এক নারী এবং এক আশ্চর্য হত্যা মামলা

ইতিহাস আমাদের এমন কিছু ঘটনার সামনে দাঁড় করায় যা আমাদের স্তম্ভিত করে দেয়।  আজ বলব চিনের এক হত্যাকাহিনির কথা, বলা ভাল হত্যাকারিণীর কথা। তবে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়া।    

চিনে তখনও ‘কুইং’ (Qing) রাজত্ব শেষ হয়নি। ক্ষীণভাবে হলেও সে শিখা তখনও বর্তমান।এমন এক সময় চিনের আনহুইতে (Anhui) জন্ম নেন সি জানজাঁউ। তাঁর আসল নাম ছিল সি গুলান। এক ছোট্ট গ্রামে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। প্রাথমিকভাবে তাঁর পরিবার ছিল কৃষি-নির্ভর। কিন্তু বিশ শতকের মধ্যভাগে চিনের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় এবং এই পরিবর্তনের আঁচ এসে পরে এই ছোট্ট পরিবারটিতেও। কৃষি বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে সি জানজাঁউয়ের পিতা, সি কংবিন একজন উচ্চপদস্থ সৈন্য হিসাবে নিযুক্ত হন। কিন্তু কে জানতো , এই সৈন্য পদই একদিন কংবিনের জীবনের মৃত্যু্র কারণ হয়ে দাঁড়াবে!     

১৯১১ সালে ‘কুইং’ রাজত্বের পতন ঘটলে, চিনে এক বিশৃঙ্খলার পরিবেশ দেখা যায়। রাজপরিবারের পরিবর্তে চিনে শাসকদল হিসাবে স্থান অধিকার করতে শুরু করে নানান যুদ্ধকারীরা, অনেকে আবার এদের সৈন্যবাহিনী হিসাবেও চিহ্নিত করেছেন। এই সময়কে বলা হয় ‘warlord period’ (আনুমানিক ১৯১৬ সাল থেকে ১৯২৮ সাল)। ১৯১৫ সালের পর থেকে বেইজিং একাধিকবার বিভিন্ন ক্ষমতার কাছে হস্তান্তরিত হতে থাকে। বিভিন্ন ছোট-বড়ো এলাকা দখল নিয়ে বিভিন্ন যুদ্ধকারীরা নিজেদের মত করে শাসন চালাতে থাকে। ১৯২০ দশকে অপেক্ষাকৃত নৃশংস এক মিলিটারির অধীনে সি কংবিন একজন লুইট্যানান্ট হিসাবে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৯২৫ সালে তিনি যখন তাঁর সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ চালাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে অপহরণ করা হয়। অপহরণ করে তাঁর বিপক্ষে থাকা সৈন্যদলটি এবং পরেরদিনই বিনা বিচারে তাঁকে হত্যা করা হয় এবং শুধু তাই নয়, নৃশংসতা এবং অমানবিকতার উদাহরণস্বরূপ একটি রেলস্টেশনে শূলের উপর তাঁর ছিন্ন মুণ্ডুটির প্রদর্শন করা হয়। সান চাঙফেন, এই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। পরের দিকে তিনি আরও এরকম অনেক যুদ্ধে জয়লাভ করে মধ্য চিনের উপকুলীয়বর্তী এলাকায় রাজত্ব বিস্তার করেন। ন্যানজিনে তিনি তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে রাজত্ব চালাতে থাকে। এই ঘটনার কিছু পর থেকেই সি জানজিঁউ তাঁর পিতার হত্যাকারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ছক কসতে থাকেন। এই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। কিন্তু সান চাঙফেন, তাঁর এই সাফল্য বেশিদিন উপভোগ করতে পারেরনি। ১৯৩১ সালে তিনি তাঁর সৈন্য জীবন থেকে অবসর নেন এবং তিয়ানজিনে বসবাস করতে শুরু করেন। নতুন করে তাঁর বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস জন্মায়। 

এই সমস্ত সময়টায় সি জানজাঁউ , সানের উপর নজর রাখেন এবং তিনিও তিয়ানজিনে দীর্ঘ কয়েকমাস বসবাস করেন। একজন শিকারি যেমন শিকারের প্রতিটা পদক্ষেপ লক্ষ্য করে থাকে , ঠিক সেইভাবেই সি জিনজিঁও, চাঙফেনের প্রতিটা চাল-চলন লক্ষ করেন এমনকি বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়েও তাঁর কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। সান চাঙফেন এই সময় ওই বৌদ্ধ মন্দিরের সদস্য হওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন। অবশেষে আসে সেই সুবর্ণ সুযোগ। ১৯৩৫ সালের ১৩ই নভেম্বর দুপুরবেলা সান যখন মন্দিরে প্রার্থনারত অবস্থায় ছিলেন, সেই সময় সি জানজাঁউ তাঁকে পিছন থেকে আঘাত করেন। তাঁর মাথায় এবং পিঠে মোট তিনটি গুলি তিনি চালিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই হত্যার পর তিনি কোথাও পালানোর চেষ্টা করেননি। বরং তিনি নিজেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন এবং অতি সহজেই স্বীকার করেছিলেন, এটি ছিল তাঁর বহুদিনের এক পরিকল্পিত হত্যা। এমনকি এই হত্যার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি প্রচারপত্রও বিলি করেন। এই প্রচারপত্রে শুধুমাত্র কারণ ছাড়াও লেখা ছিল তাঁর পিতার উদ্দেশে রচিত কিছু কবিতা। এই হত্যা যে ছিল তাঁর বহুদিনের পরিকল্পনা তা দৃঢ় ভাবে প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে তিনি সেই সময় তাঁর নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন জানজাঁউ, যার অর্থ একজন দক্ষ তলোয়ারবাজ। পিতার প্রতি অন্যায়ের প্রতিশোধ এভাবেই এক সাধারণ নারীকে সেদিন এক হত্যাকারীতে পরিণত করেছিল।

আপনারা জানলে অবশ্যই অবাক হবেন, এই হত্যা মামলায় শেষমেশ তাঁর কোন সাজা হয়নি। তিনটি আদালতের দ্বারস্থ হতে হলেও অবশেষে শীর্ষ আদালত এই ঘটনার রায় দিতে গিয়ে বলেছিল, “constitutes a violation of criminal law. But if we consider that she was a lone woman acting upon filial thinking and with little regard intent merits commiseration and extraordinary circumstances [of the crime] are forgivable.”

তাঁর জীবন এখানেই থেমে থাকেনি। চিনে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি সরকারের হয়ে বেশ কিছুদিন কাজ করেন এবং এই হত্যার ৪৫ বছর পর ১৯৭৯ সালে পরলোকগমন করেন।

 

 

তথ্যসূত্র-

১. https://supchina.com/2020/10/14/a-clash-of-tradition-and-modern-law-the-pardon-of-assassin-shi-jianqiao/ 

২. https://www.chinafile.com/library/books/Public-Passions

৩. https://www.ranker.com/list/historical-female-assassins/melissa-brinks

More Articles