বিপন্ন ভারতের প্রাচীন পর্বতমালা! যেভাবে ধ্বংসের মুখে আরাবল্লী
Aravalli Hills Under Threat: পরিবেশবিদদের মতে, আরাবল্লী কেটে ফেললে দিল্লির দূষণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেবে।
আরাবল্লী কোনো সাধারণ পাহাড়শ্রেণি নয়। এটি ভারতের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের এক জীবন্ত স্মারক, যার জন্ম প্রাক্-ক্যাম্ব্রিয়ান যুগে। আজ যখন কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগত অবস্থান এবং সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যার ফলে পাহাড়ের সংজ্ঞাই বদলে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তখন আরাবল্লীর অস্তিত্ব সংকট কেবল একটি ভৌগোলিক প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নেই। এটি সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে ভারতের জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য এবং বিশেষ করে দিল্লি-এনসিআরের বায়ুদূষণের ভয়াবহ বাস্তবতার সঙ্গে।
গুজরাট থেকে রাজস্থান, হরিয়ানা হয়ে দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় আটশো কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রাচীন পর্বতমালা উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে এসেছে সহস্রাব্দ ধরে। আরাবল্লীর ঢাল, পাথুরে বনভূমি ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চল একদিকে যেমন থর মরুভূমির অগ্রযাত্রাকে আটকে রেখেছে, তেমনি অন্যদিকে ধূলিঝড়, শুষ্ক বায়ু ও অতিরিক্ত উষ্ণতা থেকে দিল্লি ও তার আশপাশের অঞ্চলকে একটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ বলয় দিয়েছে।
আরও পড়ুন
Climate Change: আগামী দিনে খেয়ে-পরে বাঁচবে তো মানুষ? যে আশঙ্কার কথা জানালেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা
এই পাহাড়শ্রেণির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ অথচ দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসা জীববৈচিত্র্য। আরাবল্লীর বনভূমিতে একসময় নিয়মিত বিচরণ করত চিতাবাঘ, ভারতীয় নেকড়ে, হায়েনা, শিয়াল, নীলগাই, সাম্বর ও চিঙ্কারার মতো প্রাণী। আজ নগরায়ন, রাস্তা, খনন ও বন উজাড়ের চাপে তাদের আবাসভূমি টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। তবুও এই অঞ্চল এখনও বহু প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ এবং ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ীর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে টিকে আছে। এই জীববৈচিত্র্য ধ্বংস মানে কেবল প্রাণীর বিলুপ্তি নয়, বরং পুরো বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ভেঙে পড়া।
জলবায়ুগত দিক থেকে আরাবল্লীর ভূমিকা অত্যন্ত সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর। বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর গতিপথ ও আর্দ্রতা ধরে রাখতে এই পাহাড়শ্রেণি একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আবার শীতকালে ও গ্রীষ্মের শুরুতে পশ্চিম দিক থেকে আসা শুষ্ক ও ধুলোময় বায়ুকে আংশিকভাবে আটকে দেয় আরাবল্লী। এই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে গেলে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে দিল্লির বায়ুতে।
পরিবেশবিদদের মতে, আরাবল্লী কেটে ফেললে দিল্লির দূষণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেবে। রাজস্থান ও থর মরুভূমি অঞ্চল থেকে যে বিপুল পরিমাণ ধুলো ও বালি বাতাসে ভেসে আসে, আরাবল্লী তা অনেকাংশে আটকে দেয়। পাহাড় কেটে সমতল করে দিলে সেই ধুলো বাধাহীনভাবে দিল্লি-এনসিআরের দিকে ধেয়ে আসবে। শীতকালে যখন এমনিতেই বায়ু চলাচল কম থাকে, তখন এই অতিরিক্ত ধূলিকণা দিল্লির বাতাসে স্থায়ীভাবে আটকে পড়বে। এর ফলে পিএম ২.৫ ও পিএম ১০ মাত্রা আরও বেড়ে যাবে, বাড়বে হাঁপানি, হৃদরোগ ও শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা। দিল্লির দূষণ তখন আর শুধু যানবাহন বা শিল্পের দোষে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা হয়ে উঠবে একটি আঞ্চলিক পরিবেশ বিপর্যয়।
আরাবল্লীর বনাঞ্চল বায়ু পরিশোধনের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ধূলিকণাকে আটকে রাখে। পাহাড় কেটে বনভূমি উজাড় হলে সেই প্রাকৃতিক ফিল্টার সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। এর ফলেই দিল্লি আরও দ্রুত একটি ‘গ্যাস চেম্বার’-এ পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন
আরাবল্লী প্রশ্নে কেন হঠাৎ সুর বদলালেন অর্ণব গোস্বামী?
এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠছে, কেন আরাবল্লীর মতো একটি পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশবিদ ও নাগরিক সমাজের বড় অংশের অভিযোগ, পাহাড়ের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া এবং আইনি সুরক্ষা দুর্বল করার নেপথ্যে রয়েছে অবৈধ খনন, পাথর খাদান, রিয়েল এস্টেট ও বাণিজ্যিক নির্মাণের স্বার্থ। পাহাড় না থাকলে আর নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না, খুলে যাবে জমি দখল ও নির্মাণের অবাধ রাস্তা— এই বাস্তবতাই আজ আরাবল্লী ধ্বংসের পেছনে সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি বলে মনে করছেন তাঁরা।
উন্নয়নের নামে এই স্বল্পমেয়াদি আর্থিক লাভের রাজনীতি দীর্ঘমেয়াদে দেশকে যে কত বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তার হিসাব আজও নীতিনির্ধারকদের টেবিলে গুরুত্ব পায় না। আরাবল্লী ধ্বংস হলে ক্ষতি হবে শুধু একটি পাহাড়শ্রেণির নয়; ক্ষতিগ্রস্ত হবে দিল্লির বাতাস, উত্তর ভারতের জলবায়ু ভারসাম্য, ভূগর্ভস্থ জলস্তর এবং কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ। এই প্রাচীন পাহাড় আসলে একটি প্রাকৃতিক ঢাল, একটি জলবায়ু রক্ষাকবচ। তাকে কেটে ফেলা মানে কেবল প্রকৃতিকে নয়, নিজেদের ভবিষ্যৎকেই ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া।
Whatsapp
