রোমের এক কমিউনিস্ট পানশালা আর এক অমঙ্গলময়তার গল্প

সেভাবে বেড়াতে যাওয়া হয়নি। সে ছোট্টবেলায় বাপ-মায়ের সঙ্গে দু'দুবার গিয়েছিলাম নেতারহাট আর পুরী। ওই পর্যন্তই, তার বেশি কোনো দ্রষ্টব্য বা দৃষ্টান্ত খাড়া করা যাবে না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বেহিসেবি জীবনকে যথেচ্ছ যাপন। কী কাজ, কেন কাজ, কার জন্য কাজ এই সমস্ত অকুল প্রশ্নের বাণ ঠেলে আমাদের সময় গিয়েছে অফুরান। কাজ ছুটিয়ে বেড়িয়েছে। কোনো ছুটি নেই। নিস্তার নেই কোনো মতে। যে কাজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে সেখানে দুদণ্ডও  উপেক্ষা করা যায় না। গুরু বলেছে সময়টাকে নিংড়ে নাও, পুড়িয়ে খাও, সময়টাকে ধরো। সেখানে অনাবিল অকাজ-সম্পৃক্ত বয়ে যাওয়া নেই। কখনো কখনো মনে হয়েছে, তাহলে কি বিশ্রামও নেই?

নিশ্চয়ই আছে। না হলে এ গাড়ি চলত না। তবে  সে বিশ্রাম আর কতটুকু! বরং কাজের ফাঁকে,  চোরাগোপ্তা সময়ের আঁকাবাঁকা লেন থেকে বাইলেনে ঢুকে পড়া। ওটাই নতুন কিছু দেখা, নতুন কিছু পাওয়া। অভিজ্ঞতার উড়াল বটে তা। হয়তো ক্ষণিকের, হয়তো নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা মাফিক নয়। তথাপি ওই আড্ডার মতোই মনকে পুষ্টি জোগানোর পন্থা। সেটাই অন্বেষণ আর খুঁজে চলার মন্ত্র,  তাকে কখনো অবজ্ঞা করিনি। ফলে ঘুরেছি, যা পেরেছি দেখেছি। কিন্তু কোলাহলের থেকে দূরে, জনপ্রিয়তা যেখানে আম আদমির মাথা খেয়েছে
তার থেকে দূরে।

যখনই দেশে বা বিদেশে থেকেছি তখনই দেখেছি আমাদের সাংস্কৃতিক সমাজ-পাড়া থেকে রব উঠেছে ছবি পাঠাও, ছবি পাঠাও। আমি তো সে ছবি তুলি না। কলোসিয়াম কিংবা আইফেল টাওয়ারের ছবি তো ঐতিহাসিক ভাবে জনপ্রিয়তায় নেটধস্ত হয়েছে কবেই। আমি তাই অন্য পথে যাই।

আরও পড়ুন-বেহালা থেকে ইটালি, পকেটমারের দুনিয়াদারি চলছে

সেবার রোমে আছি। পরপর দু'দিন ছুটি পড়েছে। শনি-রবির ছুটির সঙ্গে একটা দিন ছুটি নিলে মঙ্গলবারও উৎসবের দিন ... মাতা মেরির স্মরণে। ফলে ছুটি হি ছুটি! অতএব আমারও ছুটি। দীর্ঘদিনের বন্ধু রোবের্তোর আমন্ত্রণে তাই চলে এসেছি 'মনতাআলতো'-র সমুদ্র উপকূলে। তোস্কানিয়া প্রদেশের অন্তর্গত এই অঞ্চল রোম থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রোবের্তো আমারই বয়সি। ছাত্রাবস্থায় বাম আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। বাবা ছিলেন ইতালিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য।

ওর সহপাঠীরা কমবেশি আমার ও রবের্তোর বন্ধু। তো দল বেঁধে এসেছি এখানে। কিন্তু তাই বলে কি আর কাজ নেই! এদের সাথে কথা বলে একটার পর একটা সাক্ষাৎকারে ষাট-সত্তরের ইউরো-কমিউনিজমের অবস্থাটা সাজিয়ে ফেলছি। এক ব্যবসায়িক পত্রিকার বরাত। এই উৎসবমুখরতায় সেটাও করে ফেলতে হবে।
তো ফিরে যাই সেই গ্রামের কথায়।

মূলত অবসর যাপনের গ্রামগুলি এখানে শান্ত, নিভৃত, সাজানো। শুধু আমরাই নয়, সকাল থেকে দলে দলে চলেছে সমুদ্র সৈকতে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে ছোটো ছোটো তাঁবু আর সমুদ্রের পারে খেলাধূলা করার সরঞ্জাম। জানা গেল, ইউরো-কমিউনিজমের বার বাড়ন্তের সময় কমিউনিস্টরা (লেফটিস্টরাও পড়া যায়) দলে দলে এখানে বাড়ি তৈরি করেছিল। এখানেই হতো শীর্ষ বৈঠক, পরিকল্পনা আর সম্মেলন। সে ছিল গ্রামশির তত্ত্বগাথা আদৃত ও জনপ্রিয় নেতা বার্লিংগুয়ের-এর ভরাবাজার।

হয়তো রোমের নিকটবর্তী বলেই এই অসাধারণ সমুদ্র পারের জায়গাটাটি বাছা হয়েছিল। এখানে বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত ছাড়া আছে একটি প্রাচীন রোমান দুর্গ। মূলত 'সামার টাইমে'ই মানুষ দলে দলে আসে এখানে। পর্যটনকেন্দ্র বলে এখানে জিনিসপত্রের দাম খানিক বেশি।

মজার কথা হল, এখানেই আবিস্কার করেছিলাম সমুদ্র সৈকতে প্রাচীন ভঙ্গিমায় অত্যন্ত সাজানো একটি বার। জনপ্রিয় এই বারের নাম হল 'কমিউনিস্টি বার'। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি এই বার তৈরি করেছিল। আজও হৃতশক্তি সেই পার্টির নিয়ন্ত্রণেই  চলে। নতুন প্রজন্মের কাছে  এই বার আজও ঐতিহাসিক। ভাবা যায়!

এখানে তরলের দাম অন্যান্য বারের থেকে কম। যতটুকু বেশি নিলে সুষ্ঠুভাবে বারটি চালানো যায় শুধু সেইটুকু এরা নেয়। সঙ্গে খাদ্য খাবারের দামও তেমন নয়। ফলে এই সমুদ্রের পারে অন্য বার ও রেস্টুরেন্টের চেয়ে কমিউনিস্টি বার অপেক্ষাকৃত সস্তা। ঝকঝকে কমবয়সী তরুণ তরুণীরা কাজ করে।ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের ব্যবহারও চমৎকার। সেখানে একটা বিয়ার নিয়ে বসে এক ইতালিয়ান কিশোরীকে একটু তামাশা করেই বললাম, 'আর ইউ আ কমিউনিস্ট?' সে এক গাল হেসে বললে, " "আই অ্যাম আ সিমপ্যাথাইজর। মাই ফাদার ওয়াজ আ কমিউনিস্ট।" এরপর এক কথা দু'কথায় জানা গেল মেয়েটি এইখানেই থাকে। রোবের্তোর মতো ওর বাবাও এখানে একটা বাড়ি করেছিলেন। এলিনা নামের এই মেয়েটি জানাল, তাদের বারের কোনো মুনাফা নেই। সাম্যবাদী ভাবধারায় তারা এই বারটি চালায়। যারা কাজ করে তারা প্রত্যেকেই অর্থ পায় এবং তাতে তাদের ভালো ভাবেই চলে যায়। মনে হলো কমসোমলের বীজভাবনা থেকে এরা উৎসারিত।

তো রোমে যখন আছিই তখন রোমের আরেকটা জায়গা নিয়ে একটু লিখি। আগেই লিখেছি, এদিক সেদিক গেলেই স্বজনবান্ধবরা ছবি দেখতে চায়। আমি সাধারণত "ট্যুরিস্ট স্পট" এড়িয়ে চলি। তথাপি কাজের মধ্যেও খুঁজি ভিন্ন জায়গা, অজানা স্থান, যে দিকে সাধারণত কেউ খুব একটা চোখ দিতে চায় না।

এমনই এক রাস্তা আবিষ্কার করেছিলাম রোম শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক দশক আগে। এ এক অদ্ভুত সড়ক। এখানে পথ চলতি মানুষ দাঁড়ায় না। ভবঘুরেরা ডালি সাজিয়ে গানবাজনা করতে বসে না পয়সা পাওয়ার আশায়। এই রাস্তায় একজন ভিখারীরও দেখা পাওয়া যায় না। অথচ মধ্য রোমের এই রাস্তার অনতিদূরে গমগম করছে মানুষের ঢল। এই জায়গাটি কেবল শূন্য ...

এ হলো কিউরিয়া অফ পম্পে থিয়েটার। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে এখানেই নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় জুলিয়াস সিজারকে। ষাটজন সশস্ত্র সেনেটর সমবেত ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে সিজারের ওপর। এরপর সবটাই ইতিহাস। পরবর্তীকালে সাহিত্যে , নাটকে, সিনেমায় রচিত হয় এই রক্তাক্ত অধ্যায়।শেক্সপিয়রের সেই বিখ্যাত সংলাপ, 'ইউ টু ব্রুটাস'!

পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি রোমানরা এই জায়গাটিকে অমঙ্গলকর স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সেই ধারাবাহিকতা আজও চলে আসছে। আমার মনে হয় এই পম্পে থিয়েটারের ধ্বংসাবশেষ রোমে একমাত্র ঐতিহাসিক স্থান যা আজও অবিন্যস্ত, কোনো রকম সংস্কার হয়নি। জঙ্গলে আগাছায় পরিপূর্ণ। যা ইতালি দেশটির ক্ষেত্রে বিরল ঘটনা। ইতালিয়ানরা প্রচীন ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণে অত্যন্ত সক্রিয়।

এই রাস্তায় খুঁজে পাওয়ার পর যতবার রোমে গেছি ততবারই সময় পেলে একবার এই ঐতিহাসিক স্থানে খানিকটা সময় কটিয়েছি একা একা। কেন জানি না! প্রতিবারই মনে হয়েছে, এই পৃথিবী কী দীনা!

More Articles