সিরিয়াল কিলার যখন চিকিৎসক!

"মারে হরি, রাখে কে" নয় ঠিক, এই গল্পের উপজীব্য বিচার করে, উপযুক্ত শিরোনাম হতে পারে, "মারে ডাক্তার, রাখে কে?" যদিও, গল্প নয় মোটেই। যাঁদের হাতে থাকে রোগীর জীবন এবং রোগীর পরিবার তথা গোটা মানবজাতির ভরসা, তাঁরাই যদি ঘড়ির উল্টোপথে চলে, একের পর এক খুন করে চলেন, তখন কতটা অসহায় হয়ে পড়ে সমাজ? এই কাহিনি এমনই কিছু অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর ঘটনাবলীর একত্রীকরণ, যেখানে রক্ষক-ই হয়ে উঠেছে ভক্ষক, নিরাপরাধ রোগীদের প্রাণ গিয়েছে মুড়ি-মুড়কির মতো!
আসুন, তবে শোনা যাক এরকম কিছু অদ্ভুত সিরিয়াল কিলারদের কথা–

হ্যারল্ড শিপম্যানঃ

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সিরিয়াল কিলার যদি বিখ্যাত এক চিকিৎসক হয়, তবে কেমন হবে ভেবে দেখেছেন? কেমন হবে যদি জীবনদায়ী মানুষগুলোই হয়ে ওঠে জীবনের ভক্ষক, জীবনপিপাসু। এমনই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার। বছরের পর বছর অধ্যবসায়ের পর চিকিৎসাবিদ্যায় নিজেকে উৎসর্গ করে এক জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন ডক্টর শিপম্যান। ম্যানচেস্টারের এক ছোট্ট শহর হাইড-এ ছিল তাঁর কর্মযজ্ঞের আখড়া। জনপ্রিয় এই চিকিৎসক তাঁর সুদক্ষ চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বারা অনেকের মন জয় করলেও কিছু মানুষ তার চিকিৎসার একটি বিশেষ দিক লক্ষ্য করেন। তাঁর চিকিৎসাধীন বেশ কিছু বয়স্ক মানুষের আকস্মিক মৃত্যু নাড়া দিয়ে যায় কিছু মানুষকে। ধীরে ধীরে সন্দেহজনক এক ব্যক্তিতে পরিণত হতে থাকেন শিপম্যান। তবে উপযুক্ত কোনও প্রমাণ না মেলায় তাঁর নৃশংস কর্মকাণ্ড আড়ালেই থেকে যায় এবং এভাবেই একটু একটু করে বাড়তে থাকে তাঁর খুন করবার প্রবণতা। তাঁর খুন করার প্রধান হাতিয়ার ছিল মারণ ড্রাগ- ডাইমরফিন, যা বিষাক্ত মরফিনের একটি প্রকারভেদ মাত্র। তিনি এই ড্রাগ, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দিতেন রোগীদের রক্তে, কিন্তু মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রকাশ করতেন অন্য কোনও রোগ। তিনি তাঁর কুকর্ম চাপা দেওয়ার জন্য পোস্ট মর্টেমের বদলে দ্রুত সৎকারকার্যে উৎসাহিত করতেন মৃতের পরিবারকে– এমন অভিযোগও উঠেছিল পরে। তাঁর এই নৃশংস হত্যালীলায় বাধা আসে যখন ক্যাথলিন গ্রান্ডি নামক এক একাশি বছরের বৃদ্ধার মৃত্যু ঘটে তাঁর হাতে। সেই মৃতার কন্যার সন্দেহভাজন হয়ে ওঠেন শিপম্যান। নিজের রোগীর মৃত্যুকে বা মৃত্যুর কারণকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে, শিপম্যান ঝাঁপিয়ে পড়েন বৃদ্ধার সম্পত্তির দিকে এবং এই ঘটনাই নাড়া দিয়ে যায় সেই মহিলাকে। ১৯৯৮ সালের এই ঘটনার পর শিপম্যানের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয় এবং সন্দেহজনক তথ্য পাওয়ার পর আরও গভীরভাবে চলতে থাকে তদন্ত।

পরবর্তীকালে পনেরোজন নিরপরাধ মানুষকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। শিপম্যান প্রাথমিকভাবে ক্রমাগত সব অস্বীকার করে গেলেও শেষে ২০০০ সালে নিজের কৃতকর্মের স্বীকারোক্তি করেন, এবং এই তদন্তে ইতি পড়ে। এই ঘটনার চার বছর পর, জেলের ভেতর থেকেই শিপম্যানের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীকালে, গবেষকরা জানান এই নৃশংস খুনীর জীবৎকালে করা খুনের আসল সংখ্যাটা ১৫ না হয়ে ২১৫ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

জেন টোপ্যানঃ

সেবিকা মানেই সাদা পোশাকের এক ফুটফুটে পরি। আর্ত ও পীড়িতদের আস্থা, জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে এক কোমল স্বস্তির স্পর্শ। উনিশ শতকে এমনই এক সেবিকার খোঁজ মিলেছিল বোস্টনে। তাঁর সেবায় মৃত্যুমুখী রোগীরা সুস্থ হয়ে ফিরে আসত পরিবারের কাছে। তবে এই কোমল, নরম স্পর্শের ছোঁয়া কখন যে বদলে গেলো বিষাক্ত মৃত্যুযন্ত্রণায়, কেউ টের পেল না। মমতাময়ী এই সেবিকার হাতে বাড়তে থাকল মৃত্যুর হার। কারণ, অতিরিক্ত মরফিন ও অ্যাট্রোপিনের প্রয়োগ।

টোপান জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৫৭ সালে, নিজের ২৮ বছর বয়স পর্যন্ত নিরলস পরিশ্রমী এক পরিচারিকা হিসেবে তিনি টোপান পরিবারকে সেবা করতেন। আইনগতভাবে তাকে কখনও দত্তক না নেওয়া হলেও, তিনি হয়ে উঠেছিলেন টোপান পরিবারেরই একজন। পরবর্তীকালে, একজন সুদক্ষ সেবিকা হওয়ার জন্য তাঁদেরই শহরে এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগদান করেন এবং সেখানেই ঘটে তাঁর নৃশংস খুনের সূত্রপাত। তিনি তাঁর রোগীদের ওপর মরফিন ও অ্যাট্রোপিন বিভিন্নমাত্রায় প্রয়োগ করে স্নায়ুতন্ত্রের ওপর তার প্রভাব দেখা শুরু করেন। পরবর্তীকালে জানা যায় তিনি তাঁর শয্যাশায়ী রোগীদের ওপর যৌন হেনস্থা করতেও পিছপা হননি। এমনই সব অমানবিক ঘটনার পর তাঁকে কেমব্রিজ ও মাস্যাচুসেটস হাসপাতাল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। কিন্তু এরপরও বোস্টনে তিনি ১০ বছর বেসরকারিভাবে নিজের পেশাগত কার্যকলাপ চালিয়ে যান। এই সময় তিনি তাঁর বিকৃত মস্তিষ্ককে আরও শান দিতে থাকেন এবং সেই ধার ছড়িয়ে পড়ে তাঁর প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয় এমনকি শহরের উচ্চপদস্থ পরিবারেও। মরফিন ও অ্যাট্রোপিন ছাড়াও তাঁর হাতিয়ারের খাতায় যোগ হয় প্রাণঘাতী ইঁদুর মারার বিষ। তাঁর এই ভয়ঙ্কর খুনের খেলা শেষমেষ জনসমক্ষে প্রকাশ পায় ১৯০১ সালের জুলাই-অগস্ট নাগাদ, যখন তিনি একসঙ্গে খুন করেন একই পরিবারের চারজন সদস্যকে। এভাবেই, একের পর এক খুনের খড়িমাটিতে সে রাঙাতে থাকে নিজের উঠোন। ডেভিস নামক এক ব্যক্তি জেনের কাছে বাড়ি ভাড়া চাইতে এলে সেখানেই জেন তাকে খুন করে এবং ছদ্মবেশ ধারণ করে মৃতদেহ পৌঁছে দেয় ডেভিসেরই বাড়িতে। সেখানে আবার, শোকাহত ডেভিসের পরিবারটাই হয়ে ওঠে জেনের পরবর্তী লক্ষ্য।

উন্মাদে পরিণত হওয়া জেন পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহে একে একে খুন করে বসে প্রথমে ডেভিসের বড়ো মেয়ে এবং শেষে ডেভিসের ছোট মেয়ে মিনি গিবসকে। এই ঘটনার পর সন্দেহের আঁচ পেয়ে গিবসের স্বামী গোপনে তদন্ত শুরু করেন একজন বিষ-বিদ্যার গবেষকের সাহায্যে। তদন্তে অতিরিক্ত মাত্রায় মরফিনের প্রমাণ মেলে ডেভিসের দেহে এবং উপযুক্ত প্রমাণসহ গ্রেপ্তার করা জেনকে। এই ঘটনার পর জেন তাঁর নিজে হাতে করা প্রায় একত্রিশটি খুনের কথা স্বীকার করেন এবং নিজেকে আরো ১০০ টি খুনের জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী করেন। তবুও, একফোঁটা অনুশোচনা তাঁকে গ্রাস করেনি সেদিন। শেষে আশি বছর বয়সে এই উন্মাদ সেবিকার মৃত্যু ঘটে এক মানসিক অ্যাসাইলামের অন্ধকার কূপে।

এরকম আরও কয়েকটি ভয়ঙ্কর কাহিনি শোনাব, আগামী পর্বে।

More Articles