বন্দির বন্দনা || জেলের ভেতর জীবন যেমন

সিনেমা পড়ার শুরু থেকেই একটা বিষয়ে আমার খটকা লেগেছিল- জেলখানার ভেতরের দৃশ্যে পরিচালকরা কেমন একটা বানানো সেটের প্রেক্ষাপটে ছবি সাজান, যা একেবারেই অবাস্তব ও ভিত্তিহীন। তা যেমন হিন্দিতে, তেমনই বাংলা চলচ্চিত্রেও। সবচেয়ে প্রথম যেটা বলতে চাই, যে পুলিশ লক আপ (থানা) আর জেলখানার কোনও প্রভেদ নেই সিনেমায়। যাহা বাপ্পান্ন তাহাই তিপ্পান্ন! হিন্দি ছবিতে যেমন পাথর ভাঙা প্রায় অরূপকথার প্রতীক হিসেবে প্রতিভাত, তেমনই দুঃখের দিন, কঠিন দিন, কষ্টের দিন বোঝাতে এমন দৃশ্য ফিরে ফিরে আসে শতকের পর নতুন শতকে, দশকের পর দশকে।

কেন এমনটা হয়? আমি জানি না। আর জানি না বলেই এক সময় আমার পরিচিত দুই পরিচালককে এ-সম্পর্কে আমি জিজ্ঞেস করি। এদের একজন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ও অন্যজন  গৌতম চট্টোপাধ্যায়। কেননা, আমি জানতাম, এরা দু'জনেই বেশ কিছুদিনের জন্য কয়েদবাস করেছেন রাজনৈতিক কারণে এবং এদের দু'জনের ছবিতেই ওই একই বাংলা ছবি টাইপ জেলখানা দেখা গেছে। উৎপলেন্দুদা খানিকটা এড়িয়ে গেলেও গৌতম চট্টোপাধ্যায় একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তা হল, আমাদের ইন্ডাস্ট্রির আর্ট ডিরেক্টররা কোনও স্টাডি করে না এবং এদের অভিজ্ঞতা কম। ফলে, আমাদের যেমনটি করে দেয়, সেটাই ব্যবহার করতে হয়। বললাম, হিরণদার (মিত্র) কথা মাথায় রেখে বলছো? মণিদা (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) বললে, হ্যাঁ, হিরণের সঙ্গে কথা বললে দেখবি, যে বিষয়ে ও জানে না বলে তুই ধরে নিবি, তা কিন্তু হিরণ ওর পড়াশোনা দিয়ে নানা কিছু জেনে-বুঝে ঠিক দাঁড় করিয়ে দেবে।

সে-সময়ে আর কথা হয়নি। অনেকানেক দশক অতিক্রম করে এই সেইদিন হিরণদাকে সেই পুরনো প্রশ্নটা করেছিলাম। হিরণদার বক্তব্য হল, আমাদের দেশে জেলখানা বলতে যেটা দেখি, তা ইংরেজি ছবি থেকে এসেছে। অপ্রতুল জানা-বোঝা কিছুটা থাকলেও মূল বাধা ছিল জেলখানা সম্পর্কে বাধানিষেধের কড়াকড়ি। এই তো সেদিন তা ঢিলে হল। এছাড়াও আমাদের ইন্ডাস্ট্রির ডিরেক্টররা প্রকৃত রিয়েলিটি নিয়ে কাজ করতে চায় না। সিনেমা হল মেক বিলিভ, লার্জার দ্যান লাইফ। অন্যথায় তা দর্শক দেখবে না। ফলে কয়েদখানা দেখাতে গিয়ে অযথা মিস্টিফাই করেছে বা ফ্যান্টাসাইজ করেছে। এরপর একে একে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ইত্যাদি-প্রভৃতি এল। অনেক পুরনো পড়া, দেখা, বোঝা ঝালিয়ে নেওয়া গেল। তা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লেখাই যায়। আপাতত সেটি আমার কাজ নয়। আমি যাব অন্য পথে। ইতিউতি জেলখানার ভেতরে উঁকি মারব। আর গল্পকথায় এক-আধজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।

সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানি নে, আমার কয়েদবাসের কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তা থানার লক আপে যেমন, তেমনি বড় বড় প্রাচীর আর বিশালাকার লোহার দরজা পেরিয়ে জেলখানার ভেতরেও। এখন তাকে বলে সংশোধনাগার। আমি ওই পুরনো জেলখানা নামেই লিখব। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, জেলখানার নিয়ম, কড়াকড়ি, চালচলন,খাওয়াদাওয়া- সমস্তটাই যেন পৃথিবীর বাইরে। সেখানে অস্বস্তি আছে, নিঃসঙ্গতা আছে, মনখারাপ আছে, আবার এই কয়েদবাসে সংযুক্তি আছে, সমবেতভাবে দিন কাটানো আছে, প্রাণখোলা গান আছে, সঙ্গত আছে, ফুলেল বাগান আছে। শুধু মনে রাখতে হবে, আমি লিখছি সেই স্মৃতি থেকে, যার বয়স হয়েছে। নয় নয় করে সে চার দশক পিছনে পড়ে আছে। আজ সেখানে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে খবর পাই।

আরও পড়ুন-উঠোন পেরিয়ে ইতালি, চোখে দেখা সাধু অসাধুর বৃত্তান্ত

জেলখানার বন্দিদের সংখ্যা-অনুযায়ী মস্ত মস্ত ঘরে বিচারাধীন বন্দিরা থাকে একসাথে তিরিশ-চল্লিশ কি পঞ্চাশজন। খুব যে ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়, তা নয়। অধিকাংশ জেলখানায় বিচারাধীন বন্দিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এগুলোকে 'ফাইল' বা 'ওয়ার্ড' বলে। আর আছে 'সেল'। সেখান একেকজনের এক-একটা ঘর। এইসব ফাইলের দরজা বন্ধ থাকে। নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য তা খোলা হয়। প্রহরে প্রহরে বন্দিদের গুনে যায় কারারক্ষী বাহিনীর কর্তারা। সেখানে সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধটা করতে হয় 'চিল্লার'-এর সঙ্গে। এ হল মশা ও উকুনের মধ্যবর্তী একটা পোকা। তাদের বাসা জেলখানার কম্বলে। বন্দিদের রক্ত তাদের খুবই প্রিয়। তারা গায়ের মধ্যে লোমকূপের ভেতরে সেঁধিয়ে থাকে। সেই জেলখানাতেই চিল্লারের ঠেলায় আমাকে প্রথম আমার সাধের দাড়ি কাটতে হয়েছিল।

জেলখানায় আমার ছিল প্রভূত কাজ। বন্দিদের অনেকেই আমার কাছে আসত চিঠি লেখাতে। তা যেমন জেলখানার আধিকারিকদের কাছে দয়াদাক্ষিণ্য চেয়ে বা শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে হাসপাতালে যেতে চেয়ে- তেমনই নানা পুলিশ অফিসারের কাছে, অর্থাৎ 'আমি আর করব না, এবারের মতো ছেড়ে দিন' ইত্যাদি।একবার এক অনুষ্ঠানে কুখ্যাত এক পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছিলেন, আপনার হস্তাক্ষরটি খুব সুন্দর। পরে তিনি জানান, বন্দিদের হয়ে লেখা আমার অনেক চিঠি তিনি পেয়েছেন।

তা যাই হোক, বন্দিদের গল্প শোনাটাও সেই বিস্তর কাজের মধ্যে অন্যতম। কেউ বলে ফেলে আসা স্মৃতি, কেউ বলে ব্যর্থতার কথা, ধরা পড়ার কথা। আবার কেউ বলে চুরি-ডাকাতির হরেকরকম গল্প। সেসব গল্পে সন্ত্রাস আছে, প্রেম আছে, বীরত্ব আছে, হেরে যাওয়া আছে আবার নতুন জীবনের কথাও আছে।

বন্দিদের এইসব কাজের সহায়ক বলে আমার খানিকটা খাতির ছিল জেলখানায়। এই ওয়ার্ড বা ফাইলগুলোর দেখভাল করত 'মেট'-রা। এই 'মেট' হল সাজাপ্রাপ্ত বন্দি। এদের আবার বিরাট হাঁকডাক। আমার সঙ্গে সেইসব চোর, গুন্ডা, ডাকাত, খুনিদের ছিল ভালই দহরম-মহরম। একজন পেশাদার খুনির সাথে আলাপ হয়েছিল, যে উর্দুতে কবিতা লিখত। উর্দু সবটা বুঝতাম না, কিন্তু শুনতে ভাল লাগত। তার নাম ছিল সাবির। জেলখানা থেকে বেরিয়ে ওর কবিতা ছাপার চেষ্টাও করেছিলাম। যা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। একজন ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। জনি, পার্ক সার্কাস অঞ্চলের ত্রাস। সে মাঝেমাঝেই ধরা পড়ত, কদিন জেলে থেকে বেল পেয়ে আবার একটা কুকর্মে জড়িয়ে পড়ত। আবার ক'দিন জেল কাস্টডি।

তবে সবচেয়ে মজার ছেলে ছিল আনন্দ পালিত রোডের মাছ বিক্রেতা মমতাজ। সে ব্যাঙ্ক ডাকাত ও ছিনতাই দলের সাথে খেপ খাটতে যেত। সে নাকি চোর নয়! সে শুধু যে কোনও লক বা তালা খুলতে পারে। ফলে যে কোনো ডাকাতির কেসেই গ্রেফতার হতো। সে থাকুক আর না থাকুক। তার এ নিয়ে ছিল বড় দুঃখ। প্রায়ই বলত, "আর কেউ তালা খুলতে পারে না। সব শালা আমার ঘাড়ে।" এই মমতাজ খুব ভাল গান গাইত আর আমরা ক'জনে ওর গানের সঙ্গে থালা বাজাতাম। মমতাজ হিন্দি ছবির সব পুরনো গান প্যারডি করে নির্ভুল সুরে গাইত। তার একটা গানের প্রথম লাইন আমার এখনও মনে আছে, 'এ মালিক তেরে বন্দে হম, জেলখানা মে বন্ধ হ্যায় হম।' তারপর প্রতি লাইনে খিস্তির ফোয়ারা। তাতে জেলার সুপার-সহ কেউ বাদ যেত না।

সে গান কি এখানে লিখতে আছে?

More Articles