বিবেকানন্দর জীবনে ফিরে ফিরে এসেছে উনিশ...

মাসের ১৯ তারিখ অদ্ভুতভাবে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাঁর জীবনের তিনটি বড় ঘটনা ঘটেছিল ১৯ তারিখ, যদিও বছরগুলি ছিল আলাদা। যারা নিউমেরোলজি নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা বলেন, মাসের ১৯ তারিখে যারা জন্মান তাঁরা মানসিক ভাবে অত্যন্ত দৃঢ়চেতা হন এবং জীবনের যে কোনও বিপদের মুখোমুখি হয়ে তাঁরা জয়লাভ করেন।

১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ সাল। শিকাগোর ধর্মসভায় বক্তব্য রাখেন স্বামীজি। বিষয় ছিল Paper on Hinduism। এটিই স্বামীজির প্রথম লিখিত বক্তৃতা। শিকাগোতে স্বামীজি ১১ সেপ্টেম্বর এবং ১৫ সেপ্টেম্বর দু'টি বক্তৃতা দেন। কিন্তু দু'টি ভাষণই ছিল তাৎক্ষণিক বক্তৃতা। ১১ সেপ্টেম্বর তিনি ধর্মমহাসভার প্রথম দিন বক্তব্য রাখেন। এই বক্তৃতা আমেরিকার মানুষদের জন্য ঝড় তুলেছিল। খবরের কাগজ লিখল, 'মানব ভাষণের এই হচ্ছে সর্বোচ্চ শিখর', 'it was human eloquence at its highest pitch'।

খবরের কাগজগুলো হাত খুলে স্বামীজির চেহারার বর্ণনা দিয়েছিল – মধ্যরাত্রির শান্ত আকাশের মতো তার একজোড়া চোখ, ঘণ্টাধ্বনির মতো কণ্ঠস্বর, স্পন্দিত ওষ্ঠ, বুকের ওপর হাত জোড়া করে যখন দাঁড়াল তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতার ক্ষমতা নেই তাঁকে অনুকরণ করে। বিশেষণের পর বিশেষণ, আবেগের পর আবেগ।

১৫ সেপ্টেম্বরের বক্তৃতাটিও ছিল স্বামীজির সমন্ধে নানা কথা। হিন্দু যোগী, সাইক্লোনিক মঙ্ক ইত্যাদি। খবরের কাগজগুলো কিন্তু প্রথম দু'টি বক্তৃতার বিষয়বস্তু সমন্ধে বিশেষ কিছু লেখেনি। আমেরিকানরা স্বামীজির প্রতি আকৃষ্ট হলেন ১৯ সেপ্টেম্বরের বক্তৃতার পর থেকে। Paper on Hinduism -এর বক্তব্য এখনকার অশান্ত পৃথিবীতেও শান্তির একটা দিশা দেখাতে পারে। ধর্মীয় হানাহানি, কূপমণ্ডূকতা, ঘৃণা, এবং দ্বেষের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন ত্রিশ বছরের যুবকটি – বয়সে নবীন কিন্তু প্রজ্ঞায় চিরন্তন। গোটা পৃথিবীকে এক নতুন দিক দেখিয়েছিলেন স্বামীজি।

লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেছিলেন স্বামীজি। বক্তৃতাটির মধ্যে ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রিত আবেগ, সুরাধার যুক্তি এবং একটি বিশ্বাস যে আগামী দিনে সহমর্মিতা, পারস্পারিক আদান প্রদান এবং শ্রদ্ধাই হবে পৃথিবীর দর্শন এবং এই নতুন পৃথিবী রচিত হবে।

স্বামীজি দু'টি নতুন কথা বলেছেন যে দু-টি কথা তাঁর আগে আর কেউ বলেননি। তা হল- Universal individuality and universal religion। একটি ব্যক্তি যখন তার চারপাশের বেড়া ভেঙে দেয় তখন সে হয়ে ওঠে বিশ্ব মানব। কোনও ক্ষুদ্রতা তাকে আর স্পর্শ করতে পারে না। সার্বজনীন মানুষ পৃথিবীতে শান্তি আনে কারণ তিনি মানুষকে আঘাত করে নিজেকে জাহির করেন না; নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার কোনও বাসনা তার নেই এবং তাঁর একমাত্র জীবনের উদ্দেশ্য মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে নিজেকে আরও সূক্ষ্ম মানুষ হিসেবে প্রস্তুত করা। একটি ব্যক্তির স্বামীজির ভাষায় দেবতা হয়ে ওঠা। স্বামীজির মতে দেবতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মানুষ। 'আমি সেই দেবতার পূজারি, অজ্ঞেরা যাকে ভুল করে মানুষ বলে ডাকে'– স্বামীজি একটি চিঠিতে লিখেছেন।

শিকাগো ধর্মমহাসভার যে ছ'টি বক্তৃতা স্বামীজি দিয়েছেন তার প্রত্যেকটিতে তিনি তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন ধর্মানুগ এবং কূপমণ্ডূক মানুষকে। চিকাগোর প্রথম বক্তৃতায় বলেছেন, 'পৃথিবী অনেকটা এগিয়ে যেত যদি না কিছু সংকীর্ণমনা, নিজের গোষ্ঠীর মধ্যে থাকা কিছু মানুষ পৃথিবীর বুকে বারবার আঘাত হানত, তার আকাশ বাতাস বারুদের গন্ধে ভরিয়ে না দিত এবং মানুষের মনে অজানা ভয় ঢুকিয়ে না দিত। এরা না থাকলে পৃথিবী অনেক বেশি এগোতে পারত'।

সার্বজনীন ধর্ম হল সব ধর্মের সমষ্টি এবং তাতে উন্নতির অসীম অবকাশ থাকবে। এই ধর্ম নারী-পুরুষ, সাধু-পাপী সকলের ওপর তার আলো বিচ্ছুরিত করবে এবং এই ধর্ম কাউকে পীড়ন করবে না। স্বামীজি ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ কালে এবং বিদেশে ধর্মের নামে মানুষকে পীড়নের বীভৎস চেহারা দেখেছিলেন তাই তার মনে হয়েছে যে, যদি কোনও সার্বজনীন ধর্মের কথা বলা হয় যা মানুষের কল্যাণ করবে সেটিই হবে পৃথিবীর পক্ষে সবচেয়ে সময়োপযোগী দর্শন। স্বামীজির ভাষায় – “often such a religion and all nations will follow you” – এই ধর্ম মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে এবং মানুষ তা গ্রহণ করবে।

স্বামীজির বিশ্বাস ছিল মানুষ উদার এবং মানসিকভাবে সজীব, কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ তাদের সুবিধার জন্য মানুষকে ব্যবহার করেছে এবং তাকে হিংস্র প্রাণীতে পরিণত করেছে। স্বামীজি বিশ্বাস করতেন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম একদিন চলে যাবে এবং তার জায়গায় আসবে মানবধর্ম। একটা দিন আসবে যখন একটি মানুষ অন্য একটি মানুষের চোখের জল মুছিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করবে। তিনি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন এবং বিশ্বাস করতেন এই সুন্দর পৃথিবীর সূচনা হবে খুব তাড়াতাড়ি।

সেদিন ছিল ১৯ ফ্রেব্রুয়ারি, ১৮৯৭ সাল। প্রথমবার পাশ্চাত্য থেকে চার বছর কাটিয়ে কলকাতাতে ফিরলেন স্বামীজি। মাদ্রাজ থেকে স্টিমারে বজবজ তারপর একটি বিশেষ ট্রেনে কলকাতা। সঙ্গে মিসেস ও মিস্টার সেভিয়ার এবং স্বামীজির দ্রুতশ্রুত লিপিকার গুডউইন। আগের দিন অর্থাৎ ১৮ তারিখ কলকাতাতে বৃষ্টি হয়ে ঠাণ্ডাটা আরও জাঁকিয়ে পড়ে। গিরিশচন্দ্র ঘোষ সহ যারা অভ্যর্থনা কমিটিতে ছিলেন, তারা ভাবতে শুরু করেন এই ঠাণ্ডা আর তার ওপর বৃষ্টির পূর্বাভাস। শিয়ালদহ স্টেশনে সকালে মানুষজন বেশি আসবেন না। স্বামীজির বন্ধু ও বিখ্যাত অ্যাটর্নি ভূপেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান, তিনি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। মনে হচ্ছিল স্বামীজির অভ্যর্থনা ঠিকঠাকভাবে আয়োজিত করা যাবে তো? তিনি এবং বন্ধু নরেন্দ্রনাথ দত্ত নিমাইচরণ বসুর অ্যাটর্নি ফার্মে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর মনে হত এই ছেলেটি সাধারণ ফুট সোলজার নয় একেবারে কম্যান্ডার-ইন-চিফ।

শিয়ালদহ স্টেশন ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে। মাঝে মাঝে 'শ্রীরামকৃষ্ণের জয়', 'জয় শ্রীরামকৃষ্ণ' ফেস্টুন। সকাল থেকেই মানুষে মানুষে ভরে গিয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর। কলকাতা ভুলে যায়নি তার কৃতি সন্তানটিকে। স্বামীজিকে যে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেটা স্বীকার করে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে শোভাবাজার রাজবাড়িতে। স্বামীজি সেদিন বলেছিলেন, "আমি কলকাতার ছেলে। কলকাতার পথেঘাটে খেলে বেড়াতাম। আজ এইখানে বসেই আপনাদের সাথে আমার মনের কথা বলতে চাই। স্বামীজি তাঁর প্ল্যান অফ অ্যাকশান বলেছিলেন।"

স্বামীজি ও তাঁর বিদেশি বন্ধুদের নিয়ে ট্রেন এসে থামল শিয়ালদহ স্টেশনে। সেদিন যুবকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁরা স্বামীজির নামে হর্ষধ্বনি দিতে লাগলেন। স্বামীজি ও তাঁর দলটিকে অতি সন্তর্পণে স্টেশনের বাইরে নিয়ে আসা হল কারণ সকলেই তাঁকে একবার ছুঁয়ে দেখতে চায়। সামনেই রাখা ছিল সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। অত্যুৎসাহী যুবকেরা ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া খুলে দিয়ে নিজেরাই গাড়ি টানতে লাগল। কলকাতা একবারই মাত্র এই দৃশ্য দেখেছে। রাস্তার দু-ধারে শুধু মানুষ আর মানুষ। স্বামীজির গাড়ি ঋপন কলেজ অর্থাৎ বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজে এসে থামল। কলকাতার গণ্যমান্য মানুষেরা তাঁকে কলেজের ভিতরে নিয়ে গেলেন। সবাই চান স্বামীজি কিছু বলুন। তখনকার দিনে মাইক নেই, কোলাহল, চিৎকার, উৎসাহ স্বামীজির কথা শোনা গেল না।

এবার গন্তব্য পশুপতি বসুর বাড়ি। উত্তর কলকাতার নামকরা বসু পরিবার। এই বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছেন। এই বাড়ির ছেলে নন্দলাল খুব উঁচু মানের শিল্পী।যুবকরা নাছোড়। তারাই ঘোড়ার গাড়ি টানতে লাগল। পশুপতি বসুর বাড়িতে স্বামীজির সঙ্গে দেখা তাঁর গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দ, গিরিশ ঘোষ, রসরাজ অমৃতলাল বসু, নটি বিনোদিনীর। গিরিশচন্দ্রকে স্বামীজি বললেন, 'দ্যাখ জি সি, শ্রীরামকৃষ্ণকে কেমন জয় রাম জয় রাম বলে সাগর পার করে দিয়ে এলাম'। এখানেও স্বামীজি কিছু বলতে পারলেন না কারণ সবাই কথা বলছে। অতি উৎসাহে হারিয়ে গেল তার কণ্ঠস্বর। দীর্ঘভ্রমণে ক্লান্ত স্বামীজি হাসিমুখে সকলের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করলেন।

১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪ সাল, নরেন্দ্রনাথ দত্ত ম্যসনিক লজের সদস্য হয়েছিলেন। পার্ক স্ট্রিটে লজের বিশাল বাড়িটি এখনও আছে। নরেন্দ্রকে লজের সদস্য হবার জন্য নাম প্রস্তাব করেন ডবলু জি ব্যানার্জী, কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি এবং দ্বিতীয়জন বিখ্যাত অ্যাটর্নি নিমাইচরণ বসু। এঁরা দু'জনেই স্বামীজির পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তের বন্ধু ছিলেন।

আমেরিকাতে গিয়েও লজের সদস্যদের অনুরোধে তাঁদের সাথে দেখা করেন, আলাপ করেন। অনেকে মনে করেন, লজের সদস্যরা পরস্পরকে ব্রাদার বলে ডাকতেন এবং এখান থেকে স্বামীজি সেটি শেখেন এবং শিকাগো ধর্মসভার প্রথম অধিবেশনে শ্রোতৃমণ্ডলীকে 'সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স' বলে সম্বোধন করেন। এই সম্বোধনটি এত আন্তরিক ছিল যে সেই মুহূর্ত থেকেই শ্রোতারা স্বামীজির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন।

More Articles