দেশে দেশে নানাবেশে আছেন সে এক সান্তা ক্লজ

Santa Claus Across Cultures: ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত রঙিন চিত্র সংকলনে জর্জ ওয়েবস্টার লিখেছিলেন, সান্তা ক্লজের বাড়ি "নর্থ পোলের নিকটে"।

২৪ ডিসেম্বর মাথার কাছে মোজা নিয়ে শোয়ার অভ্যেস তৈরি করিয়ে দিয়েছিল মা। মাঝরাতে ক্রিসমাস ফাদার আসবে, গিফট দিয়ে যাবে মোজার ভেতর। কৌতূহল হত, একটা অচেনা লোক মাঝরাতে আমাদের বাড়ি ঢুকবে কী করে? লোকটাকে কেমন দেখতে? সে কি এসে মা বাবার সঙ্গে গল্প করতে বসে? এতসব প্রশ্নের তাগিদে আর উত্তেজনায় সেই রাতে মাঝেমাঝেই ঘুম ভেঙে যেত। মোজা ছুঁয়ে দেখে নিতাম খালি না ভর্তি। ইচ্ছে থাকত, এক ফাঁকে যদি দেখে ফেলা যায় ফাদার ক্রিসমাসকে! সে সুযোগ হয়নি, তবে একবার মনে আছে টের পেয়েছিলাম মা যেন কী সব ঢোকাচ্ছে মোজায়। সন্দেহ হয়েছিল বটে, তবে শিশুমন নিজের মতো গল্প বানিয়ে নিল, ফাদার ক্রিসমাস এসে মায়ের হাতেই গিফট দিয়ে গিয়েছে, মা সেগুলো আমার মোজায় রাখছে।

বয়স বেড়েছে, ক্রিসমাস ফাদারের গিফটের অপেক্ষা হারায়নি। নানা দেশ ঘুরে তাকে নিয়ে কিংবদন্তির রকমফের দেখা হয়েছে। কোথাও দেখলাম, পরিবারের সকলের নামাঙ্কিত বড় বড় মোজা ঝোলানো হয় ফায়ারপ্লেসের কাছে, কারণ ক্রিসমাস ফাদার আসবে চিমনি বেয়ে। কোথাও আবার ফায়ারপ্লেসের অভাবে মোজা ঝোলানো হয় রুম হিটারের নিচে। ফ্রান্সে মোজা নয়, রাখা হয় জুতো। যার যার উপহার দেওয়া থাকবে জুতোর ভিতর। ছোটরা চিঠি লেখে ফাদার ক্রিসমাসের উদ্দেশ্যে, সেই চিঠি ফেলার বাক্স রাখা থাকে টাউন হলের সামনে। নগর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ, বড়দিনের আগে প্রত্যেক বাচ্চার নামে তাদের ঠিকানায় ক্রিসমাস ফাদারের লেখা চিঠি যায়। সারা বছর ভালো হয়ে থাকলে ফাদার ক্রিসমাস মনমতো উপহার দেয় , চিঠির উত্তর দেয়, এই সান্ত্বনায় সব বাচ্চারা কথা শুনে চলে। না চললে ভয় দেখানো হয়, এ বছর ফাদার ক্রিসমাসের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যেতে পারে সে!

মার্কিন দেশে ক্রিসমাস ফাদার নয়, তাকে ডাকা হয় সান্তা ক্লজ। গোলগাল চেহারার লাল-সাদা জামা পরা হো-হো-হো হাসিমুখ বৃদ্ধটি আসলে কোকা-কোলা কোম্পানির নির্মাণ। সান্তা ক্লজকে ঘিরে এত আয়োজন এত বিকিকিনি আসলে নাকি ক্যাপিটালিস্ট ভোগবাদী অর্থনীতির বিশাল ষড়যন্ত্র! ১৯৩০-এর দশকে মার্কিন শিল্পী হ্যাডন সান্ডব্লম-এর আঁকা কোকা-কোলা কোম্পানির ক্রিসমাস বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সান্তা ক্লজ আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সান্তা ক্লজ নাকি কোকা-কোলাই আবিষ্কার করেছে, এমন গুজব কেন্দ্র করে জলঘোলাও কম হয় না। কোকা-কোলার প্রতিদ্বন্দ্বী পেপসি-কোলাও ৪০/৫০-এর দশকে সান্তা চিত্র ব্যবহার করেছিল। এরও বহু আগে ১৯১৫ সালে হোয়াইট রক বেভারেজেস সান্তার ছবি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনে। তবে, সান্তার লাল-সাদা পোশাক আর কোকা-কোলার রঙের যে মেলবন্ধন, তার মতো জনপ্রিয় হতে পারেনি অন্য বিজ্ঞাপনগুলি। সান্তা ক্লজ নর্থ পোল-এ থাকে, এই ধারণাটি সম্ভবত আমেরিকান কার্টুনিস্ট থমাস ন্যাস্ট-এর সৃষ্টি। হার্পার্স উইকলি-এর ২৯ ডিসেম্বর ১৮৬৬-এর সংখ্যায় প্রকাশিত Santa Claus and His Works নামের চিত্র সংকলনে ক্যাপশন ছিল

Santa Claussville, North Pole

আরও পড়ুন

খোদ ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ হয়েছিল ক্রিসমাস! কেন জানেন?

১৮৬৯ সালে প্রকাশিত রঙিন চিত্র সংকলনে জর্জ ওয়েবস্টার লিখেছিলেন, সান্তা ক্লজের বাড়ি

নর্থ পোলের নিকটে

সব মিলিয়ে সান্তার ঠিকানা নির্ধারিত হয় নর্থ পোল-এর নাম না জানা গ্রাম। সেখানে তার মস্ত কারখানা, খেলনা বানানোর। পোষা আট রেইনডিয়ার বা বল্গাহরিণ টানা স্লেজ গাড়ি করে সান্তা পৃথিবী পরিভ্রমণে বেরোয় বড়দিনের আগের রাতে। কারখানায় কাজ করে অগুনতি এলফ। তারা সান্তার সহযোগী। তারাই সব খেলনাপত্তর বানায়। এই এলফদের নিয়েও মজা আছে। বেলজিয়াম বা সুইজারল্যান্ডে সান্তার সহযোগীবৃন্দ মোটেই নিরীহ খেলনা প্রস্তুতকারক ছিল না। তারা রীতিমতো বেত হাতে সান্তার সঙ্গে ঘুরত। যে শিশুরা সারাবছর দুষ্টুমি করেছে, তাদের জন্য বরাদ্দ এলফ হাতে বেতের বাড়ি। লোককথার এইসব হিংস্র ধারণা আধুনিক যুগের অহিংস পেরেন্টিং স্টাইল থেকে উঠে গিয়েছে, তাই এলফরাও দুষ্টুলোক থেকে ভালো লোক হয়ে গিয়েছে এখনকার সান্তার গল্পে। ঘরে ঘরে চিমনি বেয়ে ঢোকে সান্তা। টেবিলে তার জন্য রাখতে হয় এক গ্লাস দুধ আর কুকিজ। রেইনডিয়ারের জন্য গাজর। হলিউডের দৌলতে সান্তাকে ঘিরে এসব চিত্রায়ণ দেখতে আমরা অভ্যস্ত। এই গল্পের উপকরণগুলি এসেছে বিভিন্ন সময়ে লেখা কাল্পনিক গল্প কবিতা লোককথা থেকে। একে একে উপকরণ সংগ্রহ করে গড়ে উঠেছে আজকের সান্তা।

১৮২১ সালে নিউ ইয়র্কে প্রকাশিত বই A New-year's present, to the little ones -এ একটি বেনামী কবিতা ছিল “Old Santeclaus with Much Delight”। এখানে রেইনডিয়ার-টানা স্লেজে চড়ে শিশুদের কাছে পুরস্কার আনতে যাওয়া সান্তাকে বর্ণনা করা হয়। ১৮২৩ সালে Troy Sentinel-এ বেনামে প্রকাশিত আরেক কবিতা « A Visit From St. Nicholas » ja ekhon « The Night Before Christmas » নামে পরিচিত, সেখানে সান্তার সম্পর্কে লেখা হয় 


মোটাসোটা ও হাসিখুশি বুড়ো এলফ, যার গোল পেট, হাসলে জেলি ভরা বাটির মতো কাঁপে।

এই কবিতায় আছে ক্রিসমাস ইভে উড়ন্ত বল্গাহরিণে টানা স্লেজে সেন্ট নিকোলাসের আগমন। সান্তা ক্লজের জনপ্রিয় ধারণার উৎস খ্রিস্টান বিশপ সেন্ট নিকোলাস থেকে। “সেন্ট নিকোলাস” বা সিন্টারক্লাস এর কিংবদন্তি ডাচ বসতিরা ১৭শ শতকে নিউ অ্যামস্টারডাম (বর্তমান নিউ ইয়র্ক সিটি) শহরে নিয়ে আসে।

১৮৫৩ সালের একটি ম্যাগাজিনে আমেরিকান ক্রিসমাস প্রথা বর্ণনার সময় বলা হয়, শিশুরা ক্রিসমাস ইভে স্টকিং ঝুলিয়ে রাখে “এক কল্পিত ব্যক্তির” জন্য, যার নাম পেনসিলভানিয়ায় “ক্রিস্‌ক্রিঙ্গ্‌ল” এবং নিউ ইয়র্কে “সেন্ট নিকোলাস” বা “সান্তা ক্লজ”। ৪র্থ শতাব্দীর গ্রিক খ্রিস্টান বিশপ সেন্ট নিকোলাস দরিদ্রদের প্রতি উদারতার জন্য পরিচিত ছিলেন। ৬ ডিসেম্বর তার উৎসবের আগের সন্ধ্যায় শিশুদের উপহার দেওয়া হত মধ্যযুগে। ধর্মীয় সংস্কারের পর থেকে এই উপহার দেওয়ার প্রথা অনেক দেশে ২৪ বা ২৫ ডিসেম্বরের সাথে যুক্ত হয়। সবার কাছে নিকোলাস উপহারদাতা হিসেবেই জনপ্রিয়, যার থেকে ধার করে এখন সান্তা ক্লজ উপহার নিয়ে আসা শুরু করে।

আরও পড়ুন

মাছ-সবজির নিলামে শুরু ক্রিসমাস! কেষ্টপুরের বড়দিন এক অজানা অধ্যায়

খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের আগে ইংল্যান্ড-সহ অন্যান্য জার্মানিক দেশগুলিতে মধ্যশীতকালীন ইউল উৎসবের প্রচলন ছিল। ইউল-সংক্রান্ত বহু ঐতিহ্য আধুনিক ক্রিসমাসের অংশ হয়ে ওঠে। যেমন, নর্স দেবতা ওডিনের ইউল-উৎসবকালীন ভূমিকা সেন্ট নিকোলাস ও সান্তা ক্লজের ভাবমূর্তিকে প্রভাবিত করেছে বলে ধারনা করা হয়। ওডিনের লম্বা সাদা দাড়ি, রাতে ধূসর ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো সান্তার বল্গাহরিণ-টানা স্লেজের দৃশ্যকল্পের সঙ্গে মিলে যায়।

সান্তা ক্লজের চিত্র ইংল্যান্ডের ফাদার ক্রিসমাস চরিত্রের সঙ্গেও মেলে। ১৬শ শতকের ইংল্যান্ডে হেনরি অষ্টমের শাসনামলে সবুজ বা রক্তিম পোশাক পরা এক বিশালাকৃতি ব্যক্তি ক্রিসমাসের আনন্দ, শান্তি, ভালো খাবার-পানীয় ও উল্লাসের প্রতীক ছিল। এই হলো ফাদার ক্রিসমাস। লোককথাবিদ মার্গারেট বেকার বলেন,

ফাদার ক্রিসমাস বা সান্তা ক্লজের চেহারা অনেকটাই ওডিনের কাছ থেকে এসেছে— উত্তরের নীল-হুড পরা, চাদর-ঢাকা, সাদা-দাড়িওয়ালা উপহারবাহক, যিনি তার আট-মুখওয়ালা ঘোড়া চড়ে মধ্যশীতের আকাশ বেয়ে মানুষের কাছে উপহার আনতেন।

যা জরুরি তা হলো জীবনে একটা সান্তা ক্লজ-এর উপস্থিতি। উৎসব আর আনন্দের এক প্রতীক। সান্তা ক্লজ বা ফাদার ক্রিসমাস বা সেন্ট নিকোলাস, যে নামেই ডাকা হোক তাকে, সবুজ নীল বা লাল-সাদা, যে রঙের পোশাক থাক তার গায়ে, সে আমাদের প্রতি যত্নবান থাকবে। এইটুকুই চায় মানুষ। কেউ তাকে মনে রেখেছে। সমষ্টিগত সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচে মনুষ্য জাতি। পুরনো লোককথা ঘেঁটে আমরা বেছে নিয়েছি সান্তার টুকরো টুকরো রূপ, যা আমাদের পছন্দের। যে গল্প নিজেকে বারবার শোনালে মনে হবে আমার বেঁচে থাকা মূল্যবান, তুলনাহীন। এভাবেই উৎসবের বিমূর্ত ধারণাকে রূপ দিয়ে এসেছে মানুষের কল্পনাপ্রবণ মন।

আর সান্তারা আমাদের আশেপাশেই যে সব সান্তা ক্লজরা রূপকথার সান্তার আড়ালে রয়েছে, যাদের যত্নের হাত মাঝরাতে আমাদের মোজায় ভরে দিচ্ছে নানা রঙের স্বপ্ন, আজীবন ধরে তাদের চিনতে শিখছি মধ্যশীতকালীন উৎসবে। সকলের জীবনে একটা করে সেন্ট নিকোলাস থাকুক, যাকে মনে রাখব কল্যাণময় বন্ধু রূপে।

More Articles