পুড়বে হাত তাই আগুন থেকে বাঁচুন, এই অভিজ্ঞতাই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার গোড়ার কথা

সুসেন: নতুন কোনও শহরে গিয়েছেন, আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে? কুছ পরোয়া নেহি। পকেটের স্মার্টফোন-এ গুগল-ম্যাপ দেখিয়ে দেবে কোন বাস আর কোন ট্রেন ধরলে সব থেকে তাড়াতাড়ি গন্তব্যস্থলে পৌঁছনো যাবে। কয়েক বছরের মধ্যে হয়তো গাড়ির চালকের আর দরকার হবে না – গাড়ি নিজেই নিজেকে চালাবে! যন্ত্রের, বিশেষ করে কম্পিউটারের বোধবুদ্ধি — ইংরেজিতে যাকে বলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, তা নিয়ে নানা গবেষণার ফলাফল আমরা চারিদিকে আখছার দেখতে পাচ্ছি। জানাচ্ছেন এম.আই.টি. মিডিয়া ল্যাব-এর গবেষক সায়মিন্দু দাশগুপ্ত। 

তাঁর কথায়, কল্পবিজ্ঞান লেখকরা অনেকদিন আগে থেকেই যান্ত্রিক বোধবুদ্ধি নিয়ে গল্প লিখেছেন। যেমন, ছোটবেলায় আমরা অনেকেই প্রফেসর শঙ্কর যন্ত্রমানবদের কথা পড়েছি। এবিষয়ে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার শুরু মার্কিন বিজ্ঞানী মার্ভিন মিনস্কির (১৯২৭-২০১৬) মাধ্যমেই। একটা বৈদুতিন যন্ত্র বোধবুদ্ধির পরিচয় কিভাবে দিতে পারে, এই নিয়ে মার্ভিন চিন্তাভাবনা শুরু করেন পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে।

বুদ্ধিমান আর নির্বোধ কম্পিউটার

নিয়মমাফিক ভাবে যখন একজন বিজ্ঞানী কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের গোড়ার কাজটি শুরু করে তখন সেই প্রোগ্রামে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বলে দেওয়া হয়, কোন অবস্থায় কি করতে হবে। কম্প্যুটার-চালিত যন্ত্রমানবকে যদি বলা হয়, “বাড়ির বাগানের গাছগুলোতে জল দিয়ে দাও তো”, সে পড়বে অথই জলে। আমাকে নির্দেশগুলো পরপর সাজিয়ে দিতে হবে। খানিকটা এই ভাবেঃ

  1. বাগানের উত্তর-পশ্চিম কোনে যে কলটা আছে, সেটার সামনে যেতে হবে।
  2. কলের মুখে একটা পাইপ লাগাতে হবে।
  3. এরপর কলটা চালু কর।
  4. পাইপের অন্য মুখটা নিয়ে বাগানের সমস্থ গাছের গোড়ায় কুড়ি সেকেন্ড করে জল দাও।

এর পরেও কয়েকটি বিষয় থেকে যায়। বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত পার্থ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, কলে যদি জল না থাকে, বা পাইপ-এ যদি ফুটো থাকে, যন্ত্রমানব কোন ভাবেই বুঝে উঠতে পারবে না কি করা প্রয়োজন। কোন যন্ত্র যদি মেধাযুক্ত হয়, তাহলে তার নিজে থেকেই শেখার ক্ষমতা থাকার সম্ভাবনা আছে। ঠিক এই জায়গা থেকে মার্ভিনের যাত্রা শুরু। যন্ত্রমানবটি যদি বুদ্ধিসম্পন্ন হয়, তাহলে সে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নেবে “গাছে জল দেওয়া” মানে কি, আর দরকার মত ছোটখাটো সমস্যার (কলে জল নেই, ইত্যাদি) সমাধান কি করে হবে। যেকোনো যন্ত্রকে অভিজ্ঞতা থেকে শেখানোর মধ্যে প্রধান একটা প্রযুক্তি হল স্নায়ুজাল, বা নিউরাল নেটওয়ার্ক (neural network)। আমাদের স্নায়ুর মধ্যে কোটি-কোটি নিউরন একে অপরের সঙ্গে কাটাকুটি খেলে একটি অত্যন্ত সূক্ষ আর নানা স্তরবিন্যাসের সমন্বয়ে অন্তর্জাল তৈরি করে ফেলে। সেইরকম, স্নায়ুজালেও চেষ্টা করা হয় সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে কৃত্রিম নিউরন আর সাইন্যাপ্স-এর সমন্বয়ে একটি জাল বানানোর। অবশ্যই এই জাল-এর গঠন বদলাতে থাকে অভিজ্ঞতা (Feedback) থেকে, আর সেটাই যান্ত্রিক শিক্ষা।

বিষয়টি খুব সহজ ভাষায় বোঝালেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিযারিং বিভাগের অধ্যাপক সাংখ্যায়ন চৌধুরী। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলছেন, ধরুন আপনি আগুনে হাত দিয়েছেন, তাহলে হাত তো পুড়বেই, ওই অভিজ্ঞতা (Feedback) নিউরাল নেটওয়ার্ক সংশ্লিষ্ট সার্কিট- এর সাথে যুক্ত হল। এরপর ভবিষ্যতে যদি আগুন সামনে থাকে তাহলে অতীতের যে অভিজ্ঞতায় একটি নতুন নিয়ম তৈরি করলাম যার ভিত্তিতে একটি Knowledge যুক্ত হয়েছিল তাকে কাজে লাগিয়েই আমি ভবিষ্যতে আগুনে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকব। অর্থাৎ কোনও একটি অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া শিক্ষাকে যখন আমি ভবিষ্যতের কার্যকরী তথ্য হিসাবে যুক্ত করতে পারলাম। আর এভাবেই নিজেকে সময়োপযোগী করতে করতে আমি এগোতে পারি। আগুনে হাত দিলে যে পুড়বে শুরুতে এই শিক্ষাটুকু ছিল না। কিন্তু ওই অভিজ্ঞতা থেকে একটি সিদ্ধান্তে আসা আর ভবিষ্যতে প্রয়োজনে তাকে কাজে লাগানো এটিই হচ্ছে Artificial Intelligence বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার গোড়ার কথা।

পুড়বে হাত তাই আগুন থেকে বাঁচুন, এই অভিজ্ঞতাই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার গোড়ার কথা

চিত্রঋণ : Google

বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম স্নায়ুজাল মার্ভিন মিনস্কির সৃষ্টি। ১৯৫১ সালে, ছাত্রাবস্থায় তিনি তৈরি করেন “SNARC” (Stochastic neural analog reinforcement calculator)। তখনও কম্পিউটারের প্রচলন হয়নি, তাই মার্ভিন তাঁর স্নায়ুজাল তৈরি করেছিলেন বৈদ্যুতিন ভ্যাকুয়াম টিউব আর যান্ত্রিক ক্লাচ ব্যবহার করে। একেবারে প্রাথমিক স্তরের এই স্নায়ুজালের মধ্যে ছিল চল্লিশটা কৃত্রিম স্নায়ু (নিউরন)। প্রত্যেক স্নাুয়ুর ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিকোষ (শর্ট টার্ম মেমরি) হিসাবে মার্ভিন ব্যবহার করেছিলেন একটা ক্যাপাসিটর, গাড়ির যন্ত্রাংশ হিসাবে অনেকসময় এটি কাজে লাগে, আর দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিকোষ (লং টার্ম মেমরি) হিসাবে প্রত্যেকটি স্নায়ুর সঙ্গে জোড়া ছিল একটা পোটেনশিওমিটার, যার নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করত যান্ত্রিক ক্লাচ-টি।

যন্ত্র কিভাবে শিখবে, সেই নিয়ে ভেবেই মার্ভিন কাজ শুরু করেন এম-আই-টি-র আর এক প্রফেসর, সিমোর প্যাপার্ট-এর সঙ্গে। বিষয়টিকে সোজাসাপটা কায়দায় শুরু করতে ছোট বাচ্চারা কিভাবে শিখতে পারে, সেই গবেষণায় গুরুত্ব দেন তাঁরা। সিমোর আর মার্ভিন মিলে তৈরি করেন এক নতুন তত্ত্ব, মনের সমাজ (সোসাইটি অফ মাইন্ড)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের বোধবুদ্ধির উৎপত্তি হয় অনেক ছোট ছোট বোধবুদ্ধিহীন অংশের আদানপ্রদান থেকে।

উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, একটা কাঠের টুকরো তুলে সেটাকে অন্য আরেকটা কাঠের টুকরোর উপর রাখা হচ্ছে। শিশুরা তাদের খেলাধুলায় এরকম কাজ মাঝেমধ্যেই করে থাকে। কাজটা শুনে যতটা সহজ মনে হয়, মোটেই ততটা সহজ নয়। টুকরোটা সরাতে গেলে প্রথমে দেখা দরকার চোখের সাহায্যে। তারপর কাঠের টুকরোটাকে মুঠো করে ধরতে হবে। সেটার জন্য চাই হাত, যাতে কিনা আঙুল লাগানো। তারপর টুকরোটাকে তুলে ঠিক জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসাতে হবে। এগুলো যখন করছি, আমার আশেপাশের বিষয় সম্বন্ধেও কিছু তথ্য জানা ভালো — যেমন, টুকরোটার একদিক যদি ছুঁচোলো হয়, সেই দিকটা রাখার সময় নিচের দিকে থাকলে চলবে না। এই পুরো ব্যাপারটা কিভাবে ঘটে, সেটা বোঝার জন্য ষাটের দশকের শেষের দিকে মার্ভিন বেশ কিছু বছর ধরে একটা যান্ত্রিক হাত এবং চোখ বানানোর গবেষণায় মেতে ছিলেন। এখান থেকেই ‘মনের সমাজ’ তত্ত্বের শুরু।

জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক মিত্র বিশ্বখ্যাত ওই বিজ্ঞানীর ভাবনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বললেন, যে আমরা বোধ আর মন বলতে যা বুঝি, তার উৎপত্তি সহস্রকোটি “এজেন্ট”-দের মাধ্যমে। প্রত্যেকটা এজেন্ট শুধু একটাই কাজ করতে জানে। এই কাজগুলো এতটাই সহজ যে তার জন্য বুদ্ধি, অর্থাৎ আমরা বুদ্ধি বলতে যা বুঝি, সেটা লাগে না। আমি যদি কাঠের টুকরো সরাই, তাহলে সেই সরানোটা “দেখা”, “আঙুল পাকানো”, “হাত তোলা”, “হাত সরানো”, “ছেড়ে দেওয়া”, ইত্যাদি এজেন্টদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। পাশাপাশি নিউরাল নেটওয়ার্ককে আরও প্রাঞ্ছলভাবে বোঝাতে অধ্যাপক সাংখ্যায়ন চৌধুরী বলছেন, মানুষের মস্তিস্কে যেমন নিউরন আর সেই নিউরনকে কেন্দ্র করে যেমন অন্তর্জাল বা নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে আমরা কোনও স্মৃতি ধরে রাখতে পারি বা কোনও অভিজ্ঞতায় পাওয়া শিক্ষাকে আরও উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে পারি। ঠিক একইভাবে তার একটি ডিজিটাল সংস্করণের মধ্যে দিয়ে আমরা একটি প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারি যা আসলে যন্ত্রকে বোধবুদ্ধিযুক্ত করার কাজে সহায়তা করে।

তথ্যসূত্র - বিশেষ সহায়তা - অধ্যাপক সাংখ্যায়ন চৌধুরী- কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মার্ভিন মিনস্কি: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর পথিকৃৎ- সায়মিন্দু দাশগুপ্ত, অধ্যাপক মিত্র - জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রতিবেদকের নেওয়া

 

More Articles