ করিছেন। লেপচারা অনেক উন্নত সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় দশকের পর দশক ধরে এগিয়ে চলেছে। মনে রাখতে হবে, লেপচারা অনেক আগেই 'গীতবিতান' অনুবাদ করে ফেলেছে। তামসাং দুঃখ করে বলেছিলেন, "কোনও পলিটিক্যাল পার্টি স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের জন্য ভাবেনি। আমরা জীবনযাপনের আধিকার চেয়েছি, আমরা মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার চেয়েছি, অরণ্যের অধিকার চেয়েছি, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা করেছি। আমরা টাকা চাইনি, ভিক্ষা চাইনি।" ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, লেপচা বোর্ডে গঠন ওদেরই স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনের ফলশ্রুতি।


প্রায় সাড়ে তিন বছর লাগাতার লেপচাদের সঙ্গে নানা সময় থেকেছি। ওদের দিনযাপনের সাক্ষী থেকেছি। ওদের সরল মনের কথা শুনেছি। ওদের বীরত্বের কাহিনি আর লোককথা শুনেছি। তা লিপিবদ্ধ করতে গেলে একটা বড় বই হয়ে যাবে। সে নাহয় পরে দেখা যাবে। আপাতত একটি খণ্ড আবিষ্কার তথা যাত্রার বর্ণনা দিয়ে শেষ করি।


কালিম্পং থেকে রিশপ যেতে পথের কোণে লুকিয়ে আছে ছোট গঞ্জ। এই গঞ্জ বুধুবারে, অর্থাৎ এখানে হাট বসে বুধবারে। এখান থেকে পাহাড়ের ওপরে চড়াই ভাঙা পাহাড়ি পায়ে চলা রাস্তা উঠে গেছে। আশে পাশে এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোট ছোট গ্রাম। প্রায় দেড় ঘন্টা ক্যামেরা ও অন্যান্য লটবহর নিয়ে চড়াই উঠে পৌঁছলাম পাহাড়ের মাথায় পোচক গ্রামে। গোটা অঞ্চলটাই লেপচা জনজাতির বসতি।


গ্রামটি ছোটই, শতখানেক মানুষ আছে কি নেই। কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় আছে একটি একতলা প্রাইমারি ইশকুল, বড় বড় দু'টি ঘর, চওড়া বারান্দা।


এখানে লেপচাদের নিজেদের সংগঠনের দ্বারা প্রথম শুরু হয় এই নৈশ ইশকুল। এখন উন্নয়ন পরিষদের যুবকরা চালান এই নৈশ বিদ্যালয়, দিনের বেলা সরকরি স্কুল চলে। সরকারি স্কুলের হেডমাস্টারমশাই, বছর আঠাশের টগবগে লেপচা তরুণ এই রাতের ইশকুলটিরও দায়িত্বে। এই ইশকুলের কর্মকাণ্ড দেখতে ও ছবি তুলতে সেখানে যাওয়া। প্রথমেই কথা উঠল কেন এই সান্ধ্য ইশকুল? এই জঙ্গল-অধ্যুষিত চড়াই পথ বেয়ে, চারদিকের গ্রাম থেকে নানা বয়সের ছাত্ররা, প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারি, কীসের জন্য আসছে এখানে, তাও আবার সারাদিন সরকারি স্কুলে পড়ার পরে? ইশকুলের তরুণ-তরুণী শিক্ষকরা জানালেন, সরকারি স্কুলে পড়া হয় বাংলা বা হিন্দি মাধ্যমে, শেখানো হয় হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলা ভাষা। তাহলে লেপচা ছেলেমেয়েরা লেপচা ভাষা শিখবে কী করে? কী করে জানবে লেপচা জাতির সংস্কৃতি, তার ইতিহাস, তার জীবনযাপনের বিশিষ্টতা?


লেপচা জাতির ইতিহাস অনুযায়ী সিকিম ও দার্জিলিং অঞ্চলের আদিমতম অধিবাসী তারা। কাঞ্চনজঙ্ঘা আর তিস্তা তাদের পূজনীয়। এদের ছায়ায়, মায়ায় তারা এখানে বসবাস করেছে বহু যুগ ধরে। গড়ে উঠেছে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, জীবনযাপন, যা তার আইডেন্টিটি। সেই আইডেন্টিটি আজ মূলধারার ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসনের মুখে বিপন্ন, বিশেষত হিন্দি ভাষা ও বলিউডি আগ্রাসন ঠেকিয়ে নিজেদের আইডেন্টিটি বাঁচিয়ে রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে রয়েছে গোর্খা জাতি ও ভাষাভিত্তিক আগ্রাসন। যার ফলে বেড়েছে হিন্দি চাপানোর আগ্রাসী মনোভাব।


এই চ্যালেঞ্জটাই নিয়েছেন এই তরুণরা। চালু করেছেন সন্ধেবেলার ইশকুল। স্কুল শুরু হয় লেপচা গান দিয়ে। ছোটরা লেপচা বর্ণমালা পড়তে ও লিখতে শেখে। বড়দের জন্য চলে ভাষাশিক্ষার ক্লাস। এর পাশাপাশি শেখানো হয় জীবনযাপনের নানা কৌশল, যা ঐতিহ্যবাহী। চিনতে শেখানো হয় নানা ঔষধি গাছগাছড়া, শেখানো হয় তার নানা গুণাগুণ। লেপচারা বাস করে পাহাড়ের উঁচুতে, বনে ঘেরা তাদের গ্রামগুলো। অন্তত সেটাই তাদের পছন্দ। তাই তাদের প্রবাদে বলে, যতদিন পাহাড় আছে, বন আছে, লেপচাকে কেউ মারতে পারবে না। প্রয়োজনে খাদ্য থেকে ওষুধ- সবই তারা সংগ্রহ করে নিতে পারে বন থেকে। সেসব কৌশল বা স্কিল তো অবশ্য শিক্ষণীয়। এছাড়া তারা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পালনীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানের নিয়মকানুন জেনে নেয় শিক্ষকের কাছ থেকে। শেখানো হয় ট্র্যাডিশনাল হস্তশিল্প ও বয়নশিল্প। আর শেখানো হয় ধনুর্বিদ্যা, এটাতে ছাত্রদের উৎসাহ প্রচুর। বছরের শেষে কালিম্পং শহরে (যে শহরের মালিকানা এককালে ছিল লেপচাদের হাতে) অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অনুষ্ঠান এবং প্রতিযোগিতা।


ফিরি ইশকুলের কথায়। রাতে ইশকুল ভাঙলে ছাত্ররা ছোট ছোট দলে চড়াই-উতরাই ভেঙে বনের পথ ধরে গৃহ অভিমুখে রওনা দেয়। হাতে তাদের পাইনের ডালে তৈরি মশাল। গলায় তাদের লেপচা গান। পাহাড়জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সেই গান। জোনাকির মতো আলো, ভেসে আসে গানের সুর। ছড়িয়ে যায় প্রত্যয়, বেঁচে থাকবে লেপচা ভাষা, বেঁচে থাকবে তার নাচ-গান, তার তীরন্দাজির গৌরব, তার নিজস্বতার গর্ব।


লেপচাদের সাধুবাদ জানাই তাদের নির্দিষ্ট ভাষায়। তা কখনও সংগীত, কখনও শ্লোগান- আ চুলে!

More Articles