২১-এর দেওয়াল লিখন ম্যান্ডেরিন ভাষায়, কলকাতার চিনকে কাছে টানতে চায় সব পক্ষই

কলকাতার হৃদস্পন্দনের ধুকপুক আওয়াজের সঙ্গে মিলে গেছে চিনের আত্মা।  ২১ জুলাইও উপলক্ষে শহর দেখল চিনা ভাষায় দেওয়াল লিখন।

টেরিটি বাজার কিংবা ট্য়াংরা। কলকাতায় একটুকরো চিন। আজ কলকাতায় চিনাদের সংখ্যা প্রায় ২ হাজারে এসে ঠেকেছে। চিনা পরিবার তাদের বসতি গড়ে তুলেছে পোদ্দার কোর্টের কাছে টেরিটি বাজার এলাকায়। সেখানে সকাল হলেই মোমো, সসেজের টানে ভিড় করেন চিনে খাদ্যরসিকরা। ঝগড়া, বিবাদ খাতায় কলমে আছে থাক, কলকাতার হৃদস্পন্দনের ধুকপুক আওয়াজের সঙ্গে মিলে গেছে চিনের আত্মা।  ২১ জুলাইও উপলক্ষে শহর দেখল চিনা ভাষায় দেওয়াল লিখন।

এই আত্মীকরণ কি ভোটের তাগিদ? গন্ধটা সেরকমই। কারণ এই চিনারাও তো ভোটার। একুশে জুলাইয়ের সমাবেশে এবার চিনা যোগে মেতে উঠল শহর কলকাতা। খাস কলকাতায় এক ঝলক চিন! সামনেই লোকসভা ভোট। তার আগে শহিদ দিবসের সমাবেশ উপলক্ষে কলকাতা সাক্ষী থাকল এই চমকের।

কলকাতায় উঠে এল চিনা ভাষায় দেওয়াল লিখন। কলকাতার ট্যাংরাতে চিনা ভাষায় দেওয়াল লিখন আগেও দেখা গেছে। সিটি অফ জয়। কলকাতা। এই শহরের বুকেই রয়েছে এক টুকরো চিন। কলকাতার এই চিনা পাড়া যেন বাংলার মিশ্র সংস্কৃতির প্রকৃষ্ট উদাহারণ। এই পাড়ার বাসিন্দারা ভোটে অংশগ্রহণ করেন। দেওয়াল লিখন হয় চিনা ভাষায়। কারণ কলকাতার আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে যে চিনারা, তাঁদের উপেক্ষা করতে পারে না শাসক দলও।

সালটা ১৯৬২। ইন্দো-চিন যুদ্ধের পর কাজের খোঁজে ভারতে চলে আসে অনেক চিনা পরিবার। তাও প্রায় কয়েক হাজার। আজও তাঁরা টিকে আছেন এই শহরের বুকে। মিশে গেছেন কলকাতার স্পিরিটের সঙ্গে। প্রথম দিকে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও পরে ট্য়াংরায় তাঁদের বসতি বাড়তে শুরু করে। পরিচয়ে তাঁরা চিনা হলেও ধীরে ধীরে ভারত-আত্মার সঙ্গে মিলে হয়ে উঠেছেন ভারতীয়।

ট্যাংরায় তাঁদের বসতি গড়ে ওঠার পেছনে ইতিহাস আছে। ১৯৭৮ সালে ওয়াং চাউ আসেন কলকাতায়। শোনা যায় তিনিই ছিলেন কলকাতায় আসা প্রথম চাইনিজ। তাঁর হাত ধরে শুরু হয় চামড়ার ব্যবসা, খোলেন রেস্তোরাঁও। তবে সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশের পর অনেকে ভারত ছাড়েন। মজার বিষয় হল ট্যাংরায় বসবাসকারী চিনারা নির্ভেজাল বাংলা বলতে পারেন। এখানে ভোট উৎসব চলে। এঁরাও ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন ভোটার। তাই এখানে দেওয়াল লিখন হয় চিনা ভাষায়।

কিছুদিন আগেও ভোট যুদ্ধের সঙ্গে দেওয়াল লিখনের নিবিড় যোগ ছিল। এখন ফেসবুকের ওয়াল কাড়ছে দেওয়াল লিখনের ঐতিহ্য। রঙিন নামাবলী গায়ে বিলকুল পাল্টে যেত পাড়ার লোনাধরা, স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালগুলো। বাদ যেত না পথের মোড়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝাঁ চকচকে দেওয়াল। এখনও মনের কোণে উঁকি দেয় কোনও এক পুরভোটে দেওয়ালে ছড়া যুদ্ধ। মান যাই হোক, ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল এই সব দেওয়াল লিখন-

সিপিএমের দেওয়াল লিখন-`করলে তুমি ডেলোর কেলো। মদন, মুকুল মাল কামালো। বলছে এখন চোরের মা। আমি কিছু জানি না।‘

তৃণমূল দেওয়ালে জবাব দেয় এভাবে-

`হাতে নয়, কাস্তেতে নয়। ভোট নয় পদ্মফুলে। মা বোনেরা জোট বেঁধেছে। সব ভোট তৃণমূলে।‘ কিংবা

`বাম শাসনে শুধুই ভাঁওতা আর ভুল। উন্নয়ন মানেই তৃণমূল।‘

একসময় বিপক্ষের বিরোধিতা থেকে শুরু করে ভোটের ইস্যু। এমনকী ভোটারদের কাছে প্রতিশ্রুতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে সব দলেরই মূল হাতিয়ার ছিল দেওয়াল লিখন। কালের বিবর্তনে প্রচারে এখন বেশি গুরুত্ব পায় হরেক রকমের ছাপানো ফ্লেক্স, ব্যানার। গুরুত্ব হারিয়েছে ভোটকে কেন্দ্র করে লেখা ছোট ছোট ছড়া। আগে ভোটের আগে দেওয়ালগুলি হয়ে উঠত দেওয়াল পত্রিকা। সেই সব দেওয়াল তুলে ধরত বাংলা সাহিত্যের বিচিত্র ধারাকে। ছড়ার আকারে রাজনৈতিক দলগুলির নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি যেমন থাকত, তেমনি থাকত স্থানীয় ইস্যু, প্রতিশ্রুতি। সে সব ছবি এখন অনেকটাই ফিকে। রাজনৈতিক দলগুলি কলম, তুলির জোরের থেকে অনেক বেশি দেখাতে চায় বাহুবল, লোকবল আর অর্থবল। তাই দেওয়াল লিখন ঠাঁই নিয়ে স্মৃতির অতলে।

আমাদের দেশে ভোটের সঙ্গে দেওয়াল লিখনের যোগ থাকলেও, সারা বিশ্বে গ্রাফিতির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। একবার সেইদিকে তাকানো যাক।

সহজ ভাষায় গ্রাফিতি বলতে দেওয়ালে আঁকা ছবিকে বোঝায়। গ্রাফিতি হল সাধারণ কোনও চিত্রকর্ম বা দেওয়াল লিখন, যাতে শিল্পীর সূক্ষ্ম বার্তা লুকানো থাকে। দেশে দেশে সামাজিক অবিচার, সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা যুদ্ধের বিরুদ্ধে শিল্পীরা গ্রাফিতির মাধ্যমে সমাজের কাছে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। শান্তির পক্ষে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান ফুটে ওঠে কোনও কোনও দেওয়াল লিখনে। বঙ্গ, বিদ্রূপাত্মক চিত্রের মাধ্যমে সমাজের বাস্তবতা শিল্পী তাঁর তুলির আঁচড়ে নিখুঁতভাবে তুলে আনেন

Steve Jobes by Banksy

বাঙ্কসির গ্রাফিতিতে স্টিভ জোবস ধরা দিয়েছেন একজন শরণার্থী হিসেবে।

বাঙ্কসির গ্রাফিতিতে স্টিভ জোবস ধরা দিয়েছেন একজন শরণার্থী হিসেবে।

গ্রাফিতির ইতিহাস বহু পুরানো। প্রাচীন রোম থেকে পম্পেই নগরীর বিভিন্ন সমাধিক্ষেত্রের দেওয়ালে গ্রাফিতির চিহ্ন পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে গ্রাফিতির প্রতিবাদের ভাষা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে `Kilory was here’ নামক গ্রাফিতি আমেরিকার দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে পড়ে। টাকমাথার লম্বা নাকওয়ালা এক লোক দেওয়াল ধরে বসে আছেন-এটাই ছিল কিলরয়ের উপজীব্য। সে সময় এই গ্রাফিতিটি আমেরিকান সেনাদের ব্যবহারে জর্মানদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা মনে করেন, এটা আমেরিকান সেনাবাহিনীর গোপন কোনও কোড। যদিও আজ পর্যন্ত এর সুপ্ত অর্থ জানা যায়নি।

বিশ্বজুড়ে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে গুহা ও ভবনের দেওয়াল, রাস্তা, ট্রেন সহ নানা জায়গায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, আর্জেন্টিনা, ফিলিস্তিন সহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই আছে এই দেওয়াল চিত্র বা গ্রাফিতি। অনেক দেশে একে জনগণের সম্পত্তি নষ্ট বলে মনে করা হয়। অনেক দেশেই নগর কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেয় নগরের দেওয়াল জুড়ে থাকা এসব গ্রাফিতি মুছে দিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশেও গ্রাফিতি আঁকার শাস্তি হিসেবে কারাণ্ডের বিধান প্রচলিত।

বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে গ্রাফিতি এক প্রতিবাদের ভাষা। শিল্পীর মনের খোরাক। শক্তিশালী আর্ট ফর্ম। দেওয়াল থেকে আঁকা মুছে দিলেও, তাই কোনও দেশের শাসক তাঁর লাল চোখ দেখিয়ে শিল্পী মন থেকে গ্রাফিতি মুছে দিতে পারে না।

More Articles