যে গ্রামে শিশুরাও সুরে কাঁদে...

বেশি দিনের কথা নয়, তখন প্যান্ডেমিক সবে তার ছায়া প্রসারিত করতে শুরু করেছে। সেই সময় তিন সহযোগীকে নিয়ে উড়ে গিয়েছিলাম রাজস্থান।সায়ন, অর্পণ আর কিশোর। এরা প্রত্যেকেই আমার পুত্রবত। কেউ দুই কুড়ি কেউ বা দেড় কুড়ি বছরের ছোটো। কিন্তু সকলেই সুদক্ষ কর্মী ও আমার ভাষায় 'তাগড়া'। কাজটা কঠিন ছিল। সে সময় মরুপ্রান্তরে চলছে দাবদাহ। এমত অবস্থায় ছবির শুটিং করা চাট্টিখানি কথা নয়! ইউনেস্কো ও রাজস্থান ট্যুরিজমের জন্য এই কাজ করতে প্রায় মাস তিনেক সময় নিয়েছিলাম। লাঙ্গা ও মাঙ্গানিয়ারদের উপর এমন একটা ঐতিহাসিক কাজের দায়িত্ব দেওয়া ও আমার ওপর আস্থা রাখার জন্য এই প্রকল্পের প্রধান পরিকল্পক বন্ধুবর অমিতাভ ভট্টাচার্যকে কোনো পাতি ধন্যবাদ জানানোর জন্য এই লেখা নয়। এ লেখা লাঙ্গা শিল্পীদের সম্পর্কে সম্যক একটি ধারণা দেওয়ার জন্য। মাঙ্গানিয়ার নিয়ে পরে কখনো লেখা যাবে।

তো আসি লাঙ্গা জনগোষ্ঠীর কথায়। এরা আদিতে ছিল যাযাবর। পূর্বতন জিপসিদের উৎস থেকে আসা। পরবর্তীতে মরুপ্রদেশের নানা গ্রামে বসতি গেড়েছে। এদের পেশা শুধুমাত্র গানবাজনা। সিন্ধি সিপাইরা এদের যজমান। অর্থাৎ এদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই লাঙ্গারা জীবিকা নির্বাহ করত। বছরের পর বছর ধারাবাহিক ভাবে এদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে গানবাজনা করে, তাদের মনোরঞ্জন করাই লাঙ্গাদের নিত্যকাজের অন্তর্গত। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশেবিদেশে নানা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ। এদের একেক জনের পাসপোর্ট দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি। বছরে দু'বার তিনবার কখনো কখনো চারবার পর্যন্ত বিদেশ ঘুরে আসে। লাঙ্গারা মুসলমান ধর্মাবলম্বী। কিন্তু সমস্ত ধর্মের প্রতিই মান্যতা দেয়।

আসি মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে। বারমের জেলার এ পাড়া ও পাড়ার মতো দুটি গ্রাম। একটার নাম  বারনোয়াজাগির আর অন্যটি লাখেকিধানি। এখানে আড়াই শো শিল্পীর বসবাস। যারা প্রত্যেকেই অসাধারণ গান গায় অথবা যন্ত্র  বাজায়। সারা পৃথিবীতেই এমত গ্রাম বিরল। এদের পূর্বপুরুষেরা এই স্থানে একটি প্রসস্থ কুয়ো আবিষ্কার করে এবং এখানেই বসতি স্থাপন করে। এখানে আমাদের ঘুম ভেঙেছে গানে আবার রাত নেমেছে গানে গানে। আগেই বলেছি, এরা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়, গানবাজনা করে। কিন্তু আর্থিক অবস্থা তেমন সুবিধার নয়। আড়কাঠি তথা এজেন্টরাই অধিকাংশ টাকা পকেটস্থ করে।

তো অপ্রত্যাশিত ভাবে এখানে পৌঁছে দেখা হয়েছিল জনপ্রিয় বেশ কয়েকজন লাঙ্গা শিল্পীর সঙ্গে। যাদের অনেক আগে থেকেই চিনতাম। বিদেশে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। বিশেষ করে ফরাসি দেশে, নাট্যব্যক্তিত্ব আরিয়ান মুশকিনের 'থিয়েটার দ্যু শোলে'-তে। সেখানকার রাজস্থান ভবনে। এরা লাঙ্গা গুরু সার্দার খান,বন্দু খান, নেক মহম্মদ ইত্যাদি। এরাও অবাক, যে হঠাৎ আমি এদের গ্রামে অতিথি! ফলে কাজের ফাঁকে পুরনো স্মৃতির ঝলক ও আড্ডা।আর স্বাভাবিক নিয়মেই  এদের ঘরে ঘরে নিমন্ত্রণ। লাঙ্গারা খুব ভালো রান্না করে। তবে তেলের ব্যবহার অত্যাধিক। মূলত এরা আমিষাশী। এখানে খাসি ও পাঁঠার মাংসের দাম কম। মুরগি এরা কদাচিৎ খায়। ডিম খায় না। আঞ্চলিকভাবে উৎপাদিত সবজি খায় (কের সাংরি)। ভাত ডাল ও বাজরার রুটি থাকে পাতে। অসম্ভব ভালো ঘি ও মাখন থাকে খাদ্য খাবারের সাথে। তার পরিমাণ দেখলে আমাদের চোখ কপালে উঠে যাবে। আর মধ্যাহ্ন ভোজের শুরুতে অপূর্ব ছাছ (ঘোল)।

এবার ফিরে যাই লাঙ্গা গানে। অনেকেই এদের গানকে সেমিক্ল্যাসিকাল বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণত বিপরীত। এদের গান হল, লোকগান যা পরবর্তীতে দরবারিতে প্রতিস্থাপিত হয়েছে, ব্যাকরণ তৈরি হয়েছে, গঠন ও নির্মাণের ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। কথায় কথায় সর্দার খান লাঙ্গা বলছিল, "ক্ল্যাসিক্যাল গান আমরা জানি না। আমরা ধারাবাহিক ভাবে যা শুনে এসেছি তাই পরিবেশন করি। আমাদের গানে সেভাবে কোনো ব্যকরণ নেই। আমরা রেওয়াজ করি না। এই যে আনন্দে গান করছি, এটাতেই চর্চা।"

অথচ লাঙ্গাদের গান আছে প্রতি প্রহরে, যা সম্পূর্ণতই রাগাশ্রিত। লাঙ্গা গানে প্রধানত ব্যবহার হয় সিন্ধি সারেঙ্গী,  খরতাল (করতালর নয়), দেশজ ঢোল, বাঁশি আর হারমোনিয়াম। এ গানে সুরের বৈচিত্র যেমন আছে তেমনি আছে তালছন্দের বিস্তার। গায়করা চড়া স্বরে ও খাঁদে অবলীলায় ওঠা নামা করতে পারে দক্ষতার সঙ্গে। প্রতিটি গায়কের সুরবন্দনা আলাদা আলাদা।ভাব ও পরিবেশনার বৈচিত্র মুগ্ধ করে শ্রোতাদের। লাঙ্গারা সুফি থেকে মীরা বা কবীরের ভজন, গনেশ বন্দনা থেকে বিয়ের গান, প্রকৃতি থেকে লোকপ্রেম সবই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায়।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, মুম্বইয়ের ফিলম ইন্ডাস্ট্রির লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা তাতে খানিকটা প্রলোভিত হচ্ছে অর্থের কারনে। দুর্দান্ত কন্ঠস্বর ও গায়কির কারনে এদের দিয়ে চলতি হিন্দি গান গাওয়ানোর জন্য বরাত দিচ্ছে। কেউ কেউ যাচ্ছেও। একাধিক যুব শিল্পী টেলিভিশনে রিয়ালিটি শোয়ের অনুষ্ঠানে গান গেয়ে এসেছে। হয়তো কিছুটা নামধামও হচ্ছে। কিন্ত এর ফলে ক্রমে নিজেদের ঐতিহ্য ও পরম্পরা নিপাত যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। সেক্ষেত্র একটাই আশার কথা, কলকাতার একটি সংস্থা 'বাংলা নাটক' ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে,  যাতে এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষিত রাখা যায়। লাগাতার কর্মশালার আয়োজন করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে। গুরুদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটা সেতু তৈরির অনিবার্য প্রয়াস ও যথার্থ প্রচেষ্টা। শুধু তাই নয়, শিশু-কিশোরদেরও গুরুমুখী করে তাদের পথ দেখানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে কর্মশালার মাধ্যমে।

বারনোয়াজাগির ও লাখেকিধানির দুই গ্রামে  সুরেলা সংগীতের সমারোহে জেগে আছে মাইলের পর মাইল মরুপ্রান্তর। ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে উটের দল। মহিলারা বর্ণময় পোষাকে দৈনন্দিন কাজ সেরে নিচ্ছে। কচিকাঁচাদের দল ছুটে বেড়াচ্ছে। আর তাদের গান? সাত-আট বছরের বাচ্চারাও অসাধারণ গান গায় এখানে। না শুনলে বিশ্বাস করা যাবে না। চড়া গলায় তারা গান ধরে, কখনো একক বা সমবেত ভাবে। নিখুঁত গান করে তারা, নির্ভুল পর্দায় ছুঁয়ে যায় কন্ঠস্বর।  এইসব শিশু কিশোরদের নিয়েও একটা ছবি তৈরি করেছিলাম। তাদের প্রশ্ন করেছিলাম যে কিভাবে বা কার কাছে গান শিখেছো? তাদের সপাট উত্তর, "শিখা নেই, গানা অ্যাইসেই আতা হ্যায়।" নেক মহম্মদ লাঙ্গাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরা যে বলছে কখনো গান শেখেনি, কিন্তু এমন সব চড়া সুর, গানের কঠিন চলন না শিখে গাইছে কী করে? এটা কি আদৌ সম্ভব? লাঙ্গা গুরু নেক মহম্মদ হাসতে হাসতে বলে, "গান তো আমিও শিখিনি। আমাদের পরম্পরা আর ঐতিহ্যের মধ্যেই সুর আছে , তাল আছে। কাউকে শিখতে হয় না। মায়ের পেটে থাকতে থাকতেই আমরা গান শুনছি।"এরপর খানিকটা থেমে নেক মহম্মদ বলে, "আমাদের সমাজে কথিত আছে, যে শিশু সুরে কাঁদে না সে লাঙ্গা সমাজের বাচ্চা হতেই পারে না।" আমি একথা শুনে তো সম্পূর্ণ হতবাক!

এমনও হয়?

More Articles