গাড়ির হর্ন ডেকে আনছে মারাত্মক বিপদ, শব্দেই লুকিয়ে মরণফাঁদ

আপনি যদি শহরে বাস করেন, তাহলে শব্দদানব একটু একটু করে ক্ষতিগ্রস্ত করছে আপনার মস্তিস্ককে, আপনার হৃদযন্ত্রকে।

মণীশবাবুর বয়স মাত্র ৪৫। তিনি কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের একজন সার্জেন্ট। নিয়ম অনুযায়ী আরও অন্তত দশ বছর চাকরি আছে তাঁর। কিন্তু হঠাৎ তাঁর শারীরিক সমস্যা দেখা দিল। দেখা গেল, তাঁর হৃদপিন্ডে সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, অতিরিক্ত দূষিত বায়ু এবং ধকলের কারণে এমন হয়েছে। কিন্তু ডাক্তাররা এক চাঞ্চল্যকর বিষয় আবিষ্কার করলেন। মণীশবাবুর এই বিপত্তির কারণ মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়ছেন। শহরের শব্দদূষণ মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে তাঁর হৃদযন্ত্রে। এখন অবসর নেওয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই।

এই কাল্পনিক চরিত্র এবং ঘটনার আশ্রয় নেওয়া হলো বটে, কিন্তু যে বিপদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে তা একেবারেই কাল্পনিক নয়। শব্দদূষণ আর শুধু মাত্র কোনও বিশেষ দিনে সীমাবদ্ধ নেই, তা এখন প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। আপনি যদি শহরে বাস করেন, তাহলে এই শব্দদানব একটু একটু করে ক্ষতিগ্রস্ত করছে আপনার মস্তিস্ককে, আপনার হৃদযন্ত্রকে। যতক্ষণ না রাত গভীর হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ৮৫ ডেসিবেল শব্দমাত্রা থাকছে গড় হিসেবে। অনেক জায়গাতেই তার থেকে বেশি। দুঃখের বিষয়, যাহবা বায়ুদূষণ, জলদূষণ নিয়ে একটু কথা হয়, সরকার একটু লোকদেখানো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, শব্দদূষণের ক্ষেত্রে তারও প্রয়োজন মনে করা হয় না। কারণ ৯৯ শতাংশ মানুষের কাছে এটা কোনও সমস্যাই নয়। এই সমস্যা তাঁরা ঠাহরই করে উঠতে পারেন না।

কিন্তু একটা মজার বিষয় কি আপনি ভেবে দেখেছেন? আপনি এখন হেডফোন কিনতে গেলে আপনাকে নয়েজ ক্যান্সেলেশন হেডফোন দেখানো হয় না? বা ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলির বিজ্ঞাপনে থাকে না যে, 'শহরের কোলাহল থেকে দূরে কাটিয়ে আসুন কিছুদিন। পাহাড়ের কোলে, নিরিবিলি শান্ত জঙ্গলে দু'রাত তিন দিন'?

আরও পড়ুন: প্রতিদিনের দূষণে দায় আছে আপনার পোশাকেরও, তাহলে উপায়!

আমাদের আধুনিক সভ্যতা আমাদের এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যেখানে নিস্তব্ধতা এখন ব্যবসার পণ্য, আর আপনি যদি শহরের বাসিন্দা হন, তাহলে সেই পণ্য নিজের জ্ঞানত বা অজ্ঞানত আপনি ক্রয় করবেনই।

আবার অন্যদিকে খবরের চ্যানেলগুলি খুলে দেখুন। চারদিকে শব্দদূষণ। সবাই সারাক্ষণ চিৎকার করছেন। সঞ্চালক চিৎকার করছেন, তাঁর অতিথিরাও সমান তালে চিৎকার করছেন। সবাই ভাবছেন, চিৎকার করে অন্যকে নিজের বক্তব্য শোনাবেন, দর্শককে প্রভাবিত করবেন। কিন্তু তিনি নিজেই নিজের কথা শুনতে পাচ্ছেন না, অন্যের কথা শোনা তো অনেক দূরের বিষয়। রাস্তায় বেরোলে দেখবেন গাড়ি, বাস, বাইক সবাই হর্ন মেরে চলেছে। কারণে-অকারণে, সবাই নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন। সবার গন্তব্যে যাওয়ার ভীষণ তাড়া। হর্ন দিয়েও কাজ না হওয়ায় চিৎকার করছেন। অ্যাম্বুল্যান্সকে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন সাইরেন লাগাতে হচ্ছে, যাতে তার আওয়াজ সহনাগরিকদের কানে পৌঁছয়।

রাস্তা অবধিও যেতে হবে না। নিজের বাড়িতেই তারস্বরে স্পিকারে গান বাজাচ্ছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক। অন্যদিকে খুব বেশি বুদ্ধি না থাকা, একটু বেশি ধার্মিক মানুষজন নিজের ভগবানের প্রার্থনা গোটা পাড়াকে শোনাতে চাইছেন। বিবাহ অনুষ্ঠানেও মানুষ চাইছেন তাঁদের পারিপার্শ্বিক, তাঁদের প্রতিবেশীরা অবহিত হোন সেই শুভ অনুষ্ঠানের বিষয়ে। সবাই কোনও না কোনও উপায়ে বিভিন্ন ধরনের শব্দ সৃষ্টি করছেন, নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন। এই সবকিছুর মাঝে এখনও ভোটাধিকার না পাওয়া জেনএক্স এই শব্দদূষণ থেকে বাঁচতে বহু দাম দিয়ে Noise Cancelation Headphones কিনছে এবং সেখানে শব্দমাত্রা ১০০ করে দিয়ে নিজের পছন্দের গান শুনছে।

রিপোর্ট বলছে, শুধুমাত্র ইউরোপে প্রতি বছর দশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় শব্দ দূষণের কারণে। ৪৮,০০০ মানুষের হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়, ৬৫ লক্ষ মানুষ আর শান্তিতে ঘুমোতে পারেন না। সেই সঙ্গে হাইপারটেনশন, উচ্চ রক্তচাপ তো আছেই।

অবাক হওয়ার মতো তথ্য হলেও এটাই বাস্তব। শব্দদূষণের কারণে শুধুমাত্র আমাদের কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তা আমাদের মস্তিষ্কের কোশগুলিকেও মেরে ফেলে। কমে যায় আমাদের স্মৃতিশক্তি। প্রবল চাপ সৃষ্টি করে আমাদের হৃদপিন্ডের ওপর। সেই সঙ্গে শব্দদূষণ প্রভাব ফেলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও। তিলে তিলে কমিয়ে দেয় আমাদের আয়ু। আমরা বুঝতে পারি না। আপনি যদি খেয়াল করেন যে, ইদানীং আপনি একটু বেশি খিটখিটে হয়ে গেছেন, খুব সহজেই মেজাজ হারাচ্ছেন, তাহলে বুঝবেন, এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম শহরের এই শব্দদূষণ। এই সব কারণ খতিয়ে দেখেই American Academy of Nursing ঘোষণা করেছিল, শব্দদূষণ বাকি আর সমস্ত দূষণের মতোই মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর।

কিছুদিন আগে মুম্বই পুরসভা একটি নিয়ম প্রবর্তন করে। যে নিয়ম অনুযায়ী, সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন কোনও একটি গাড়িও যদি হর্ন বাজায়, তাহলে অপেক্ষা করার সময়সীমা তিরিশ সেকেন্ড বেড়ে যাবে। যতবার হর্ন বাজবে, ততবার এই কাণ্ড ঘটবে। দেশের সব শহরেই এই ধরনের নিয়ম চালু করার সময় এসে গেছে। মানুষ নিজে থেকে সচেতন হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না। কঠোর শাস্তি ছাড়া কোনও গতি নেই এই বিপুল দূষণ আটকানোর।

More Articles