এক বাঙালির জেদে জুড়ল দুই বাংলা: টেলিগ্রাফ ম্যান শিবচন্দ্র নন্দী

Seebchunder Nandy: ১৮৫১ সালে কলকাতা-ডায়মন্ড হারবার লাইনের প্রথম সংকেত প্রেরণের সময় শিব চন্দ্র নন্দী ডায়মন্ড হারবার থেকে বার্তা পাঠান, অন্য প্রান্তে ও'শাগনেসির সঙ্গে ছিলেন লর্ড ডালহৌসি।

কলকাতার বড়বাজার এলাকা মানেই ঘিঞ্জি গলি, মালবাহী লরি আর ব্যস্ত মানুষের ভিড়। এই ভিড়ের মধ্যেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একটি গলি— ‘শিবনন্দী লেন’। সাধারণ পথচারীর কাছে এটি হয়তো আর পাঁচটা গলির মতোই সাধারণ, কিন্তু ইতিহাসের ধুলো ঝাড়লে দেখা যায়, এই লেনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অকুতোভয় বাঙালির গপ্পো। তিনি শিবচন্দ্র নন্দী, যাঁকে ইতিহাস চেনে ভারতের ‘টেলিগ্রাফ ম্যান’ হিসেবে।

​সেই সময় ভারতে সবে পা রেখেছে বিদ্যুৎ-বার্তা বা টেলিগ্রাফ। যন্ত্রটি থেকে ক্রমাগত একঘেয়ে ‘টক্ টক্’ শব্দ বেরোত বলে রসিক বাঙালি এর নাম দিয়েছিল ‘টরেটক্কার কল’। আধুনিকায়নের চাকা তখন ঘুরতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম ব্রুক ও’শাগনেসি ভারতে ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফের স্বপ্ন দেখছেন। ব্যারাকপুর থেকে এলাহাবাদ হয়ে মির্জাপুর— একের পর এক জায়গায় টেলিগ্রাফের খুঁটি পুঁতে লাইন পাতার কাজ চলছে। কিন্তু আসল বাধা হয়ে দাঁড়াল ওপার বাংলার প্রমত্তা পদ্মা।

​কলকাতা থেকে ঢাকা সংযোগ করতে হলে সাত মাইল চওড়া পদ্মার তলা দিয়ে সাবমেরিন কেবল বা ডুবো-তার নিয়ে যেতে হবে। এমন দুঃসাহসিক কাজে কোনো বড় স্টিমার কোম্পানি এগিয়ে আসার সাহস পেল না। উত্তাল পদ্মার ঢেউ দেখে পিছিয়ে গেলেন দুঁদে নাবিকরাও। কাজ যখন প্রায় ভেস্তে যাওয়ার মুখে, তখনই ও’শাগনেসি সাহেবের নজর পড়ল কলকাতার টাঁকশালের এক কর্মীর দিকে। তিনি শিবচন্দ্র নন্দী। ও’শাগনেসি জানতেন, এই মানুষটির মধ্যে মেধা আর জেদ দুই-ই আছে।

আরও পড়ুন- লুইজ থেকে লোডিং ক্রেন: খিদিরপুর ডকের ১৩৩ বছরের যাত্রাপথ

​শিবচন্দ্র নন্দী কেবল কাজে রাজিই হলেন না, বরং অসম্ভবকে সম্ভব করার পথ দেখালেন। কোনো বিশাল স্টিমার নয়, সামান্য কয়েকটা জেলে ডিঙি নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন পদ্মার বুকে। প্রতিকূল আবহাওয়া আর উত্তাল স্রোতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জলের তলা দিয়ে প্রায় সাত মাইল তার বিছিয়ে দিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, উপকরণের অভাবে যখন কাজ আটকে যাচ্ছিল, তখন বিলেতি লোহার খুঁটির ভরসায় না থেকে দেশি তালগাছকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে।

​তবে এই কাজ করতে গিয়ে বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন তিনি। একবার কাজের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার সময় খেয়ালই করেননি যে তিনি চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে আছেন। বন্ধুর উপস্থিত বুদ্ধিতে সে যাত্রায় প্রাণ বাঁচে তাঁর। আবার এক ইংরেজ সেনার ষড়যন্ত্রে তাঁকে গভীর জঙ্গলে অজগরের মুখেও পড়তে হয়েছিল। কিন্তু কোনো বাধাই এই কাজপাগল মানুষটিকে দমাতে পারেনি।

ছবি: এ আই দ্বারা নির্মিত

​ ১৮৫১ সালে কলকাতা-ডায়মন্ড হারবার লাইনের প্রথম সংকেত প্রেরণের সময় শিবচন্দ্র নন্দী ডায়মন্ড হারবার থেকে বার্তা পাঠান, অন্য প্রান্তে ও'শাগনেসির সঙ্গে ছিলেন লর্ড ডালহৌসি। তিনি সাংকেতিক ধ্বনিতে শিবচন্দ্রকে অভিনন্দন জানান।যখন, সরকারিভাবে টেলিগ্রাফ চালু হয়, তিনি পদোন্নতি পেয়ে হন ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট’। একজন ভারতীয় হিসেবে সেই যুগে যা ছিল অভাবনীয় সম্মান।

উইলিয়াম ব্রুক ও'শাগনেসি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, আর শিবচন্দ্র নন্দী ছিলেন সেই স্বপ্নের রূপকার। তাঁদের আলাপ হয়েছিল কলকাতার টাঁকশালের (Calcutta Mint) রিফাইনারি বিভাগে। ও'শাগনেসি যখন ভারতে টেলিগ্রাফ আনার পরিকল্পনা করছেন, তখন তাঁর এমন একজন মানুষের প্রয়োজন ছিল যিনি তাত্ত্বিক জ্ঞানের চেয়ে হাতে-কলমে কাজ করতে বেশি দক্ষ। তিনি শিবচন্দ্রের মধ্যে সেই স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেয়েছিলেন।

​সেই যুগে একজন ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে একজন বাঙালির এমন গভীর পেশাদার সম্পর্ক ছিল বিরল। ও'শাগনেসি তাঁর লেখায় বারবার শিবচন্দ্রের মেধার প্রশংসা করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, আজ কলকাতায় যেমন ‘শিবনন্দী লেন’ আছে, তেমনই ডালহৌসি চত্বরে হাইকোর্টের কাছে ‘ও'শাগনেসি স্ট্রিট’ আজও এই দুই কর্মবীরকে ইতিহাসের পাতায় পাশাপাশি অমর করে রেখেছে।

পরবর্তীকালে ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময় লাইন মেরামত থেকে শুরু করে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার বিস্তারে শিবচন্দ্র নন্দীর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার 'টেলিগ্রাফ ম্যান'কে রায় বাহাদুর উপাধি দেন। আজ ফাইবার অপটিক আর স্মার্টফোনের যুগে টেলিগ্রাফ বিলুপ্ত। সেই তামাটে তারের শব্দও স্তব্ধ হয়ে গেছে বহুকাল আগে। কলকাতা শহরের পরিবর্তনের জোয়ারে আমরাও হয়তো ভুলেছি এই বঙ্গসন্তানকে। বিশাল ভারতের বৈদ্যুতিন বিপ্লবের সেই কারিগর, আজ কেবল একটি নীল রংয়ের নামফলকে সীমাবদ্ধ— ‘শিবনন্দী লেন’। বড়বাজারের সেই সরু গলিটি আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে এই অকুতোভয় বাঙালির রক্ত আর ঘাম মিশে আছে।

More Articles