ঘৃণার রাজনীতি: এখন লক্ষ্য খ্রিস্টান?

Anti-Christian violence India: মিচেলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে খ্রিস্টান নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে ৮৩৪টি (গড়ে মাসে ৭০ টি)। ২০২৫ সালে নভেম্বর মাস পর্যন্ত নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে ৭০৬ টি।

আমাদের দেশে ধর্মীয় উৎসবের জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সামাজিক উৎসবে পরিণত হওয়ার ইতিহাস বহু পুরনো। দুর্গাপুজো,পীরের-মেলা, হোলি থেকে বড়দিন— একই পরম্পরা বহমান। কিন্তু অমৃতকালে ধর্মনিরপেক্ষতার কবর খুঁড়ে এ দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার স্বপ্নে মশগুল ঘৃণার রাজনীতির কারবারিদের কাছে এই সামাজিকতা এক বড় প্রতিবন্ধক। তাই ইদ হোক বা যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন,বুদ্ধ জয়ন্তী হোক বা ভ্যালেন্টাইনাস ডে— উৎসব এলেই রাস্তায় নেমে পড়ে হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত ঠিকেদার বজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এই ধর্মের ছদ্মবেশী গুন্ডারা এবার বড়দিনের উৎসব যাতে খ্রিস্টানরা শান্তিতে পালন না করতে পারে তার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পিত সন্ত্রাস চালাল। ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরে এক শপিং মল বড়দিন উপলক্ষে সাজানো হয়েছিল সান্তা ক্লজ,ক্রিসমাস ট্রি ও আলো দিয়ে। বজরং দলের লোকেরা সকলের সামনে ঘন্টাখানেক ধরে সেখানে ধ্বংসলীলা চালায়। উত্তরপ্রদেশের বরেলীতে বড়দিনের আগে হিন্দুত্ববাদীরা চার্চের বাইরে সমবেত হয়ে হনুমান চালিশা পাঠ করে এবং চার্চের লোকদের 'জয় শ্রীরাম' বলতে বাধ্য করায়। অসমে বড়দিনের জন্য সাজিয়ে তোলা সেন্ট মেরি স্কুলে ভাঙচুর চালায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এই খন্ড চিত্রগুলিকে জুড়ে দিলে একটা ছক পরিষ্কার হয়ে যায়। সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের আজকের ভারতে প্রকাশ্যে নিজেদের ধর্মীয় উৎসব পালনের অধিকার নেই। আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না সোশ্যাল মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্ট যেখানে 'সনাতনী হিন্দুদের' বড়দিনে চার্চে না যাওয়ার ফতোয়া দেওয়া হয়েছে।

এবারে বড়দিনের সময় খ্রিস্টানদের উপর এই তান্ডব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইউনাইটেড খ্রিস্টান ফোরাম (দেশের খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষদের সমন্বয় মঞ্চ) কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এক এসওএস পাঠিয়ে অনুরোধ করেন যাতে ধর্মান্তরের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের ২৪ ডিসেম্বর ছত্তীসগঢ়ে বনধ বাতিল করা হয়। বড়দিনের আগের দিন এই বনধ ডাকা যে রাজ্য জুড়ে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে এক ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করতে, তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স জানার প্রয়োজন হয় না। এই ফোরামের ন্যাশানাল কো অর্ডিনেটর এসি মিচেল যে তথ্যপ্রমাণ দিয়েছেন তা অত্যন্ত শঙ্কাজনক। মিচেলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে খ্রিস্টান নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে ৮৩৪টি (গড়ে মাসে ৭০ টি)। ২০২৫ সালে নভেম্বর মাস পর্যন্ত নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে ৭০৬ টি। ইউএসএফের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, নিগ্রহের তালিকায় প্রথম দুটি রাজ্য হলো ছত্তীসগঢ় ও উত্তরপ্রদেশ।  খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো লোভ দেখিয়ে বা ভুল বুঝিয়ে ধর্মান্তকরণ। মজার কথা হলো, এই ধরনের অভিযোগ কখনোই যাদের খ্রিস্টান করা হয়েছে বলে অভিযোগ, তারা করছে না। অভিযোগ করছে তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির কর্তাব্যাক্তিরা। দেশের প্রমুখ মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন অব সিভিল লিবার্টিজ তাদের তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টে দেখিয়েছে, খ্রিস্টানদের উপাসনাস্থল ভেঙে দেওয়া, পুলিশের হামলাকারীদের পক্ষ নেওয়া নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

ঘৃণাপ্রচারেই এদেশে আরও পিছিয়ে পড়ছেন সংখ্যালঘু মুসলিমরা?

আদিবাসী খ্রিস্টানদের নিগ্রহ করার আরেকটি উপায় হলো তাদের গ্রামের প্রান্তে কবরখানা ব্যবহার করতে না দেওয়া। ইউএসএফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কবরের জন্য জমি ব্যবহার করতে না দেওয়া, এমনকি কবর থেকে খুঁড়ে মৃতদেহ তোলা, শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের নিগ্রহের ঘটনা শুধু ২০২৫ সালেই ঘটেছে ২৩ টি, যার বেশিটাই আবার ছত্তীসগঢ় ও ওড়িশায়। ২০২৪ সালে সমাধিস্থ করা নিয়ে গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছিল ৪০ টি। অতি সম্প্রতি ( ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫) ছত্তীসগঢ়ের কাঙ্কেরে রাজমন সালাম নামে এক পঞ্চায়েত প্রধান মারা যাওয়ার পর পরিবারের লোকেরা খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ী তাদের নিজেদের জমিতে কবর দেয়। এর পর এক সশস্ত্র গুন্ডাদল সেখানে হামলা করে ও পুলিশ সেই মৃতদেহ খুঁড়ে তুলতে বাধ্য করে।

খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার রাজনীতি ফেরি করার আরেকটি কৌশল হলো তাদের আদিবাসী পরিচয় কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের পৃষ্টপোষকতায় ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা ও রাজস্থানে একাধিক সংগঠন গড়ে উঠেছে (যাদের মধ্যে প্রধান জনজাতি সুরক্ষা মঞ্চ) যারা একের পর এক র‍্যালি আয়োজন করে বলছে আদিবাসীর ধর্মপরিচয় খ্রিস্টান বা ইসলাম হলে তাকে আর আদিবাসী বলা যাবে না। অথচ ভারতের সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে আদিবাসী পরিচিতির সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই।

আরও পড়ুন

বলতেই হবে জয় শ্রীরাম! ওড়িশা থেকে যেভাবে প্রাণে বেঁচে ফিরলেন আশিক

বিষয়টা শুধু শারীরিক ভাবে খ্রিস্টানদের নিগ্রহ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এক বহুস্তরীয় পরিকল্পনা। এ বছর ১৩ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী সুরেন্দ্র গুপ্তর এক চিঠিতে বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যায়। এই চিঠিতে খুব স্পষ্ট ভাষায় হিন্দুদের নিজ ধর্ম রক্ষার্থে ও সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য চার্চে যেতে এবং বড়দিন উপলক্ষে কোনো উৎসবে অংশ নিতে নিষেধ করা হয়েছে। এই চিঠির একটা অংশে হিন্দু ব্যবসায়ীদের 'হ্যাপি ক্রিসমাস' জাতীয় কোনো ফেস্টুন/ ব্যানার লাগাতে বারণ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে মুনাফার কারণে ক্রিসমাস সামগ্রী বিক্রি করা হিন্দু ধর্মের অসম্মান। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এই চিঠি শুধু অসাংবিধানিক নয়, একই সঙ্গে তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভঙ্গ করার নিকৃষ্ট উদাহরণ। এই পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ২৫ ডিসেম্বর অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিনকে সামনে রেখে উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে 'গুড গভর্নেন্স ডে' পালন করা হচ্ছে। এই দিনটাতে সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বরকে হিন্দু ধর্মের ক্যালেন্ডারে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাতারাতি শুরু হয়েছে 'তুলসী পূজন দিবস'। এই ষড়যন্ত্রের ফলাফলও দৃশ্যমান। কেরলের মতো বামশাসিত ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের রাজ্যে এবার বহু স্কুলে কেরল গান ও বড়দিনের উৎসব বাতিল করা হয়েছে।

ভারতে শেষ আদমসুমারী অনুযায়ী, ২৭.৮ মিলিয়ন খ্রিস্টান বাস করেন, মোট জনসংখ্যার যা ২.৩%। আজ সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করার যে কৌশল এদেশে লাগু হয়েছে তাতে কেউই আর নিরাপদ নয়। এ বছর বড়দিন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী খ্রিস্টানদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তখন দেশের বহু জায়গায় প্রাণভয়ে উৎসব পালন থেকে বিরত থেকেছেন। ধর্মান্তরের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার নামে ধর্মান্তর বিরোধী আইনগুলি হচ্ছে নির্যাতনের নয়া অস্ত্র। বিশিষ্ট অধিকার কর্মী তথা আইনজীবী কলিন গঞ্জালভেস সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন: 

The anti-conversion laws give the police and right wing groups like Bajrang dal a cover for attacking christans

আজ খ্রিস্টানদের উপর যা হচ্ছে তার ট্রেলার আমরা নব্বই-এর দশকে দেখেছিলাম গুজরাটের ডাং-এ বড়দিনের উৎসব নিষিদ্ধ করার মধ্যে, নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছিলাম ওড়িশার কেওঞ্জরে সপরিবারে খ্রিস্টান যাজক গ্রাহাম স্টেইনসকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার মধ্যে, কর্নাটকের মেঙ্গালুরুতে ভ্যালেনটাইনস ডে তে পার্কে বসে থাকা যুবক যুবতীদের ন্যাড়া করার মব সন্ত্রাসের মধ্যে। এই অমৃতকালে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয়েছে মাত্র।

More Articles