জীবনপুরের পথিক... ঘর ছেড়ে ভবঘুরে হওয়ার নিয়মকানুন

গতকাল ছিল আমার গুরুর জন্মদিন, ৯ এপ্রিল। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত ১১৯ বছর। আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি কোনওদিন। দেখা হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তার জন্য গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিতে অসুবিধে হয়নি কখনও। তা ছিল মর্মে মর্মে প্রজ্জ্বলিত দর্শনের নিরন্তর শিখা। হৃদয়ের প্রত্যন্তে এমন জায়গা আর কখনও কারও জন্য প্রসারিত করিনি। এ সম্ভবত কমবয়সের গুরুপ্রেমে শিষ্যর অকুণ্ঠ প্রণাম। তাতে খামতি থাকার কথা নয়, আমারও ছিল না। তিনি ছিলেন কেদারনাথ পাণ্ডে, উত্তরপ্রদেশের এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু গুরু আমার তর্কাতীতভাবে পণ্ডিতমহলে মহাপণ্ডিত বলে পরিচিত ছিলেন।

তিনি ছিলেন বহুভাষাবিদ। হিন্দি, উর্দু, বাংলা, ভোজপুরি, নেপালি, সিংহলি, তামিল, মৈথিলি, রাজস্থানি, আরবি, ফারসি, তিব্বতি, পালি, সংস্কৃত, ইংরেজি, ফরাসি ও রুশ ভাষায় তাঁর অসামান্য দক্ষতা ছিল। শুনেছি, মোট ৩৬টি ভাষা তিনি জানতেন। তিনি যেমন বৌদ্ধশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন, তেমনই ছিলেন একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাতা হিসেবেও প্রসিদ্ধ ছিলেন। আবার পবিত্র কোরান শরিফের সংস্কৃত অনুবাদ করেন কারাবাসের সময় (স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের কারণে জেলে গিয়েছিলেন তিনি)। তিনি ছিলেন একজন ভারতবিশারদ। ভ্রমণ, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তিনি লাগাতার লিখেছেন একটার পর একটা বই। পাণ্ডেজি একসময় বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হয়ে নিজের নাম বুদ্ধের পুত্রের নামানুসারে 'রাহুল' করে নেন। তারপর লিখতেন 'সাংকৃত্যায়ন' নামে (অর্থাৎ, যিনি আত্মীকরণ করেন)। এই রাহুল সাংকৃত্যায়ন পরবর্তীতে কমিউনিস্ট সংগঠন কৃষক সভার সভাপতি হন। এই না হলে গুরু!

রাহুল সাংকৃত্যায়নের জীবনী লেখা আমার কর্ম নয়। কিন্তু এই গৌরচন্দ্রিকা কেন জরুরি, তা বলি। আসলে প্রবাদপ্রতিম এই মানুষটির প্রতি আমার প্রাথমিক আকর্ষণের কারণ কী ছিল, তা বলা দরকার। কমবয়সে আমার পিতৃদেব আমাকে একটি বই পড়তে দিয়েছিলেন। বইটি ছিল একটি হিন্দি বইয়ের বাংলা তর্জমা। মূল নাম ছিল 'ঘুমাক্কর শাস্ত্র', যা বাংলায় 'ভবঘুরে শাস্ত্র'। পিতৃদেব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বুঝেছিলেন, তিনি কী ভুল করেছিলেন! আসলে বইটি হল শৈশবের ঘরবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার মন্ত্র-সংবলিত একটি হাতবই (হ্যান্ড বুক)‌। অর্থাৎ, কীভাবে বাবা-মায়ের নজরদারি, শাসন, নিয়মনীতি এড়িয়ে মুক্ত হওয়া যায় ও জীবনকে যথেচ্ছ যাপনের মধ্য দিয়ে ভিন্ন এক অবকাশ তৈরি করা যায়।

আরও পড়ুন: বন্দির বন্দনা || জেলের ভেতর জীবন যেমন

রাহুল লিখেছিলেন, এই বই বাপ-মায়ের থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে। ক্রমাগত চেষ্টা করতে হবে বাড়ির ঘেরাটোপের বাইরে পরিব্রাজক হওয়ার। তিনি ছোট থেকে একটি বাদ্যযন্ত্র শিখতে বলেছেন, যা বয়ে বেড়ানো যায় সহজেই। নিয়মিত যোগাভ্যাস করতে বলেছিলেন, ডাক্তার-বদ্যি এড়াতে। শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক রাখা ভবঘুরের জন্য বাধ্যতামূলক। বাবার পকেট থেকে টাকা সরানোকে তিনি অপরাধ বলে মনে করেননি। কিন্তু সতর্ক করেছিলেন, বাপের টাকায় ভবঘুরে হওয়া যাবে না। থাকা-খাওয়া নিয়ে যেন কোনও বাছবিচার করা যাবে না। ভবঘুরেকে দু'বেলা দু'মুঠো নিজেকেই জোগাড় করতে হবে। এক্ষেত্রে, তার সঙ্গে থাকা যন্ত্র রাস্তাঘাটে বাজিয়েও সে অর্থ পেতে পারে। রাহুল নিজে ৪৫ বছর ভবঘুরের জীবন কাটিয়েছেন।

রাহুল সাংকৃত্যায়নের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ছোটবেলায় একাধিকবার যেমন বাড়ি থেকে পালিয়েছি, ও অনেকানেক বয়স পর্যন্ত দেদার ঘুরে বেড়িয়েছি, তেমনই দেখা পেয়েছি অসাধারণ সব ভবঘুরের। দেশে-বিদেশে এমন ভবঘুরে বা হোবো বা বোহেমিয়ানদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়, মূল স্রোতের গৃহজীবীর তুলনায় তা যতই নগন্য হোক। গুরুদেব লিখেছেন, যীশুখ্রীষ্ট, মহম্মদ, নানক, চৈতন্যদেব বা শঙ্করাচার্য হলেন এই পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির ভবঘুরে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে রয়েছেন ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং-রা। তৃতীয় শ্রেণিটি বেজায় ফাঁকা, সেখানে আমাদের মতো সাধারণ ভবঘুরেরা জায়গা করে নেবে।

একবার চেক রিপাবলিকে গিয়ে পাহাড়-নদী-জঙ্গলে ঘেরা বোহেমিয়া বলে একটা জায়গায় গেছিলাম। এই বোহেমিয়া থেকেই 'বোহেমিয়ান' নামকরণ। প্রাহা বা প্রাগের কাছে এই জায়গাটি পাঁচ শতাব্দীর পর থেকে শনাক্ত করেছেন ঐতিহাসিকরা। এখানে এক সময় সাধু, গুরু, পণ্ডিতরা সাধনা করতেন। এখনও পৃথিবীর তাবৎ ভবঘুরেদের কাছে তীর্থস্থান এই বোহেমিয়া।

আমার শহর কলকাতায় এক ভবঘুরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। হিমাদ্রি দত্তর বয়স তখন সত্তরের কোঠায়। দক্ষিণ কলকাতার সেই তরুণ তখনও তার ঝোলা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখেননি। ভারতের শহর থেকে শহরতলি, নদী থেকে সমুদ্রসৈকত, গ্রাম থেকে পাহাড় তাঁর একেবারে হাতের তালুর মতো চেনা ছিল। বলেছিলেন, 'ভারতের এমন কোনও চায়ের দোকান নেই, যেখানে আমাকে চিনতে পারবে না।' তাঁর কথার সবটাই ঠিক না হলেও সিংহভাগ যে ঠিক, তা টের পেয়েছিলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'হিমাদ্রিদা, এই যে এত বছর ঘুরে বেড়ালেন, টাকা পেলেন কোথায়?' অভিজ্ঞ ভবঘুরে মৃদু হেসে তাঁর ঝোলা থেকে একটি বাঁশি বের করে আমাকে দেখিয়ে বললেন, 'এই হল আমার ব্যাঙ্ক। হাটে-মাঠে-বাজারে-দোকানে, যেখানে মনে হয়েছে, সামনে একটা গামছা পেতে বাজিয়েছি। দু'মুঠো খাওয়ার পয়সা জুটে গেছে।' দারুণ বাঁশি বাজাতেন হিমাদ্রিদা! গুরু বলেছিলেন, ভবঘুরের কাছে কোনও কাজই ছোট নয়, প্রয়োজনে হোটেলের বাসন মেজেও উপার্জন করা যায়।

কলকাতার আরেক বিশ্ব-পরিব্রাজক, গুরুপ্রতিম কবি, নাট্য বিশেষজ্ঞ দীপক মজুমদারের কথাও উল্লেখ্য। তাঁর রচিত 'কলকাতা থেকে কনস্টান্টিনোপল' বা ধারাবাহিক 'ছুটি'-র ছত্রে ছত্রে লিখিত রয়েছে ভবঘুরে জীবনের বৃত্তান্ত। দীপকদার কাছে শিখেছিলাম, নিজের ছোট্টখাট্টো শরীরকে কীভাবে ভ্রমণের উপযোগী করে তোলা যায়।

লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম, আজীবন কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত রাহুল লিখেছিলেন, পাহাড়ের পথে কোথাও যদি কোনও সাধুর আস্তানা দেখা যায়, তবে ভবঘুরেদের একবার সেখানে বসা উচিত। আর কিছু না থাক, অন্তত একটা-দুটো গুড়সহ হাতে গড়া রুটি পাওয়া যাবে। তারপর, সেই সাধু ঝোলা থেকে উৎকৃষ্ট চরস দেবেন, প্রত্যেকের দু'-একটা টান দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, ভবঘুরে শাস্ত্র মূলত ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের জন্য লেখা।

মহিলারাও এক্ষেত্রে কম যাননি। তাঁদের কথা কখনও ভিন্ন পরিসরে বলব। এখানে একটি ছোট ঘটনা বলে শেষ করি। এক ফরাসি যুবক ও তার বন্ধু ইভানের সঙ্গে বিদেশে আলাপ হয়। দু'জনেই মিউজিশিয়ান। নানা দেশ ঘুরে তারা ভারতে আসে ও আমার বল্লভপুরের আখড়ায় কিছুদিন থাকে। তখন আমি কলকাতায়। ইভান গানবাজনার পাশাপাশি কিছুটা আঁকাজোকাও করত। ওর অনুরোধে আমি আখড়ায় ওকে আঁকতে দিতে রাজি হই। ফিরে গিয়ে দেখি, চমৎকার এঁকেছে ইভান আখড়ার বারান্দায়। সঙ্গে ফরাসিতে কিছু লেখা। ফরাসি জানি না বলে সে লেখা অগ্রাহ্য করি। কিছুদিন পর আরেক ফরাসি বন্ধু এসে সে লেখা দেখে হায় হায় করে ওঠে। তখন জানতে পারি, ইভান লিখেছে, 'যারা ঘরসংসার করে, তাদের বাপ-কাকা ও মা-মাসিদের ১০৮ বার...', বাকিটা প্রকাশযোগ্য নয়, তবে সহজেই অনুমেয়। ওই প্রথম জানতে পারি, কোনও কোনও ভবঘুরের সংসারীদের ওপর এমন আক্রোশ!

 

 

More Articles