ফিরে দেখা ‘দহন’ || অন্য রকম অভিনয়েও নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন অভিষেক

১৯৯২ সালের ২৪ জুন। রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো থেকে এক অবিবাহিত দম্পতি বেরিয়ে সবে রাস্তায় নেমেছে। এমন সময় ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। চার-পাঁচটি ছেলে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এই ঘটনা সে সময় সাড়া ফেলেছিল কলকাতায়। একে কেন্দ্র করেই সুচিত্রা মিত্র লিখলেন ‘দহন’। অবশ্য নারীর শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ অত্যন্ত স্বভাবিক ঘটনা এদেশে। ঘণ্টায় বা মিনিটে তার হিসেব পর্যন্ত দেওয়া যায়। এখনও এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বৈবাহিক ধর্ষণের ধারণা বুঝতে পারেন না। নারী যে পুরুষের সম্পত্তি নয়, তা তাদের কল্পনার বাইরে। আজ থেকে বছর তিরিশেক আগে বোঝাই যায় এ নিয়ে কী ছিল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। সেই উপন্যাস থেকেই ঋতুপর্ণ ১৯৯৭-এ ‘দহন’ ছবিটি নির্মাণ করলেন। ছবিতে মূল দুটি চরিত্র–শ্রবণা সরকার ও রমিতা সেনগুপ্ত। তুলনামূলকভাবে রমিতার বর পলাশ চৌধুরীর চরিত্রটি অপ্রধান। তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। ছবির প্রথমার্ধে কাহিনির বুননে পলাশের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিষেক। এবং সত্যি অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। গত বুধবার রাতে মারা গিয়েছেন অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। আজ ‘দহন’ ছবিতে অভিষেকের কাজ ফিরে দেখা আরেকবার।

পলাশ চরিত্রটির মুখ প্রথম দেখা যায় একটি কাপড়ের দোকানের সামনে। স্কার্ট পরা ম্যানিকুইনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সে। প্রথম দৃশ্যেই তার অনবধান বশত বেরিয়ে আসা সেক্সিজম ধাক্কা দেয় দর্শকদের। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। অথচ নারীদের সত্তাহীন বস্তু হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত এই পুরুষের চোখ এক ব্যখ্যানের শুরু করে। ধীরে ধীরে রমিতা বেরিয়ে আসে। তাদের কথোপকথন শুরু হয়। জানা যায় অমন একটি স্কার্ট কিনতে চেয়েছিল রমিতা। কিন্তু কিনে দিতে নারাজ পলাশ। বাবা মা কী বলবে! এই ছিল তার যুক্তি। তার কথা থেকেই জানা যায়, একটু কনজারভেটিভ হওয়াই যায়, বরং এ নিয়ে মা বাবার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার কাজ করে পলাশের। রমিতাও মেনে নেয় কনজারভেটিভ হওয়াটা দোষের না। বৌ কিপটে বললে তার পৌরুষত্বে লাগে। সবদিক দিয়ে টিপিক্যাল বাঙালি মধ্যবিত্ত এই পুরুষটির চরিত্রাঙ্কন খুব একটা সহজ ছিল না। অভিষেকের এই অভিনয় দেখে হতচকিত হয়েছিলেন অনেকেই।

মেট্রো স্টেশনে সেই ‘এক্সকিউজ মি’ বলে রমিতার বেরিয়ে আসার থেকেই শুরু হয় টিজিং। সেখানে রমিতা ঘুরে দাঁড়ালে পলাশ উল্টে রোমিতাকেই বলে, “অযথা ইংরেজি বলতে গেলে কেন? বাংলায় বললেই পারতে।” তারপর শুরু হয়, “ডাকছিল ডাকছিল, সাড়া দিতে গেলে কেন? কী দরকার ছিল?”--ইত্যাদি। এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো মেরুদণ্ড যে পলাশের নাই, তা তখনই বোঝা যায়। উল্টে রোমিতাকে বারবার বড়লোক বাড়ির অবুঝ শিশু হিসেবে ট্রিট করতে থাকে তার প্যাট্রিয়ার্কি। নিজেকে তাতে করে একটা বেশ গুরুগম্ভীর আসনে বসানো যায়। পলাশের এই আত্মবিশ্বাসের অভাব অভিষেক এত নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রমিতার চোখের দিকে না তাকিয়ে। প্রতিটি ডায়লগ থ্রো করা হচ্ছে নিচের দিকে তাকিয়ে, বা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে। একটু একটু থেমে থেমে ব্যঙ্গের সুরে একটু ওজন চড়িয়ে। এই যে ক্ষমতাহীন কর্তৃত্বের ফাঁপা কথাবার্তা, তা অবলীলায় ফুটিয়ে তুলছেন অভিষেক। এখানেই অভিনেতা অভিষেকের অভিনয়ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে যায়। রমিতার বাপের বাড়ি অবস্থাপন্ন হওয়ার ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পুরুষকে কুরেকুরে খায়। পিতৃতন্ত্রের শিকার একা যে নারী নন, পুরুষও–এই দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন নির্দেশক। আবার ক্ষমতায় থাকা নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের সারাক্ষণ খুঁত খোঁজার একটা চেষ্টা করেই থাকে। তার উচ্চশিক্ষা, স্বাধীন মতামতকে সে যৌন হেনস্থার জন্য দায়ী করতে চায়। সুচিত্র মিত্র বলেছিলেন, উপন্যাসে তিনি শ্বশুরবাড়িকে সম্পদশালী দেখিয়েছিলেন যাতে মেয়েটির দুর্দশা আরো ফুটে ওঠে। কিন্তু সিনেমায় ব্যাপারটা উল্টে দেওয়া হয়েছিল। এটা তাঁর ভালো লাগে নি। অথচ এই সামান্য অদলবদল যেভাবে ভিক্টিম ব্লেমিং-এর একটা ছুতো হয়ে ওঠে–তা আলাদা ব্যঞ্জনা এনে দিয়েছিল ছবিতে।

তারপরে নিগ্রহের ঘটনা। যদিও অভিষেকের তেমন অভিনয়ের সুযোগ ছিল না এই দৃশ্যে। ইন্দ্রাণী ও ঋতুপর্ণার যুগলবন্দী নিগ্রহের ঘটনাটিকে বিশিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে যায়। আবার অভিষেকের অভিনয় দেখার সুযোগ পাওয়া যায় দোষীরা ধরা পড়ার পর থেকে। রোমিতাকে অন্ধকারে রাখার চেষ্টা করে পলাশ। সহকর্মীদের কাছে লজ্জায় সম্মানহানির ভয়ে যৌন নিগ্রহ বলতে পারে না, বলে— “ওই একটু ইভটিজিং”। বন্ধুবান্ধব চেপে ধরলে শেষে নিগ্রহ বলতে বাধ্য হয় সে। কিন্তু বলে, “আমারই বেশি লেগেছে আর কি, ওর তেমন লাগেনি”। পুরুষত্বের এই নিষ্ফল আস্ফালন ফুটে অভিষেকের অভিব্যক্তিতে নিঁখুত। বন্ধুদের রেপের গসিপে থমকে যাওয়া বা শ্রবণাকে সহ্য করতে না পারা–এ যাবতীয় আচরণ পলাশ খুব একটা সচেতন ভাবে করছে না। করছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। রোমিতার সঙ্গে ক্রমাগত বাজে হচ্ছে ব্যবহার। বারবার ঘুরে ফিরে আসছে নিজেদের দুর্ভোগের কারণ হিসেবে শ্রবণার প্রেসে সবকিছু খুলে বলার প্রসঙ্গ। লক্ষণীয় যারা নিগ্রহ করেছিল তাদের কথা ওঠেই না ছবিটির প্রথমার্ধে। অফিস থেকে ফিরে ধীরে নিজের অক্ষমতার আক্রোশ রমিতার উপর ফলানো শুরু হয়। অফিসের গসিপ রোমিতার নাকি ছেলেগুলির সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। অ্যাফেয়ার। নইলে মেট্রো স্টেশনে তো অনেক মেয়েই ছিল, বেছে বেছে রোমিতাকেই নিগ্রহ করল কেন? অত্যন্ত হালকা ভাবে রোমিতার মনের বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে পলাশ যেভাবে পেরেক গুলো গাঁথতে থাকে, তাতে শিউরে উঠতে হয়। ঐ চোখ। অত স্বাভাবিকভাবে নিজের সন্দেহ ভিক্টিমের উপর চাপিয়ে দেওয়া। অভিষেকের তুখোড় অভিনয়। চোখের ভিতরে চাপা রাগের ধার দর্শকদের ছিন্নভিন্ন করে। এবং এই দৃষ্টি উঠতে বসতে রমিতাকে ঘিরে থাকে। তার গায়ে আঁঠার মতো লেগে থাকে। আর কারোর সঙ্গেই কিন্তু চোখ তুলে কথা বলতে পারেনা পলাশ।

আবার সব শান্ত হলে আগের দিনের সেই ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাওয়া। ঋতুপর্ণ কোথাও চরিত্রটিকে খল করে উপস্থাপন করেননি। বরং চরিত্রটির স্বাভাবিকত্ব দর্শককে অস্বস্তি দেয়। এই নর্মটিকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন ডিরেক্টর। ক্ষমাটমা চেয়ে এবার পলাশ নিজেকে ভিক্টিম বলে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যায়। রমিতার যন্ত্রণা আবারও উহ্য থাকে। পলাশ জানায় তার বাবা-মা বলছেন, তাঁরা রমিতার কোনও স্বাধীনতায় হাত দেন না কখনও, কিন্তু থানায় ডায়রি করার আগে একবার পারমিশান নেওয়া উচিত ছিল তাঁদের। আবার দায়ী হয় রমিতা ও শ্রবণা। এবার একটু নম্র ভাবে–এই যা পার্থক্য। এই পর্যায়ে এসে মনে হতে থাকে ব্যক্তি মেয়েটির উপর হামলা হয়নি। হয়েছে পরিবারের সম্মানের উপর। এই ব্যক্তি নারীর প্রতিনিধিত্ব গাপ করে শ্বশুরবাড়ি অতি সাবলীল ভাবে। রমিতাকে বারবার বলা হয়, কেস লড়ে লাভ নেই। তার সঙ্গে চলে অনবরত স্লাটসেমিং। ঘুরিয়ে বলা তোমার জন্যই শ্লীলতাহানি হয়েছে। সবদিক থেকে নিংড়ে রমিতাকে শেষ করতে থাকে পলাশ। ঝগড়ায় ক্রমাগত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। শেষে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখে রমিতাকে ধর্ষণ করে। হ্যাঁ, স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে সঙ্গমে মিলিত হলেও তা ধর্ষণই। বিয়ে কেন, তামাম ধর্মীয় নিদান পুরুষের ধর্ষকামকে পবিত্রতা বলে চালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। এই চূড়ান্ত পতনের পরে চরিত্রটি ছবি থেকে ফেড আউট করে। দ্বিতীয়ার্ধে অভিষেকের তেমন ভূমিকা নেই। ফের একবারই দেখা যায় তাকে কোর্টের আঙিনায়। সেখানেও খবরের কাগজে মুখ ঢেকে থাকে পলাশ। একাই। 

মধ্যবিত্তের এই ভীরু, মেরুদণ্ডহীনতা অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলা খুব মামুলি ব্যাপার না। খল চরিত্রের সচেতন চড়া সুরের পিতৃতন্ত্র এক, কিন্তু অনবধান বশত ভদ্র মুখোশ ছিঁড়ে বারবার বেরিয়ে আসা নখ দাঁত অভিব্যক্তিতে ফুটিয়ে তোলা সত্যি কঠিন। অভিষেক অভিনীত চরিত্রটির মূল সুর এই পেন্ডুলামে বাঁধা। মূলধারার অভিনেতা হয়েও যে দক্ষতা এই বাস্তবধর্মী ছবিতে দেখিয়েছিলেন অভিষেক, তা সত্যিই কুর্নিশ যোগ্য। শ্রবণার চরিত্রটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু অভিষেক ছাড়া ঋতুপর্ণা অভিনীত রমিতা চরিত্রটি পূর্ণতা পায় না। জাতীয় পুরস্কারে প্রধান দুই অভিনেত্রী ভূষিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু পিতৃতন্ত্রের মূর্ত এবং স্বাভাবিক করে তোলা রূপটি অভিষেক চট্টোপাধ্যায় যে দক্ষতা ও সূক্ষ্মতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন, তাও ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার।

More Articles