শৈশবের ‘রিওয়্যারিং’: স্ক্রিনের নীল আলো গিলে খাচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে?
Screen Addiction Destroying the Mental Health: বাস্তব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডিজিটাল জগতে ডুবে থাকায় শিশুদের মানসিক কাঠামোর এক আমূল পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে।
অনেকদিন আগে কলকাতা বইমেলায় এক বই উদ্বোধনে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর শৈশবের এক অমলিন স্মৃতি শ্রোতাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন। তিনি বড় হচ্ছিলেন বাংলাদেশের গ্রামে তাঁর ঠাকুরদা-ঠাকুমার কাছে, আর কর্মসূত্রে তাঁর বাবা-মা থাকতেন কলকাতায়। পড়াশোনার প্রয়োজনে যখন ১০ বছর বয়সে কবিকে কলকাতায় নিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু হলো, তখন ঠাকুরদা বাধা দিয়ে বলেছিলেন,
ও তো এই বয়সেই সাইকেল চড়তে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, গাছে উঠতে পারে। এমনকি পয়সা নিয়ে বাজারে গেলে ঠিকঠাক হিসেব বুঝিয়ে দিতে পারে। এর চেয়ে নতুন আর কী শিখবে ও, যার জন্য ওকে কলকাতার বড় স্কুলে ভর্তি হতে হবে?
কবির ঠাকুরদার এই সাধারণ কথাটি আসলে এক ধ্রুব সত্যকে উন্মোচন করে— জীবনের স্কুলের চেয়ে বড় স্কুল আর কিছু নেই। এখন প্রশ্ন হলো, আজকের দিনে আমরা কি আমাদের সন্তানদের সেই 'জীবনের স্কুলে' পাঠাচ্ছি?
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিশ্বজুড়ে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এক ভয়াবহ মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। উদ্বেগ, বিষণ্ণতা আর একাকীত্ব আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এখন মহামারীর মতো গ্রাস করছে। প্রখ্যাত গবেষক ও মনোবিজ্ঞানী জোনাথন হাইট তাঁর 'The Anxious Generation' গ্রন্থে দাবি করেছেন, এই সংকটের মূলে রয়েছে আমাদের তৈরি করা একটি 'বিষাক্ত পরিবেশ'। আমরা শিশুদের শৈশবকে সেই পুকুরে সাঁতার কাটা কিংবা গাছে ওঠার স্বাধীনতা থেকে উপড়ে এনে বন্দি করেছি স্মার্টফোনের নীল আলো আর স্কুলের চার দেওয়ালের প্রাণহীন ডেস্কে।
গ্রেট রিওয়্যারিং: শিশুর জগত যখন ভার্চুয়াল
জোনাথন হাইট ২০১০ সালের পরবর্তী সময়কে ইতিহাসের এক চরম সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যাকে তিনি বলছেন ‘দ্য গ্রেট রিওয়্যারিং’। আক্ষরিক অর্থে রিওয়্যারিং হলো কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ভেতরের তারের বিন্যাস বদলে দিয়ে তার কাজ করার পদ্ধতি পরিবর্তন করা। শিশুদের ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই ঘটছে; বাস্তব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডিজিটাল জগতে ডুবে থাকায় তাদের মানসিক কাঠামোর এক আমূল পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। এর আগে শত শত বছর ধরে মানবজাতির শিশুরা বড় হয়েছে ‘খেলাধুলা ভিত্তিক শৈশব’(Play-based Childhood) -এর মধ্য দিয়ে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ঠাকুরদা-সাঁতার কাটা, গাছে ওঠা কিংবা বাজারে গিয়ে হিসেব মেলানোর মতো যে দক্ষতাগুলির কথা বলেছিলেন, সেগুলোই ছিল মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রধান জ্বালানি। সেখানে তারা উঁচু গাছ থেকে নামার সময় শারীরিক ঝুঁকি নিতে শিখত, খেলার মাঠে ঝগড়া হলে নিজেরাই বুক চিতিয়ে তা মিটিয়ে নিতে পারত। সেই মুক্ত অভিজ্ঞতাই ছিল শিশুদের বেড়ে ওঠার প্রধান রসদ, যা তাদের ভেতরে গড়ে তুলত এক ইস্পাত কঠিন মানসিক সহনক্ষমতা বা ‘রেজিলিয়েন্স’।
কিন্তু ২০১০ সালের পর স্মার্টফোনের রঙিন পর্দার নেশায় সেই চেনা শৈশবটা হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। শুরু হলো এক অদ্ভুত ‘ফোন ভিত্তিক শৈশব’। শিশুরা রক্ত-মাংসের পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আজব ডিজিটাল দুনিয়ায় বন্দি হয়ে পড়ল। ফোনের স্ক্রিনের ফিকে আলো আর যাই হোক, পুকুরের শীতল জল কিংবা গাছের খসখসে ডালের ছোঁয়ার বিকল্প হতে পারে না। এই পরিবর্তনের ফলে বাচ্চাদের মানসিক স্থিরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাদের মন সারাক্ষণ ছটফট করছে। আগেকার সেই অলস দুপুরের সৃজনশীল সময়গুলো আজ কেবল ফোনের স্ক্রল করার নেশায় হারিয়ে যাচ্ছে। যে বয়সে তাদের বুক ভরা সাহস নিয়ে পৃথিবী চেনার কথা ছিল, সেই বয়সে তারা ডোপামিনের তাড়নায় ‘লাইক’ আর ‘শেয়ার’-এর ইঁদুর দৌড়ে আটকে পড়ছে। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে ঘরে বসে তারা খুব নিরাপদ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা আসলে ইতিহাসের সবচেয়ে একা আর মানসিকভাবে দুর্বল এক প্রজন্মে পরিণত হচ্ছে।
আরও পড়ুন
মেশিন লার্নিং থেকে ডিপ লার্নিং: এআই কী ভাবে শেখে?
খাঁচাবন্দি শৈশব ও ‘সেরোটোনিন’ সংকট
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সেই প্রাণহীন কাঠামো। জোনাথন হাইটসহ অনেক পরিবেশ-মনোবিজ্ঞানী লক্ষ্য করেছেন, জানালাহীন দেওয়াল, কৃত্রিম আলো আর একঘেয়ে কংক্রিটের ক্লাসরুম শিশুদের মানসিক জগতকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। দিনের পর দিন একটি নির্দিষ্ট ডেস্কে পাথরের মতো স্থবির হয়ে বসে থাকার বাধ্যবাধকতা তাদের স্বাভাবিক চঞ্চলতা আর সৃজনশীলতাকে অঙ্কুরেই নষ্ট করে দিচ্ছে।
এখনকার শিশুদের কাছে ‘প্রকৃতি’ মানে কেবল স্কুলের কোণায় পড়ে থাকা কয়েক টুকরো কৃত্রিম ঘাস অথবা পাঠ্যবইয়ের পাতায় দেখা কোনো ছবি। প্রকৃতির সঙ্গে এই বিচ্ছেদ শিশুদের ভেতরে এক ধরনের ‘ইন্দ্রিয়গত শূন্যতা’ (Sensory Deprivation) তৈরি করছে; যার ফলে তারা অল্পতেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে, হয়ে উঠছে খিটখিটে। মাটির গন্ধ আর খোলা হাওয়ার সান্নিধ্য ছাড়া বড় হওয়া এই শিশুরা জীবনকে দেখার উদার দৃষ্টিভঙ্গিটাই হারিয়ে ফেলছে।
এই সংকট আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে শিশুটি ঘরে ফেরে। আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ন শিশুদের খেলার মাঠগুলিকে গিলে খেয়েছে। মানুষের থাকার জায়গাকে আমরা যতটা গুরুত্ব দিয়েছি, শিশুদের বেড়ে ওঠার পার্ক বা খোলা জায়গাগুলিকে রেখেছি ততটাই ব্রাত্য। ফলে শৈশব এখন ঘরের চার দেওয়ালের খাঁচায় বন্দি। সমাজবিজ্ঞানীরা একেই বলছেন ‘খাঁচাবন্দি শৈশব’(Caged Childhood)।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আধুনিক শহরের বেশিরভাগ জায়গায় শিশুদের জন্য কোনো খেলার মাঠ নেই। এর ফল হয়েছে মারাত্মক— প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম ছাড়াই বড় হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, শরীরচর্চার অভাব মস্তিষ্কে ‘সেরোটোনিন’ নামক হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। অথচ এই হরমোনই আমাদের মনে আনন্দ জোগায়। ফলে এই মাঠহীন জীবন শুধু শিশুদের অলস করছে না, বরং তাদের শরীরের স্বাভাবিক আনন্দ বা ফুরফুরে ভাবটাকেই নষ্ট করে দিচ্ছে, যা তাদের অজান্তেই ঠেলে দিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী উদ্বেগের দিকে।
বিচ্ছিন্নতা ও অতি-সুরক্ষার গোলকধাঁধা
এই সংকটের আরেকটি বড় কারণ হলো সামাজিক ‘বিচ্ছিন্নতা’। আমাদের সমাজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে; যৌথ পরিবারগুলি ভেঙে গিয়ে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট একক পরিবার। আগেকার দিনে পাড়ার সংস্কৃতি বা যৌথ পরিবারের খোলামেলা উঠানে শিশুরা দলবেঁধে বড় হত — সেটাই ছিল তাদের সামাজিক হওয়ার প্রথম পাঠশালা। কিন্তু এখনকার ‘ফ্ল্যাট কালচার’ শিশুদের সেই সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। জোনাথন হাইট একেই বলছেন ‘শারীরিক বিচ্ছিন্নতা’ (Physical Disconnection)। একটি শিশু দিনের পর দিন যদি সমবয়সিদের সঙ্গে সরাসরি মেলামেশা করার সুযোগ না পায়, তাহলে সে খেলাধুলার ফাঁকে মান-অভিমান করার কিংবা তা মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তার ভেতরে সাধারণ সামাজিক কাণ্ডজ্ঞানগুলি গড়ে ওঠে না। সশরীরে মানুষের সঙ্গে মেশার অভাব তাকে মানসিকভাবে একা এবং আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। এই একাকীত্ব থেকেই জন্ম নেয় এক ধরনের সামাজিক জড়তা, যা পরে গভীর বিষণ্ণতার রূপ নেয়।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অভিভাবকদের প্রবল ‘নিরাপত্তা ভীতি’। রাস্তার যানজট, অপহরণের আতঙ্ক কিংবা বাইরের নোংরা পরিবেশের কথা ভেবে মা-বাবারা এখন সন্তানদের এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চান না। এই ‘অতি-সুরক্ষা’ শিশুদের নিজের চোখে পৃথিবী দেখার ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। ফলে বাস্তব জগতের সব দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায়, তাদের জন্য একমাত্র খোলা জানালা হয়ে দাঁড়ায় ডিজিটাল স্ক্রিন। স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটের সেই কৃত্রিম জগতই তখন তাদের ঘরবন্দি জীবনের প্রধান সঙ্গী হয়ে ওঠে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ঘরে বসে সুরক্ষিত থাকার বদলে তারা আসলে ভার্চুয়াল জগতের এক অনিরাপদ সাগরে একাকী ভেসে চলে।
অ্যাকাডেমিক ইঁদুর দৌড় ও অবসর সময় না থাকা
ভারতের মতো জনবহুল দেশে ভালো স্কুল-কলেজের সীমিত আসনে নিজের জায়গা করে নেওয়ার কঠিন লড়াই শিশুদের শৈশবকে আজ এক অন্তহীন ইঁদুর দৌড়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জোনাথন হাইট শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য ‘আনস্ট্রাকচারড টাইম’ বা অসংগঠিত সময়ের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। এটি হলো এমন এক মুক্ত সময়, যেখানে বড়দের কোনো তদারকি বা সরাসরি দিকনির্দেশনা থাকে না— শিশু নিজের খেয়ালখুশি মতো খেলে বা অলস সময় কাটায়। স্কুল, কোচিং আর হোমওয়ার্কের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে শিশুর প্রতিটি মুহূর্ত এখন বড়দের নিয়ন্ত্রণে। ফলে তাদের সহজাত সৃজনশীলতা আর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে।
এই 'সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট' বা টিকে থাকার লড়াই শিশুদের স্রেফ নম্বর অর্জনের যন্ত্রে রূপান্তর করছে। ভারতের রাজস্থানের কোটা (কোচিং ক্যাপিটাল) থেকে শুরু করে আমাদের জনবহুল শহরগুলিতে দেখা গিয়েছে, শিক্ষার্থীদের শরীরে স্ট্রেস হরমোন ‘কর্টিসোল’-এর মাত্রা একজন উচ্চপদস্থ কর্পোরেট কর্মীর চেয়েও বেশি। শৈশবের এই 'মুক্ত সময়' কেড়ে নেওয়া আর পড়ার পাহাড়প্রমাণ বোঝা কেবল তাদের আনন্দই কেড়ে নিচ্ছে না, বরং মস্তিষ্কের স্নায়বিক গঠনকেও স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী উদ্বেগ, একাকীত্ব ও গভীর বিষণ্ণতা।
‘ডিজিটাল চুষিকাঠি’ ও ‘লিপফ্রগ’ এফেক্ট
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্মার্টফোনের এই গণজোয়ার অনেকটা ‘লিপফ্রগ’ (Leapfrog) এফেক্ট-এর মতো; মানে হলো সিঁড়ির ধাপগুলো একে একে না পেরিয়ে এক লাফে সরাসরি উপরে পৌঁছে যাওয়া। অর্থাৎ, প্রযুক্তির পুরনো ধাপগুলি (যেমন: ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ) এড়িয়ে সরাসরি আধুনিকতম স্মার্টফোন বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে ঢুকে পড়ার এক দ্রুত প্রক্রিয়া। উন্নত বিশ্বের মানুষ ধাপে ধাপে ডিজিটাল দুনিয়াকে চিনলেও, আমাদের শিশুরা বর্ণমালার হাতেখড়ির আগেই স্মার্টফোনের রঙিন দুনিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। এখনকার ব্যস্ত মা-বাবারাও শিশুকে শান্ত রাখার সবচেয়ে সহজ উপায় হিসেবে তার হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোন-যাকে জোনাথন হাইট বলছেন ‘ডিজিটাল চুষিকাঠি’।
বিপদটা এখানেই। হাইটের মতে, এই স্ক্রিন-নির্ভরতা শিশুর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ থামিয়ে দেয়; যার ফলে শিশু বাস্তব জগতের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে এবং কোনো কিছুতেই গভীর মন দিতে পারছে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য মতে, আধুনিক বিশ্বের শিশুরা গড়ে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা ইন্টারনেটে কাটাচ্ছে। এখানে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য লক্ষণীয়-বাস্তব জগতে আমরা শিশুকে ধুলোবালি বা ছোটখাটো আঘাত থেকে বাঁচাতে ‘অতি-সুরক্ষা’ (Real World Overprotection) দিচ্ছি, অথচ ইন্টারনেটের অনিরাপদ সমুদ্রে তাদের কোনো নজরদারি ছাড়াই একা ছেড়ে দিচ্ছি (Virtual Underprotection)।
লিঙ্গভিত্তিক প্রভাব: দুই মেরুর দুই সংকট
জোনাথন হাইট দেখিয়েছেন, ডিজিটাল আসক্তি ছেলে ও মেয়েদের উপর ভিন্ন ভিন্নভাবে আঘাত হানে। আমাদের দেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে মেয়েদের বাইরের জগত এমনিতেই কিছুটা সীমাবদ্ধ; আর এই সুযোগেই সোশ্যাল মিডিয়ার কৃত্রিম দুনিয়া তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। সেখানে ক্রমাগত অন্যের ‘নিখুঁত’ জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে গিয়ে মেয়েরা গভীর হীনম্মন্যতায় ভুগছে। এটি তাদের মনে নিজেদের চেহারা বা ‘বডি ইমেজ’ নিয়ে তীব্র অসন্তুষ্টি তৈরি করে, যা সাইবার বুলিংয়ের সঙ্গে মিশে তাদের চরম মানসিক অবসাদে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
অন্যদিকে, খেলার মাঠের অভাব আর চার দেওয়ালের বন্দি জীবন ছেলেদের ডুবিয়ে দিচ্ছে উগ্র ভিডিও গেমের নেশায়। এই গেমিং আসক্তি তাদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের এমন এক কৃত্রিম জোয়ার তৈরি করে, যা তাদের বাস্তব জগত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দীর্ঘ সময় পর্দায় গেমের মারামারি দেখতে দেখতে তাদের মধ্যে এক ধরণের রুক্ষতা আর মানবিক সম্পর্কের প্রতি চরম অনীহা জন্ম নিচ্ছে। দিন শেষে আমরা এমন এক প্রজন্ম পাচ্ছি, যেখানে মেয়েরা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছে আর ছেলেরা বড় হচ্ছে বাস্তবতাবোধহীন এক উগ্রতা নিয়ে।
মানসিক স্বাস্থ্যে আঘাত
জোনাথন হাইটের মতে, বর্তমান প্রজন্মের স্নায়বিক বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে চারটি প্রধান কারণ:
• সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: মানুষের জন্মগত স্বভাব হলো একে অপরের মুখোমুখি বসে কথা বলা, মানুষের চোখের ভাষা বা শরীরের ভঙ্গি বোঝা। কিন্তু সারাক্ষণ স্ক্রিনে ডুবে থাকায় শিশুরা এই স্বাভাবিক দক্ষতাটাই হারিয়ে ফেলছে। ফলে তারা অন্যের আবেগ বা কষ্ট ঠিক মতো অনুধাবন করতে পারছে না, যা তাদের মনে এক গভীর একাকীত্ব তৈরি করছে।
• ঘুমহীন শৈশব: স্মার্টফোনের নীল আলো শরীরের ঘুমের হরমোন ‘মেলাটোনিন’ তৈরিতে বাধা দেয়। গভীর ঘুমের এই অভাব কিশোর-কিশোরীদের মেজাজ খিটখিটে করে দিচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে মনোযোগ এবং তৈরি করছে দীর্ঘমেয়াদী অবসাদ।
• বিক্ষিপ্ত মনোযোগ: টিকটক বা রিলসের মতো ছোট ছোট ভিডিও আর অবিরাম নোটিফিকেশন শিশুদের মস্তিষ্ককে ক্ষণস্থায়ী উত্তেজনায় অভ্যস্ত করে তুলছে। এর ফলে কোনো বই পড়া বা কোনো কাজে দীর্ঘক্ষণ মন দেওয়ার ধৈর্য তারা হারিয়ে ফেলছে। তাদের মনোযোগ আজ কয়েক সেকেন্ডের ফ্রেমে বন্দি।
আরও পড়ুন
এআই যতটা গর্জাচ্ছে ততটা বর্ষাবে?
• লাইক-কমেন্টের নেশা: সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিটি লাইক বা কমেন্ট মস্তিষ্কে ডোপামিন নামের এক আনন্দের হরমোন ছড়ায়। শিশুরা যখন তাদের আত্মসম্মানকে এই লাইক-কমেন্টের উপর নির্ভর করাতে শেখে, তখন তারা মানসিকভাবে খুব ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পেলেই শুরু হয় হতাশা।
এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হাইট চারটি প্রস্তাব দিয়েছেন:
• অন্তত ১৪ বছরের আগে শিশুকে স্মার্টফোন দেবেন না। যোগাযোগের প্রয়োজনে সাধারণ ‘ফিচার ফোন’ যথেষ্ট। স্মার্টফোনের তীব্র উদ্দীপনা সামলানোর মতো পরিপক্কতা এই বয়সে তৈরি হয় না।
• সাইবার বুলিং এবং অ্যালগরিদম আসক্তি থেকে বাঁচাতে ১৬ বছর বয়সের আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা উচিত। এতে তাদের নিজস্ব আত্মসম্মানবোধ ও ব্যক্তিত্ব সুস্থভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
• স্কুল চলাকালীন ফোন লকারে জমা রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে ক্লাসরুমে মনোযোগ বাড়বে এবং টিফিনের অবসরে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলা ও খেলার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন মজবুত করবে।
• বড়দের ‘অতি-তদারকি’ কমিয়ে শিশুদের খোলা পরিবেশে একা খেলতে দিন। কোনো বড় মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে খেলার মাধ্যমেই শিশুরা ঝুঁকি নিতে, দায়িত্ব নিতে এবং জীবনকে বুঝতে শেখে।
পরিশেষে, আমাদের বুঝতে হবে, শিশুদের 'অতি-সুরক্ষা' দিতে গিয়ে আসলে আমরা তাদের ভেতর থেকে প্রাণের স্পন্দনটাই কেড়ে নিচ্ছি। আকাশচুম্বী স্কুলবাড়ি কিংবা সিজিপিএ-১০ কখনোই প্রকৃত উন্নতির মাপকাঠি হতে পারে না। অবারিত প্রকৃতি আর মুক্ত অভিজ্ঞতাই একটি শিশুকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। স্কুলের একঘেয়ে পরিবেশ আর স্মার্টফোনের পর্দার নেশায় আমাদের সন্তানেরা আজ নিজেদের হারিয়ে ফেলছে। এই যান্ত্রিক জীবন তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে। বস্তুত, এই অসুস্থ প্রজন্ম নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়া অসম্ভব। তাই স্ক্রিনের মায়া ছাড়িয়ে তাদের আবার মাটির কাছে, খেলার মাঠের চিরচেনা পরিবেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া আজ সময়ের দাবি।
Whatsapp
