নতুনভাবে ইতিহাস লেখার নিদান অমিত শাহের, 'হিন্দুরাষ্ট্রের' পথে আরও এক ধাপ?
Amit Shah on distorting History: বিজ্ঞান মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইতিহাস বিকৃতির কথা বললেন অমিত শাহ। আদতে কারা করছে সেই কাজ?
গতকাল, ২৪ নভেম্বর ছিল অহম জেনারেল লাচিত বারফুকানের ৪০০ তম জন্মদিবস। সতেরশো শতকে সরাইঘাটের যুদ্ধে শক্তিশালী মুঘল সেনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। নিজের অহম সৈনিকদের নিয়ে কার্যত আটকে দিয়েছিলেন মুঘলদের। তাঁরই ৪০০ তম জন্মদিবস উদযাপিত হচ্ছে নয়াদিল্লিতে। তিনদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান কেন্দ্রীয় প্রশাসন এবং আসাম সরকার। গতকাল বিজ্ঞান ভবনের সেই অনুষ্ঠানে নিজের বক্তব্য রাখতে গিয়ে ফের ‘ইতিহাস বিকৃতি’র প্রসঙ্গ টানেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁর কথায়, “আমি নিজে ইতিহাসের একজন ছাত্র। এর আগেও অনেকবার ইতিহাস বিকৃতির প্রসঙ্গ আমার কানে এসেছে। আমাদের দেশের ইতিহাসকে নানাভাবে বিকৃত করা হয়েছে। এবার সেসব ঠিক করার সময় এসে গিয়েছে।”
এখানেই থামেননি তিনি। এরপর দেশের ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক ও ছাত্রদের কাছে ইতিহাস ‘ঝাড়াই বাছাই’ করার অনুরোধও রাখেন। অমিত শাহ বলেন, “আপনাদের জিজ্ঞেস করছি, কে আমাদের আসল ইতিহাসগুলোকে সামনে আনতে দিচ্ছে না? কে আমাদের আটকাচ্ছে? আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা দেশের ইতিহাসের আসল তথ্যগুলো সামনে আনুন। নতুনভাবে সেগুলি লিখুন। তৈরি করুন। এসব দেখেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উৎসাহিত হবে। কেন্দ্রীয় সরকারও এই কাজে আপনাদের সহযোগিতা করবে।”
আরও পড়ুন : ভক্তদের ‘রামসেতু’ আদৌ কি ছিল? কী রহস্য লুকিয়ে এই ‘ভাসমান পাথরে’!
কেবল অমিত শাহ নয়, বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা, মন্ত্রীদের ধারণার এমন প্রতিফলন বহুদিন ধরেই সামনে আসছে। এখানেই প্রশ্ন, শাহবাবুদের কাছে ‘ইতিহাস বিকৃতি’র অর্থ ঠিক কী? ইতিহাস একটা বিশাল বড়ো সময়রেখা। একটা বিরাট ক্যানভাস। যে ক্যানভাস জাতপাত, ধর্ম, দল মানে না। যে বই কেবল ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা লিখতে থাকে। তাহলে কি কেউ কোনওদিন নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয়নি? অবশ্যই দিয়েছে। শাসক এবং ক্ষমতার ধর্মই যে সমস্ত কিছুকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসা। হীরক রাজার মতো একজন শাসক দূরবীন দিয়ে সর্বক্ষণ নজর রাখছেন চারিদিকে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই ভয়, গদি হারানোর চিন্তা। অতএব, আমি যেমনটা চাইছি, তেমনটাই যেন হয়। সেই এজেন্ডাই আমায় পরেরবার ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। মগজধোলাইয়ের মেশিন বসুক প্রতিটা মোড়ে মোড়ে।
এই বছরই প্রতীচী ট্রাস্টের একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই ইতিহাস বিকৃতি থেকেই সাবধান করে দিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। সেখানের তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বারবার জানান, ইতিহাসের মূল উদ্দেশ্য হল সত্য সাধনা। সমস্ত দান-ধ্যান, কল্যাণমূলক কাজের পাশে উঠে আসে সংগ্রাম, বিদ্রোহ, মিথ্যাচারের চেষ্টা। সেখানে তার একটা অংশ না জানানো মানে সেই সত্যের প্রতি অন্যায় করা। সেটা চূড়ান্ত অপরাধ। কথাপ্রসঙ্গে উঠে আসবে বর্তমান কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের কথা। সেখানে সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে মুঘল সাম্রাজ্যের কথা। সেটা ইতিহাস বিকৃতি নয়? খুব পুরনো দিনে যেতে হবে না। ২০০২-এর কুখ্যাত গুজরাট দাঙ্গার কথাও সিলেবাস থেকে বাদ গিয়েছে। এই দাঙ্গায় কোন দলের নাম বারবার উঠে এসেছিল, সেটা নিশ্চয়ই সবার জানা। তাহলে এই প্রসঙ্গে অমিত শাহের বক্তব্য ঠিক কী?
আরও পড়ুন : বিজেপির গান্ধী-মুক্ত ভারতের কৌশল না কি মোদি আমলেই যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন নেতাজি!
কিংবা ধরা যাক বহু বিতর্কিত বাবরি মসজিদের কথা। বিজেপি, আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির দাবি, স্বয়ং ভগবান রাম ওই জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আচ্ছা, রাম বা রামায়ণ ভারতের আবহমান বয়ে চলা মহাকাব্যের অংশ। রামায়ণেরও অনেক রকমফের রয়েছে। কিন্তু রামায়ণের কাহিনি যে ইতিহাস স্বীকৃত, রাম ঐতিহাসিক একজন ব্যক্তি, সত্যিই তাঁর উপস্থিতি ছিল, সেটা কি কোথাও স্বীকৃত হয়েছে? অথচ বাবর ইতিহাস স্বীকৃত এক ব্যক্তি। বাবরি মসজিদও তাই। অথচ স্রেফ ‘বিশ্বাসের বশে’ একটা স্থাপত্যকে ভেঙে দেওয়া হল। একই বক্তব্য জ্ঞানব্যাপী মসজিদকে ঘিরেও। তাজমহল নিয়েও লড়াই চলছে বহুদিন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বারবার হুংকার দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, তাজমহল ও জ্ঞানব্যাপী- উভয়ই প্রথমে হিন্দুদের মন্দির ছিল। শিবলিঙ্গ ছিল। সেসব ভেঙে ‘বিদেশি শাসকরা’ এই স্থাপত্য তৈরি করেছেন।
এটা ঠিকই, একটা সময় মুসলিম শাসকরা দেশজুড়ে বহু মন্দির ভেঙেছেন। ইতিহাস তো সেই সত্য অস্বীকার করেনি! সোমনাথ মন্দিরকে ধ্বংস করার চেষ্টার কথাও স্বীকার করে আমাদের ইতিহাস। কিন্তু কেবল মুসলিমরাই কি দায়ী? বাংলায় বর্গি আক্রমণ ভুলে গিয়েছি কি? গড় পঞ্চকোট থেকে ছেলেভোলানো ছড়া, বর্গি হামলার ইতিহাস তো জ্বলজ্যান্ত হয়ে আছে। অনেক শৈব শাসকরা বিষ্ণু মন্দির ভেঙেছেন, বৈষ্ণবদের অত্যাচার করেছেন। তাহলে বারবার ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা আদতে কারা করছেন? জবাব আছে অমিত শাহবাবুদের কাছে?
আরও পড়ুন : বিজেপি মানেই ‘অশিক্ষিত’? বাজপেয়ী থেকে যোগী, কার দৌড় কতটা
স্বয়ং যোগী আদিত্যনাথ নামকরণের ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। উঠতে বসতে নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে প্রবল উৎসাহী তিনি। এলাহাবাদের নাম বদলে দিয়ে রেখেছেন ‘প্রয়াগরাজ’, ফৈজাবাদ হয়েছে ‘অযোধ্যা’, মুঘলসরাই হয়েছে ‘পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়। নাম পরিবরতনা হচ্ছে ,আভাল কথা। কিন্তু এখানে কোনও সূত্র দেখতে পাচ্ছেন? যাহা ছিল আর যাহা হইল, এর মধ্যে খুব পরিষ্কার একটি একমুখী স্রোত কাজ করছে। ইতিহাসের ‘ঘর ওয়াপসি’ বলা যায় কি? কেবল শহরের নাম নয়, আজমগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও বদলে করা হয়েছে ‘মহারাজা সুহলদেব বিশ্ববিদ্যালয়’। আগ্রায় নির্মীয়মাণ মুঘল মিউজিয়ামের পরিচয় হবে শিবাজীর নামে। এঁরাও অবশ্যই ইতিহাসের অংশ, সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসক দল তথা বিজেপির এমন ইতিহাস কি একটি নির্দিষ্ট অংশকে মুছে ফেলতে চাইছে? ইতিহাস বিকৃতি আসলে কি তাঁরাই করছেন না বারবার? সমস্ত জায়গা থেকে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর, নির্দিষ্ট ধর্মের, নির্দিষ্ট জাতির ইতিহাসকে মুছে ফেলে যে গৈরিকীকরণের সূত্রপাত, সেটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই প্রভাবিত করছে না?
আরেকটু যদি তলিয়ে দেখি, ইতিহাস কাকে বলে? মুঘল শাসন, ফরাসি বিপ্লব, স্বাধীনতা আন্দোলনই কি কেবল ইতিহাসের মানদণ্ড? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা হচ্ছে, সেটাও ইতিহাসের দর্শনকে প্রভাবিত করছে। ২০১৪ সাল থেকে সেই জীবনে অদ্ভুত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব হয়েছে। ‘হোয়াটসআপ ইউনিভার্সিটি’। বিভিন্ন ‘নিত্যনতুন’ তথ্যের সঙ্গে আমরা প্রতিদিন পরিচিত হচ্ছি, যা আদতে একেবারেই সত্য নয়। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে অহরহ ভুয়ো খবরের প্রচার, ছয়লাপ, শাসক দলের আইটি সেলের তাণ্ডব- সবই এখন প্রচণ্ডভাবে সত্য। যে ‘সত্যের’ বশে এবিভিপির এক নেত্রী মঞ্চে দাঁড়িয়ে গলা খুলে বলতে পারেন, ভারত এখনও স্বাধীন হয়নি। ইংরেজরা ৯৯ বছরের লিজে দিয়েছে এই স্বাধীনতা। বিশেষ করে করোনাকালীন ভারতে যেখানে সবাই ঘরবন্দি, সেখানে এমন ভুয়ো খবরের সমারোহ প্রচুর দেখা গিয়েছে। ২০১৪ সালের রাওয়ালপিন্ডি বাজারের ছবি ভাইরাল হয়ে যায় কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার ছবি হিসেবে। আমরাও কিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ি দোষারোপের ঝুলি কাঁধে নিয়ে। ২০২০ সালেই তেলেনিপাড়ার সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোলের কথা আশা করি সবার মনে পড়বে। সেখানেও ইন্ধন জুগিয়েছিল এই ভুয়ো খবরই। আইটি সেলের অহরহ প্রচারের দরুণ জনতা এটাই ভেবেছিল, মুসলিমরাই হলেন করোনার প্রকৃত বাহক ও ধারক। এছাড়াও পাকিস্তানের ভিডিও প্রচার করে বলা হয়, তেলেনিপাড়ায় ‘হিন্দু খতরেমে হ্যায়’। মনে আছে সাম্প্রতিক সময় দিল্লি দাঙ্গা? তাই এখন গণ্ডগোল হলে পুলিস সবার আগে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। কারণটা সহজেই অনুমেয়।
আরও পড়ুন : উগ্র হিন্দুত্বর বিরুদ্ধে জেহাদ! দলিত জাগরণের নেপথ্যের নায়ক পেরিয়ার
কেন এই কথাগুলো এল? কারণ, দৈনন্দিন ঘটে চলা এমন ঘটনাও ইতিহাসেরই অংশ। ক্রমাগত ভুয়ো খবর ছড়িয়ে সত্যকে বিকৃত করা কি ইতিহাসেরও বিকৃতিকরণ নয়? ইতিহাস যুক্তি দেখে, তার নিজস্ব বিজ্ঞানচেতনা আছে, নিজস্ব দর্শন আছে। সেসব মুছে ফেলে একপাক্ষিক সত্য বা অর্ধসত্য বা মিথ্যা প্রচার কি আদৌ ভারত নামক দেশকে সম্মানিত করছে? অমর্ত্য সেন বারবার শিক্ষকদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়েছেন। আর অমিত শাহরা সেই শিক্ষক ছাত্রদেরই আহ্বান জানাচ্ছেন ইতিহাস বদলানোর জন্য। অবশ্য আগামী কয়েক বছরে এই কাজটি শুরু হলে আশ্চর্য হবেন না অনেকে। ইতিমধ্যেই দেশের অধিকাংশ রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি। কেন্দ্রেও তাদেরই সরকার। “কে আমাদের আটকাচ্ছে?” অমিত শাহের একটি কথাতেই সেই ঔদ্ধত্য সামনে আসে। অর্থ, ক্ষমতা, সংবাদমাধ্যম, আইটি সেল সমস্ত কিছুই যখন হাতে, তখন তথ্য বিকৃতি করতে ক্ষতি কি?