বুড়ো হাড়ে ভেলকি! ভিনটেজ ল্যান্ডরোভার পাড়ি জমাবে হিমালয়ে

ছোট্ট সরোজেশ (মুখার্জি) যখন ছুটিতে বিহারে কোলিয়ারিতে যেত, তখন তার মনপ্রাণজুড়ে থাকত পারিবারিক ল্যান্ডরোভার গাড়িটি। ট্রেলারযুক্ত গাড়িটি চালাতেন ওর কাকা। যখন সরোজেশকে গাড়ির বনেটে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত, তখন ছোট্ট মানুষটি ভাবত- আমি পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়ে আছি। ওঁর কাকা একবার ল্যান্ডরোভারের চাকা খুলে শুধু রিমের ওপর কোলিয়ারির ট্রেন লাইনের ওপর দিয়ে গাড়িটি চালিয়েছিলেন। ল্যান্ডরোভার চলে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় শিশু সরোজেশের মনটিকে, দূরে, অনেক দূরে, যেখানে মেঘের পাহাড়, মেঘের সমুদ্র, মেঘের স্বপ্নপুরী।

তখন শিলিগুড়িতে নেমে দার্জিলিং যাওয়ার দু'-টি রাস্তা ছিল, হয় টয় ট্রেন। কু ঝিক ঝিক করে বাতাসিয়া লুপ, ঘুম হয়ে শৈল শহরে পৌঁছনো, অথবা ল্যান্ডরোভার গাড়িতে যাওয়া। ল্যান্ডরোভার পাহাড়ে ওঠায় পারদর্শী। টাইগার হিলে ভ্রমণপিপাসুদের একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল ল্যান্ডরোভার। ব্রিটিশ গাড়ি। ইংরেজরা চলে গেলেও হিমালয়ের রানির কাছে তারা ল্যান্ডরোভারকে রেখে গিয়েছিল। কালের প্রভাবে পুরনো গাড়িগুলো বসে গেছে। যেগুলো চলে, তা বাইরে থেকে ল্যান্ডরোভারের মতো দেখতে হলেও তার ইঞ্জিন হয় বোলেরো বা স্করপিও-র অথবা মিথসুবিসি-র!

সরোজেশ মুখার্জিও ল্যান্ডরোভার করেই দার্জিলিং গেছেন বহুবার। কিন্তু কেউ কি জানত যে, আগামী দিনে ল্যান্ড রোভার হয়ে উঠবে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। কলকাতার বুকে রবিবার যে ল্যান্ডরোভারের স্টিয়ারিংয়ে বসে থাকা মানুষটিকে দেখা যায়; হ্যাঁ, তিনিই সরোজেশ মুখার্জি, ভদ্র, নম্র, রুচিশীল, অত্যন্ত রসিক একজন মানুষ। সরোজেশ কথা বলেন ল্যান্ডরোভারের সঙ্গে, বোঝেন ওর ভাষা আর তাই মাইলের পর মাইল অনায়াসে অতিক্রম করতে পারেন সাধের অযান্ত্রিককে নিয়ে। যদি সব ঠিকঠাক থাকে, তবে সরোজেশবাবু ১৯৭৪ সালে তৈরি একটি ল্যান্ডরোভার নিয়ে হিমালয়ান র‍্যালিতে যোগ দেবেন বলে ঠিক করেছেন। কলকাতা থেকে দিল্লি, সেখান থেকে মুসৌরি-সহ বিভিন্ন শহর ঘুরে আবার দিল্লিতে ফিরে আসবেন। সঙ্গী হওয়ার কথা আনন্দ চৌধুরীর, আরেক পুরনো গাড়ি প্রেমিকের।

আরও পড়ুন: এই স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, এখন কেমন আছে নীলু?

সিরিজ থ্রি ল্যান্ডরোভার গাড়িটি ব্রিটিশ রেড ক্রস ভারতে আনে ১৯৭৪ সালে। উত্তরাখণ্ড, গাড়োয়াল- বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গাড়িটিকে ব্যবহার করা হত ওষুধ বিলি করার জন্য। বহু পাহাড়ি পথ অতিক্রম করেছে গাড়িটি। তারপর একসময় ব্যাঙ্গালোরের এক ভদ্রলোক গাড়িটিকে কিনে নেন। বেশ কিছুদিন তিনি ব্যবহার করে এটিকে এবং তারপর এক সময় সিঙ্গাপুরে চলে যান। ল্যান্ডরোভার পড়ে থাকে ব্যাঙ্গালোরে অনেকটা অযত্নে, অবহেলায়।

সরোজেশবাবু যখন গাড়িটি হাতে পান, তখন বছর ১৫-২০ গাড়িটি ব্যবহার করা হয়নি। গাড়িটি চালু করা এক বিরাট লড়াই। কারাবোরেটার, ওপটার পাম্প ঠিক করে চালু করা, রঙ করা, অন্যান্য যন্ত্রাংশ সারিয়ে তোলা- এক অসাধ্যকে সম্ভব করেছেন সরোজেশবাবু। ইতিহাসের একনিষ্ঠ সেবকের খেয়াল ছিল, যেন অরিজিনাল থাকে গাড়িটি। ফোর হুইল ড্রাইভেও গাড়িটি চালানো যায়। রংটং করে বাবু এখন এত ফিটফাট যে, কে বলবে আর দু'-বছর পরেই তার ৫০ বছর বয়স হবে। পঞ্চাশেও তরতাজা যুবক ল্যান্ড রোভারটি।

সরোজেশবাবুর দ্বিতীয় ল্যান্ডরোভারটির নয় নয় করে বয়স হল ৬৩ বছর। ১৯৫৯ সালে তৈরি এই গাড়িটিকে এদেশে আনে UNICEF। বিশ্ব সংস্থা যেমন- UNICEF, UNESCO, World Bank প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলি এদের অফিসারদের জন্য ল্যান্ডরোভার নিয়ে আসত। গাড়িগুলি এতটাই শক্তপোক্ত যে, যে-কোনও রাস্তা দিয়ে বা রাস্তা না থাকলে মেঠো পথ দিয়ে এরা অনায়াসে চলতে পারত। ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনের বেশ কয়েকটা ল্যান্ডরোভার ছিল।

গত শতাব্দীর সাতের দশকে এই গাড়িটি একজন নেপালি ব্যবসায়ী কিনে নেন এবং সন্তানের যত্নে তিনি গাড়িটিকে রেখেছিলেন। গাড়িটিকে তিনি নিয়মিত ব্যবহার করতেন। শিলিগুড়ি-দার্জিলিং রুটে নিয়মিত চলত ল্যান্ডরোভারটি। ভদ্রলোক যখন শরীরে অপটু হয়ে পড়েন তখন গাড়িটিও আর নিয়মিত চলত না। চার সিলিন্ডারের গাড়িটিকে ফোর হুইল ড্রাইভে চালানো যায়। এটিকে নিয়েও সরোজেশবাবু এবার হিমালয়ান র‍্যালিতে যেতে পারতেন, কিন্তু যেটি যাচ্ছে সেটি আকারে বড় হওয়ার জন্য তিনি বেছে নিচ্ছেন।

সরোজেশবাবুর ল্যান্ডরোভারের প্রতি প্রেম রানি এলিজাবেথের সঙ্গে তুলনীয়। রানির যখন বয়স কম, তখন নিয়মিত রোলস রয়েস নিজে চালাতেন। উইন্ডসর ক্যাসেল থেকে বাকিংহ্যাম প্যালেস কতবার যে তিনি রোলস রয়েস চালিয়ে গেছেন, তার হিসেব কেউ রাখেনি। রানির প্রিয় গাড়ির মধ্যে রয়েছে রেঞ্জ রোভার। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন রানির সঙ্গে সস্ত্রীক দেখা করতে যান, তখন মধ্যাহ্নভোজের পরে অনেকটা সময় তাঁরা একসঙ্গে কাটান। রানি অতিথিদের তাঁর গাড়ি চালানোর গল্প বলেন এবং বয়স হয়ে যাওয়ার জন্য আর রেঞ্জ রোভারটি চালাতে পারেন না বলে আক্ষেপ করেন। রানির যে মোটরকেভ আছে, তাতে বেশ কয়েকটি রেঞ্জ রোভার থাকে।

সরোজেশবাবুর লাক্সারি রেঞ্জ রোভারটি গুডরিক চা কোম্পানি তাদের ইংরেজ টি সেক্টরের জন্য ১৯৮৪ সালে বিলেত থেকে ইমপোর্ট করে। ঢাউস, অত্যন্ত বিলাসবহুল গাড়িটি দার্জিলিং এবং তার আশপাশে চলত। ইংরেজ সাহেব নিজেই চালাতেন আর বড় সাহেবের গাড়ি, তাই একে যত্নও করা হত। ধুয়েমুছে চকচক করে রাখা হত গাড়িটিকে। সাড়ে তিন লিটারের ইঞ্জিনের রেঞ্জ রোভারের বৈশিষ্ট্য হল গাড়িটি কোথাও খারাপ রাস্তায় আটকে গেলে ডিফারেনশিয়াল লক করে গাড়িটিকে বের করে নেওয়া যায়। উড়িষ্যার জঙ্গলে গাড়িটি এইরকম মেঠো রাস্তায় আটকে গেলে ডিফারেনশিয়াল লক ব্যবহার করে সরোজেশবাবু সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসেন।

সাহেব বাবুটি অবসর নিয়ে স্বদেশে ফিরে গেলে গাড়িটির যত্ন কমে যায়। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি গাড়ির স্থান হয় গুরুসদয় দত্ত রোডের বাগানে এবং ড্রাইভাররা গাড়িটিকে তাদের আলমারি হিসেবে ব্যবহার করত। চাকা যখন বসে গেল, একসময় ধুলোতে ভরে গেল- তখন কে বলবে যে একসময় অফিসের বাইরে গাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকলে তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সাহস কারও ছিল না।

চার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম করে মুখার্জিমশাই গাড়িটিকে আবার চালু করলেন। গাড়ির যন্ত্রাংশ পেতে খুব বেগ পেতে হল না, কারণ ইংল্যান্ডে গাড়ির পার্টস পাওয়া যায়। রোভার কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে, ১৯৭০ এবং ২০০৬-এর গোড়া অবধি মডেল প্রায় একই রেখেছিল এবং সেটা সরোজেশবাবুর পক্ষে একটা বড় সুবিধা হয়।

গাড়ি তো তৈরি হল, কিন্তু কেমন হল তার চাল, সে কি পুরোনো শক্তি ফিরে পেয়েছে- তা দেখতে সরোজেশবাবু গাড়িটিকে প্রায় এক লক্ষ কিলোমিটার চালিয়েছেন। কোথায় গেছে আর কোথায় যায়নি রেঞ্জ রোভারটি! দার্জিলিং, সিকিম, অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যার জঙ্গল- সর্বত্রই তার স্বছন্দ যাতায়াত। কে বলবে ওর ৩৮ বছর বয়স হল! স্টার্ট করলে মনে হবে সেদিনের যুবক, যে কোনও লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।

ছোটবেলার সেই স্বপ্ন এখনও সরোজেশবাবু দেখেন। আর তাই সময় পেলেই ওদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কালো রাস্তা দিয়ে, দু'-দিকের ধানের খেত ফেলে যখন ল্যান্ডরোভার বা রেঞ্জ রোভার ছোটে- তখন সরোজেশবাবুর মুখে গর্বের হাসি। দেখো বন্ধু, আমি তোমাদের ফেলে দিইনি, যত্ন করে বন্ধুত্বকে বহন করে নিয়ে চলেছি– এ যেন অজানা এক পথ, জানি না কোথায় হবে শেষ!

More Articles