করোনায় এত মৃত্যু কি আসলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অবহেলায়?

কোভিড অতিমারীর শুরুতে 'ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজে়শন' অর্থাৎ WHO-র তরফে জানানো হয়েছিল নোভেল করোনাভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। জানানো হয়েছিল, নোভেল করোনাভাইরাস ছড়ায় এয়ার ড্রপলেটের মাধ্যমে। যা তৈরি হয় কোভিড-আক্রান্ত ব্যক্তির কথা বলার সময় কিংবা নিশ্বাস ও হাঁচি-কাশির সাথে নির্গত কফ, থুতু ও সর্দির ছিটের থেকে। আর সেই এয়ার ড্রপলেট  (Air Droplet) এক মিটারের বেশি দূর অবধি ছড়াতে পারে না। তার আগেই থিতিয়ে যায় মাটিতে। তাই এই ভাইরাসকে বায়ু-সংক্রমিত বা এয়ারবোর্ন  (Airborne) কোনওমতেই বলা যায় না, এই ছিল হু-এর প্রাথমিক বক্তব্য।

তারপর গত বছর ২৩ ডিসেম্বর হু নিজেদের কোভিড নির্দেশাবলি সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইটে খুব সন্তর্পণে একটি শব্দের উল্লেখ করে নোভেল করোনাভাইরাস বিষয়ে। শব্দটি হল 'এয়ারবোর্ন' অর্থাৎ, বায়ুবাহিত বা বায়ু-সংক্রমিত।

হু-এর ওয়েবসাইটের একটি পেজ, সেই পেজের প্রতিবেদনের শিরোনামে লেখা 'করোনাভাইরাস ডিজিজ (কোভিড-১৯): হাউ ইট ইজ় ট্রান্সমিটেড?' (Coronavirus Disease (Covid-19): How it is transmitted?) যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'করোনাভাইরাস অসুখ (কোভিড-১৯): কীভাবে এটি ছড়ায়?'

আরও পড়ুন: করোনার XE সাব-ভ্যারিয়েন্ট কী? কতটা ক্ষতিকর ভাইরাসের এই নতুন রূপ?

এই প্রতিবেদনেই এয়ারবোর্ন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে হু এবং খুব নিঃশব্দে তা পুনরায় সম্পাদন করে লেখা হয়, কোনও ব্যক্তি তখনই কোভিডে আক্রান্ত হতে পারে, "যখন সংক্রামক কণাগুলি খুব অল্প দূরত্বের মধ্যেই বাতাসের মাধ্যমে ভেসে যায়  ও মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।" বিজ্ঞানের ভাষায় কিন্তু একেই বলে স্বল্প-দূরত্বে প্রসারিত বায়ুবাহিত সংক্রমণ। সেই পেজেই আবার বলা আছে, 'লং-রেঞ্জ এয়ারবোর্ন ট্রান্সমিশন' অর্থাৎ সংক্রমণ বেশ খানিক দূর অবধিও হতে পারে বাতাসের মাধ্যমে। তা সম্ভব জনবহুল এলাকায়। অথবা, বদ্ধ স্থানে অনেক মানুষ একত্রিত হলে এবং সেখানে বায়ুচলাচল বা ভেন্টিলেশন পর্যাপ্তভাবে না হলে।

বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে, কোভিডের জন্যে দায়ী নোভেল করোনাভাইরাস যে এয়ারবোর্ন বা বায়ুপ্রবাহিত, তা জনসমক্ষে বলতে, বা এই ভাইরাসকে সত্যি এয়ারবোর্ন স্বীকার করে নিতে এতদিন সময় লাগল হু-এর? তা-ও অতিমারীর দুই বছর পরে! এই তথ্য কি সাধারণ মানুষকে আগেভাগে দিয়ে নোভেল করোনাভাইরাসের বায়ুর মাধ্যমে ছড়ানোর সম্ভাবনা সম্পর্কে সাবধান করা যেত না? এত লাখ লাখ মৃত্যু কি আগেই আটকানো যেত না, অন্তত বায়ুর মাধ্যমে এর সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রকাশ করে?

২০২০ সালের অক্টোবর মাসে হু প্রথম জানায় কোভিড ছড়ায় এরোসলের (Aerosol) মাধ্যমে।

এরোসল কী? বায়ুতে ভাসমান কোনও কণা, যার ভেসে বেড়াতে অবশ্যই বায়ুর সাহায্য লাগে। এখানেই ষ্পষ্ট, এরোসলের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে মানে, তা এয়ারবোর্ন। হ্যাঁ, অবশ্যই এই বায়ুতে ভাসমান কোভিড ভাইরাসে কণা কুড়ি মিটার দূরে গিয়ে ছড়ায় না, কিন্তু তা নিঃসন্দেহে বাতাসের মধ্য দিয়ে ছড়ায়, এমনকী, দুই মিটারের থেকে অনেকটা বেশি দূর অবধি-ই।

কিন্তু খুব নিখুঁতভাবে 'এয়ারবোর্ন' শব্দটি তার পরেও এড়িয়ে যায় হু। এরোসল শব্দটি কত মানুষের কাছেই বা পরিচিত? এয়ারবোর্ন বা বায়ু-সংক্রমিত শব্দটি ব্যবহার করলে সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি অনেক আগেই পরিষ্কার হতে পারত না কী?

অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রায় অতিমারীর প্রথম দিন থেকেই বলার চেষ্টা করছেন, কোভিড সংক্রমণে বাতাসের ভূমিকা।

আরও পড়ুন: মনের শরীর-গতিক আর আমাদের বোঝা না বোঝা || কথোপকথনে রত্নাবলী রায়

কেবল হু-কেই নয়, কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সি.ডি.সি (CDC) বা 'সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন'-কে (Centres for Disease Control and Prevention)। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সিডিসি নিজেদের ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদনে জানায়, কোভিডের ভাইরাস এয়ারবোর্ন। কিন্তু মাঝরাতে সন্তর্পণে সেই প্রতিবেদন সরিয়েও ফেলা হয়। তখন মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি কোভিডের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।

নেচার জার্নালের (Nature Journal) নেওয়া সাক্ষাৎকারগুলিতে একাধিক বিশেষজ্ঞ হু-এর এই গড়িমসিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে হু নিজেদের প্রাথমিক বক্তব্য- অর্থাৎ, কোভিড যে বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না, তা সংশোধন করতে অপারগ হয়েছে। শুধু তাই নয়, নতুন এই বক্তব্যকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করতেও গড়িমসি দেখিয়েছে, যার ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তো হয়েছে। মাশুল গুনতে হয়েছে সাধারণ মানুষকেই, যা হু-ই আটকাতে পারত অনেক আগে।

হু-কে শুরুতেই সতর্ক করেছিলেন একাধিক অতিমারীবিদ। তাঁদের হাতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছিল, যা থেকে স্পষ্ট দেখা যায় কোভিডের ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়। হু কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেনি একবারও।

একথা সত্যি যে, ওই মহামারীবিদদের এই বিষয়ে আরও বিশদে  গবেষণার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু অতিমারীর সময়ে বিশদে গবেষণা সম্ভব নয় বিভিন্ন কারণে। এবং বিশদ গবেষণার আগেও প্রয়োজন মানুষকে সতর্ক করা। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যা হু করেনি।

কোভিডবিধির সতর্কতা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে হু বরাবর নির্ভর করে এসেছে নিজেদের সংস্থার বিশেষজ্ঞদের দলকে। আর এই দলটির অনেকেরই বায়ুবাহিত রোগ নিয়ে বিশেষ জ্ঞান নেই।

ব্রিসবেনের ক্যুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির এরোসল সায়েন্টিস্ট লিডিয়া মোরাওয়াস্কা নেচার নিউজ-কে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করে জানিয়েছেন, হু অনেক দেরি করে ঘরের ভেতর ভেন্টিলেট বা বায়ু-চলাচল  নিয়ে মানুষকে সচেতন করা শুরু করেছে। তা-ও খুব স্পষ্টভাবে কখনওই জানায়নি, কোন পরিস্থিতিতে এবং কীভাবে ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন, যাতে এরোসলের মাধ্যমে কোভিড সংক্রমণের হার কমানো যায়।

হু-এর গ্লোবাল আউটব্রেক অ্যালার্ট এবং রেসপন্স কমিটির চেয়ারপার্সন ডেল ফিশার, তিনি এর পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের  ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি হসপিটালের সংক্রামক-ব্যধির চিকিৎসকও বটে। নেচার নিউজ়কে উনি জানিয়েছেন, "আমাদের (হু-এর) মনে হয় না, আমাদের এই সতর্কতা আগেভাগে জারি না করার জন্যেই কোভিড এরকম বিধ্বংসী রূপ দেখিয়েছে।"

লিডিয়া মোরাওয়াস্কা ২০২০ সালের মার্চ মাসে একটি আন্তর্জাতিক দল গঠন করেন। সেই দলে উপস্থিত ছিলেন এরোসল সায়েন্টিস্ট, সংক্রামক-ব্যধি বিশেষজ্ঞ, এবং ভেন্টিলেশন ইঞ্জিনিয়ার। এই দল বেশ কয়েকটি তথ্যপ্রমাণ পেশ করে হু-য়ের সামনে। যেখানে দেখা যায়, মানুষ আদতেই এক মিটারের থেকেও অনেক বেশি দূরত্বে কোভিড-আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে সংক্রমিত হচ্ছে।

এই দলের বিভিন্ন গবেষক মেকানিস্টিক স্টাডির সাহায্যে হাতে-নাতে দেখিয়ে দেন কথা বলার সময় নির্গত থুতুর ছিটেফোঁটা কীভাবে বাতাসে মিশে যায়, আর সেই বাতাস কীভাবে দীর্ঘক্ষণ বদ্ধ ঘরে জমা থাকে। এখানে পাঠককে জানানো প্রয়োজন মেকানিস্টিক স্টাডি কী। মেকানিস্টিক স্টাডি বলতে বোঝায় কোনও রোগের ধরণ, সংক্রমণের পদ্ধতি, রোগের ফলে শারিরীক ক্ষতি কী কী হতে পারে, সেই বিষয়ে পঠন-পাঠন।

লিডিয়া এবং অন্যান্যরা, যারা দীর্ঘদিন এরোসল এবং বায়ুবাহিত রোগ নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা জানান হু-এর কাছে এতদিন পরেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই, যা দিয়ে পরীক্ষা করা যাবে বাতাসের মাধ্যমে কোভিডের সংক্রমণ কীভাবে হয়।

পাশাপাশি হু-এর বিভিন্ন সদস্য কেবল হাসপাতালের বদ্ধ ঘরে কীভাবে সংক্রমণ হবে, সেদিকেই আলোকপাত করেছে। এমনকী, হু-এর গ্লোবাল আউটব্রেক অ্যালার্ট এবং রেসপন্স কমিটিতে কোনও পদার্থবিদ নেই, যাঁর এরোসলের মাধ্যমে ভাইরাসের কণা কীভাবে ছড়াতে পারে, সেই বিষয়ে সুগভীর ও পর্যাপ্ত জ্ঞান আছে।

কেবল লিডিয়াই নয়, ইউনিভার্সিটি অফ হংকং-এর এনভায়রনমেন্ট বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ার ইউগুলো লি এবং নেদারল্যান্ডসের আইন্ডহোভেন ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির ইন্ডোর-এয়ার-কোয়ালিটির (ঘরের ভেতরকার বাতাসের গুণমাণ) পদার্থবিদ মার্সেল লুমাসও নোভেল করোনাভাইরাসের বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর বিষয়ে একই বক্তব্য পেশ করেছেন।

মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডের পদার্থবিদ ডন মিল্টন জানাচ্ছেন, ড্রপলেট ভাইরাস আর এয়ারবোর্ন ভাইরাসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে আলাদা, তা অনেক আগেই প্রমাণ করেছেন গবেষকরা। সেখানে হু তো অবগত ছিলই যে, নোভেল করোনাভাইরাস বাতাসেই অনেক দূর ভেসে যেতে পারে। এবং তা কোনওভাবেই ড্রপলেট ভাইরাস হতে পারে না।

ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ডের প্রাথমিক-চিকিৎসা বিষয়ক গবেষক ট্রিশ গ্রিনহলঘের মতে কীভাবে নোভেল করোনাভাইরাস ছড়ায়, তা শনাক্ত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে হু, বিশেষ করে সামনে যখন সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল, ভাইরাসটি বাতাসের মাধ্যমেও ছড়াতেও পারে।

হু ঠিক সময় নড়েচড়ে বসলে অনেক আগেই থেকে হাসপাতালগুলোতে যথার্থ ভেন্টিলেশন মেশিন বসানো যেতে পারত, যাতে নেগেটিভ এয়ার প্রেশার তৈরি হয়ে রুমের মধ্যে যথেষ্ঠভাবে বায়ু চলাচল বাড়ে। এবং সবার জন্য আরামদায়ক এন৯৫ মাস্কেরও প্রচলন করা সম্ভব হত।

শুধু তাই নয়, এয়ারবোর্ন শব্দটি নোভেল করোনভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার পরও জনসাধারণের মধ্যে সেই বিষয়ে চেতনা বৃদ্ধি করতেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে হু।

ইউনিভার্সিটি অফ হংকং এর এনভায়রনমেন্ট বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ার  ইউগুলো লিয়ের মতে হু হয়তো বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে আগেভাগেই নোভেল করোনাভাইরাসকে বায়ুপ্রবাহিত বা এয়ারবোর্ন বলে ঘোষণা করেনি। সে যুক্তি তা-ও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু যেখানে একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির ভাইরাস, যার সম্পর্কে আমরা কেউই কিছু জানি না; এবং সে বারে বারে রূপ বদল করে আমাদের ধাঁধায় ফেলছে, তখন কি হু-এর দায়িত্ব ছিল না এই ভাইরাসের বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর সম্ভাবনার কথা সাধারণ মানুষকে জানানো?

 

More Articles