কুতুব মিনার নিয়েও বিতর্ক! কারা, কেন ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করতে চাইছে?
ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে কুতুব মিনার গুরত্বপূর্ণ।
ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কুতুব মিনার। প্রাচীন এই স্থাপত্যের নাম পরিবর্তনের দাবিতে তোলপাড় দেশ। এর মধ্যেই এক চাঞ্চল্যকর দাবি করলেন ভারতীয় সর্বেক্ষণ বিভাগের (আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার) প্রাক্তন রিজিওন্যাল ডিরেক্টর ধরমবীর শর্মা। তাঁর দাবি, পঞ্চম শতকে কুতুব মিনার তৈরি করেছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য, কুতুবুদ্দিন আইবক নন। তাঁর কথায়, "এটা কুতুব মিনার ছিল না। এটা আসলে ছিল সূর্য টাওয়ার। সূর্যের অবস্থান দেখার জন্য এই টাওয়ার তৈরি করা হয়েছিল। এটা তৈরি করেছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য। আমার কাছে এর স্বপক্ষে অনেক প্রমাণ আছে।“ কুতুব মিনার নিয়ে এএসআই-এর হয়ে অনেক বছর ধরে তিনি সমীক্ষা চালাচ্ছেন। তাঁর দাবি এটা বৈজ্ঞানিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য।
এএসআইয়ের এই প্রাক্তন আধিকারিকের আরও দাবি, সূর্যের উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণের মধ্যবর্তী সময়, অর্থাৎ ২১ জুন সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য এই মিনারটি বানানো হয়। এই মিনারটি ২৫ ইঞ্চি হেলানো। সূর্যের আলোয় যাতে মিনারের কোনও ছায়া না পড়ে সেইভাবেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বানানো হয়েছিল এই মিনার।
বাবরি মসজিদের নিচে থাকা মন্দিরের অংশ রামমন্দির প্রতিষ্ঠায় প্রমাণ হিসেবে কাজ করেছে! অযোধ্যায় রামমন্দিরের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের একাধিক জায়গাতে মসজিদের নিচে মন্দিরের ঘটনা সামনেও এসেছে। "তাজমহল আসলে তেজো মহালয় নামের একটি শিব মন্দির"- এ-দাবিও উঠে গিয়েছে ইতিমধ্যে! এবার এসবকে সামনে রেখেই প্রাচীন স্থাপত্যে কুতুব মিনারের নাম পরিবর্তনের দাবি উঠল৷ এবং শুধু দাবিই নয়! এই নিয়ে রীতিমতো বিক্ষোভ হয় রাজধানী শহরজুড়ে!
আরও পড়ুন: তাজমহল বনাম তেজো মহালয় || কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে
হিন্দু সংগঠন মহাকাল মানব সেবার বেশ কয়েকজন সদস্য রাজধানীর বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ কুতুব মিনারের বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন৷ তাঁদের দাবি 'কুতুব মিনার'-এর নাম পরিবর্তন করে 'বিষ্ণু স্তম্ভ' রাখতে হবে। এই প্রথম কোনও হিন্দু সংগঠন সরাসরি রাস্তায় নেমে মিনারটিকে বিষ্ণু স্তম্ভ বলে দাবি করেছে।
কুতুব মিনারকে বিষ্ণু স্তম্ভ বানানোর চেষ্টা হিন্দুত্ববাদী সংগঠন অনেকদিন ধরে চালিয়ে আসছে। সালটা ২০১৮। তখন হিন্দু নববর্ষ ক্যালেন্ডারে কুতুব মিনারের ছবির পাশে বিষ্ণু স্তম্ভ লেখা নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়েছিল। শুধু কুতুব মিনার নয়, মুঘল জমানার সাতটি মসজিদ ও স্মৃতিস্তম্ভকে হিন্দু মন্দির বলে দাবি করা হয় এই ক্যালেন্ডারে, যে তালিকায় রয়েছিল তাজমহলও। তাজমহলের নামের পাশে লেখা ছিল তেজো মহালয় মন্দির। মধ্যপ্রদেশের কমল মৌলা মসজিদ আসলে ভোজশালা বলে দাবি করা হয়। কাশীর জ্ঞানবাপি মসজিদের ছবির পাশে লেখা বিশ্বনাথ মন্দির, জৌনপুরের আটালা মসজিদের ছবির পাশে লেখা অটলা দেবী মন্দির এবং অযোধ্যায় করসেবকদের হাতে ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদের ছবির পাশে লেখা রয়েছে রামজন্মভূমি।
হিন্দু মহাসভার ন্যাশনাল সেক্রেটারি পূজা শাকুন এই ক্যালেন্ডার প্রকাশকালে এক বিতর্কিত দাবি করেছিলেন। বলেছিলেন, "এই পবিত্র হিন্দু ক্যালেন্ডার প্রকাশ উপলক্ষে আমরা যাগ-যজ্ঞের আয়োজন করি এবং এই দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার শপথ নিই।" হিন্দুরাষ্ট্র! ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা উধাও! এর চেয়ে সর্বনাশা দাবি আর কী হতে পারে!
তিনি আরও বলেন, "বিদেশি আক্রমণকারীরা হিন্দুদের ধর্মীয় স্থানগুলি ধ্বংস করে মসজিদে পরিণত করে। এখন সেগুলো আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। যেমন এই ক্যালেন্ডারে বলা হয়েছে, সেকরমই এই মন্দিরগুলোর আসল নাম আমরা ফিরিয়ে দেব।"
ইট দিয়ে তৈরি পৃথিবীর উচ্চতম স্তম্ভ হল কুতুব মিনার। উচ্চতা প্রায় ৭৩ মিটার। এর মধ্যে ৩৭৯ ধাপের সিঁড়ি রয়েছে। এর ভেতরের ব্যাসার্ধ ১৩.৩২ মিটার। ২.৭৫ মিটার ব্যাসার্ধ এর চূড়ার অংশের। কুতুবউদ্দিন আইবকের নামে নামাঙ্কিত বলে মনে করা হলেও, এই নিয়ে দ্বিমত রয়েছে ইতিহাসবিদদের মধ্যে। আজ প্রাক্তন আইএসআই আধিকারিকের দাবি সেই নিয়ে বিতর্ক আরও উসকে দিল। প্রার্থনার জন্যই নির্মিত হয়েছিল কুতুব মিনার। এর চার পাশে অন্য অনেক সৌধ রয়েছে। ইউনেসকো-র ঐতিহ্য তালিকায় সেটি রয়েছে। কুতুব মিনারকে ঘিরে রয়েছে অজস্র ঐতিহাসিক সৌধ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লৌহ স্তম্ভ, উয়ত-উল-ইসলাম মসজিদ, আলাই দরওয়াজা, ইলতুৎমিসের সমাধি, আলাই স্তম্ভ, আলাউদ্দিনের মাদ্রাসা এবং সমাধি, ইমাম জামিনের সমাধি। ২০০০ বছর আগে নির্মিত হলেও কুতুব মিনারের লৌহ স্তম্ভে আজও জং ধরেনি, যা বিরল ঘটনা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কুতুব মিনার নিয়ে আমাদের এতদিনের চেনাশোনা ইতিহাস অন্য কথা বলে। ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবকের আদেশে কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে, তবে মিনারের ওপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে (তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া)। ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে কুতুব মিনার গুরত্বপূর্ণ।
এর আশপাশে আরও বেশ কিছু প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় স্থাপনা এবং ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যা একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। এই কমপ্লেক্সটি ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে তালিকাবদ্ধ হয়েছে এবং এটি দিল্লির অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। এটি ২০০৬ সালে সর্বোচ্চ পরিদর্শিত সৌধ, পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৩৮.৯৫ লাখ, যা তাজমহলের চেয়েও বেশি, যেখানে তাজমহলের পর্যটন সংখ্যা ছিল ২৫.৪ লাখ।
হিন্দুত্ববাদীরা কুতুব মিনারের নাম পরিবর্তনের যে হিড়িক তুলেছেন, তা তাঁদের কোনও নতুন প্রচেষ্টা নয়। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে প্রথম ক্ষমতায় আসে যোগী সরকার৷ তারপর থেকে মুঘলসরাই, এলাহাবাদ-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নাম বদলে দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। যোগী আমলে এলাহাবাদ হয়েছে প্রয়াগরাজ৷ মুঘলসরাই স্টেশন হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন৷ বিজেপি-বিরোধীদের বলতে শোনা গেছে, এসব বিজেপি নেতারা করেছেন সাধারণ মানুষের নজর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি থেকে ঘুরিয়ে দিতে। এত রাজনীতির গন্ধ লাগুক বা না লাগুক, মোদ্দা কথা হল, ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখতে এখানে বারবার আসেন বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুরা। একথা বলাই বাহুল্য।