তীব্র তিরস্কার সুপ্রিম কোর্টের, তাজমহল বিতর্কের জল এবার কোনদিকে?

Taj mahal: পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য তাজমহল ঘিরে বিতর্ক উঠেছে বারবার। একাধিক কোর্টেও মামলা, পিটিশন দাখিল হয়েছে।

তাজমহল কবে তৈরি করা হয়েছিল? সত্যিই কি এটা মুঘল সম্রাট শাহজাহানের বেগম মুমতাজের সমাধিসৌধ? নাকি এর পিছনে লুকানো রয়েছে অন্য কোনও গল্প? তাজমহলের আসল ইতিহাস কী? বিগত কয়েকমাস ধরে যারা লাগাতার ভারতের খবরাখবর দেখছেন, তাঁরা এই প্রশ্নগুলো নিশ্চয়ই শুনেছেন। হাটে-বাজারে, ক্যামেরার সামনে পিছনে বারবার এই প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্যকে নিয়ে এমন আলোচনা সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্ক তৈরি করেছে। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট অবধিও যাওয়া হয়েছে। দেশের মুখ্য বিচারালয়ের বেঞ্চে পিটিশনও দাখিল করা হয়েছে। তবে ৫ ডিসেম্বর সেই পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কেবল খারিজই করা হয়নি, রীতিমতো ভর্ৎসনাও করেছেন বিচারপতি এম আর শাহ এবং সি টি রবিকুমার।

ঘটনাটি ঠিক কী? হরিয়ানার এক বাসিন্দা সুরজিৎ যাদব এই পিটিশন দাখিল করেছিলেন। তাজমহলের পিছনে ‘প্রকৃত ইতিহাস’ কী, তার বয়স কত, সৌধের আগে সেখানে কী ছিল ইত্যাদি নানা প্রশ্ন সেখানে তুলে ধরেছিলেন তিনি। তার প্রেক্ষিতে বিচারকরা বলেন, দেশের সুপ্রিম কোর্টের কাজ এসব নয়। প্রায় ৪০০ বছর আগে যে স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল, তার ঐতিহাসিক তথ্য জোগাড় করা তো কোর্টের দায়িত্ব নয়। বিচারকরা এ সমস্ত বিষয় নিয়ে আদালতের সময় নষ্ট না করতেও বলেন।

আরও পড়ুন : নতুনভাবে ইতিহাস লেখার নিদান অমিত শাহের, ‘হিন্দুরাষ্ট্রের’ পথে আরও এক ধাপ?

তাজমহল নিয়ে এই বিতর্ক বহুদিনের। শিবমন্দির ভেঙে তার ওপর এই সৌধ তৈরি করা হয়েছে, এমন দাবি বারবার জানিয়েছে হিন্দুত্ববাদী দলগুলি। কেন্দ্রের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারাও এমন দাবি তুলেছেন। চলতি বছরের মে মাসে তাজমহল ইস্যুতে পিটিশনও দাখিল করা হয় এলাহাবাদ আদালতে। এই পিটিশনটি দাখিল করেছিলেন রজনীশ সিং নামের এক ব্যক্তি। বিজেপির অযোধ্যা শাখার মিডিয়া সেলের ইনচার্জ হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। তখনই উঠে আসে একটি শব্দবন্ধ – ‘তেজো মহালয়’।

একটু পিছনে যাওয়া যাক। ২০১৫ সালে আগ্রা দায়রা জজ আদালতে সাতটি পিটিশন দাখিল করে একদম আইনজীবী। তাঁদের দাবি, তাজমহলে অবিলম্বে হিন্দুদের পুজো করার অনুমতি দেওয়া হোক। সেই সময়ই সামনে আসে ‘তেজো মহালয়’ মন্দিরের প্রসঙ্গ। এমনকী এও দাবি করা হয়, অন্তত ১০৯টি প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। যদিও সেই ঐতিহাসিক প্রমাণ ও পিটিশনকে ভিত্তিহীন বলে আদালত।

এদিকে রজনীশ সিংয়ের দাবি, আগ্রার ওই বিশেষ জায়গায় ১৬৩১ সালের আগে একটি মন্দির ছিল। সেই মন্দিরটির নামই ‘তেজো মহালয়’। মুঘল সম্রাট শাহজাহান নাকি সেই মন্দিরটি ধ্বংস করে তাঁর প্রিয়তমা বেগমের জন্য এই শ্বেতশুভ্র সৌধ তৈরি করেছেন। কেবল রজনীশ সিং নয়, একই দাবি নিয়ে সরব হন বিজেপির বহু নেতা। সেই দাবির সঙ্গে সহমত জানান বেশ কয়েকজন সাধু-সন্ত। প্রত্যেকের উক্তি ছিল একটাই, ‘প্রকৃত ইতিহাস’ খুঁজে বের করতে হবে।

আরও পড়ুন : কুতুব মিনার নিয়েও বিতর্ক! কারা, কেন ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করতে চাইছে?

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, সুপ্রিম কোর্ট যে পিটিশন খারিজ করল, সেখানেও উঠেছিল এই ‘প্রকৃত সত্য’ নির্ধারণের প্রসঙ্গ। আবেদনকারী সুরজিৎ যাদবের আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী ওই পিটিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, স্কুলের পড়ুয়ারা যাতে ‘প্রকৃত ইতিহাস’ জানতে পারে। আসল সত্যি জানতে পারে।

এবার কয়েকদিন আগের একটি ঘটনার দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর প্রয়োজন। ২৪ নভেম্বর অহম জেনারেল লাচিত বারফুকানের ৪০০ তম জন্মদিবস উপলক্ষে নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনে বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। ওইদিন মূল বক্তা ছিলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেখানে তিনি এই ‘প্রকৃত সত্য’-এর কথা তুলে ধরেন। সেই সভায় তিনি বলেছিলেন, বিকৃতির হাত থেকে ভারতের ইতিহাসকে বাঁচাতে হবে। একটা সময় নানা ভাবে দেশের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। অমিত শাহের বক্তব্য, এবার আসল সত্যি সবার সামনে আনা প্রয়োজন। এই মর্মে তিনি দেশের অধ্যাপক ও ছাত্রদের নতুন করে ইতিহাস লেখার জন্য আহ্বান জানান। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে ‘বিপথগামী’ না হয়, সেজন্যই এমন উদ্যোগের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এও বলেছিলেন, এর জন্য প্রশাসন সবরকম ভাবে সাহায্য করবে।

ঘটনাচক্রে, এরা প্রত্যেকেই বিজেপির নেতা। নয়তো হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর সমর্থক। প্রত্যেকের মুখে একটা শব্দবন্ধ – ‘প্রকৃত ইতিহাস’। কীসের প্রকৃত ইতিহাস? এই গোষ্ঠীর বক্তব্য, তাজমহলের ২২টি বন্ধ ঘরে কি লুকানো আছে? সেখানে কি হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, মন্দিরের ভগ্নাবশেষ রয়েছে? এই প্রশ্ন নিয়ে বারবার বিতর্কে উত্তপ্ত হয়েছে প্রাইম টাইম। বাবরি মসজিদ, জ্ঞানব্যাপী মসজিদের পর তাজমহলের ‘ঘর ওয়াপসি’ করাতে মরিয়া কট্টর হিন্দুরা। তাজমহলের ইতিহাস, তার নির্মাণকাজ, মুগ্ধতা, বিশ্বের ইতিহাসে তার স্থান – এই ব্যাপারগুলি তো প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু তেজো মহালয়ের ঐতিহাসিক প্রমাণ কোথায় পাওয়া গিয়েছে? স্বপক্ষে কি রয়েছে কোনও ঐতিহাসিক গ্রন্থ?

আরও পড়ুন : তাজমহল কি সত্যিই তেজো মহালয়া ছিল?

বিকৃত আসলে কোন ইতিহাসগুলো হচ্ছে? ঐতিহাসিক শহরগুলোর নামকরণের পিছনেও থাকে বিস্তীর্ণ এক কাহিনি। সেখানে জড়িয়ে থাকে আঞ্চলিক ইতিহাস, জড়িয়ে থাকেন সেখানকার মানুষ। সেই সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করে একের পর এক নাম পরিবর্তন লেগেই চলেছে। এলাহাবাদ থেকে ‘প্রয়াগরাজ’, মুঘলসরাই থেকে ‘পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর’ – ট্রেন্ড চলিতেছে সমানে। স্কুলের ইতিহাসের সিলেবাস থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের কথা সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট গোত্রের ইতিহাসকেই কি পরিবর্তনের কথা বারবার বলা হচ্ছে? সেখানে ইতিহাসের মূল দর্শন, যা কিনা কেবল ও কেবলমাত্র সত্য এবং তথ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে না?

তাজমহল যে শাহজাহানই তৈরি করেছিলেন, তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। চলতি বছরে এমন অদ্ভুত তথ্যও এনেছিলেন রজনীশ সিং। যাদের কথা ইতিহাসের পাতায় সেভাবে উঠে আসে না, তাঁদের কথা সামনে আনলে কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট অংশের ইতিহাস বদলে আরেকটি অংশকে জায়গা দেওয়া – এমন মিউজিকাল চেয়ারের কিসসা আরও বহুদিন চলবে, তা বলার অপেক্ষা থাকে না। প্রেমের শ্বেতশুভ্র সৌধ সেই রাজনীতির মধ্যে দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

More Articles