ফাগুন দিনে ফিরে ফিরে আসে দুধেবোলতার ভাত আর নৈচি চালের স্মৃতি

এ গাঁয়ে দোল উৎসবে ভারী ধুম। ছেলে বুড়ো সেদিন বয়স ভুলে যায় বেমালুম। ঘরে ঘরে মেঠাই আর ঘুগনি রান্নার ঘটা কী। বেলা গড়াতেই ছেলের দল, মেয়ের দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে আবীর বিলোবে। ওদের মুখে মুখে তখন কেবল মেঠাই খাওয়ার ব্যাকুলতা। রঙ লাও পোয়া দাও বলতে বলতে ওদের গড়িয়ে পড়া হাসির লাটাই গড়াতে গড়াতে ওই ভাঙা পোলের ওপারে গিয়ে থামবে। ততক্ষণে মালপোয়া খেয়ে ওদের পেট ফুলে ঢোল। খ্যাঁদার মায় এমন দিনে মাংসের ঘুগনি করে বছর বছর। ও বাড়িতে তাই ছেলেদের জমায়েত খানিক বেশি বৈকি! ছেলেপুলেরা খাবে, ফূর্তি করবে তবে না রঙের পাব্বণ! পাড়ায় এ নিয়ে এখন থেকেই আলোচনা তুঙ্গে। সে আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে লাল ফিতে সাদা মোজা হেঁটে চলেছে ওই। মাধ্যমিকের মেয়ের কি আর এসবে মন ডোবালে চলে! কপালে দইয়ের ফোঁটা, ব্যাগে অঞ্জলির ফুল নিয়ে মেয়ে তাই গোমড়া মুখে চলেছে। এমন করে ওর ফাগুন দিন অকারণে বয়ে যাচ্ছে ধুলো উড়িয়ে। ওর বুঝি ইচ্ছে করে না এসব আলোচনায় গা ডুবিয়ে দিতে! করে তো।

জেঠি বলেছে, শোন ফুলকি, আগে পরীক্ষাটা সামলে নে। এত চঞ্চলতা কীসের রে! বেলের পানাটা খা দিকিনি! পেট ঠাণ্ডা হবে। ফুলকি তাই অনেক কষ্টে বেলের পানা গিলে, মায়ের গুরুদেবের ফটোয় গড় করে চলেছে ওই। কোথায় খানিক ঝোল ভাত খেয়ে যাবে মেয়ে, তা না। ভাত খেলে নাকি ওক ওঠে ওনার। এমন আজব কথা শুনলে জেঠির গা জ্বলে যায়। কই বাপ্টু তো এমন ঝামেলা করতো না! মেয়েটাকে আশকারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে ছোটবউ। কোথায় যে গেল সে! ওদিকে, ফুলকির মার খানিক হাত অবসর হয়েছে এতক্ষণে। বড় জামবাটিতে মিছরি ভিজিয়ে রাখতে রাখতে টের পান রোদখানা এই সকালেই ভারী চড়চড়া। এমন রোদ্দুরে কুলের আচারের বয়ম নামিয়ে দিতে দিতে মনে মনে ভেবে নেন, এবারে আর গুড় আম করবেন না। কেউ খেতে চায় না কিছু না। তার চেয়ে আম তেল বরং ভালো। মুড়ি দে মেখে দিলে পর খাওয়া হয় বেশ। এ বাড়ির নিয়মের চোটে মাঝে মধ্যে চোখে অন্ধকার দেখেন ফুলকির মা। কেউ খাক না খাক অক্ষয় তৃতীয়ায় কাসুন্দী করা চাই। শাশুড়িকে শিখিয়েছিলেন দিদিশাশুড়ি, সে আবার গানের তালে তালে হামানদিস্তে ফেলার মকশো কত! ওসব শেখার ইচ্ছেও নেই বাপু। এত শিখে হবেটা কি শুনি! ভাতের পাতে লালশাক দে কাসুন্দি খাবার লোক কই! ফুলকির বাবার, ফুলকির জেঠুর লোকাল ট্রেন ধরার তাড়া কত! ওই ডাল আর ভাজাই জোটে ওদের কপালে। সাত সকালে শাকপাতা কুটে বেছে রান্না করা কি পোষায়! বড় জা তবু একেকদিন ডালের পাতে পাটপাতার বড়া ভেজে দেন, কাঁচা পোস্ত বেটে দেন। তা বাপু পোস্তর দাম শুনলে বুকে ছ্যাঁকা লাগে। মাসকাবারি বাজার তুলতে গেলে এসব টের পাওয়া যায়। তবু, এমন জ্বালা পোড়ার চৈতে খানিক পোস্ত না হলে কি চলে? ঝোল ঝোল করে আলু পোস্ত করে ফুলকির জেঠি।

কলাই ডাল আর পোস্ত দে সপাসপ ভাত খেতে খেতে ফুলকির বাবা মুখ না তুলেই বলে, কি গো আজ টক করোনি বড় বৌদি? রোজ কি আর টক হয়! ফুলকির জেঠি তাই উত্তর দেয় না, দইয়ের পাত্তরখানা নামিয়ে দেয়। বলে চিনি নেবে না আকের গুড়? দানা দানা বালি বালি গুড় পেলে নিয়ে এসো তো। এবারে যে গুড় এনেছো সে গুড় ভালো না। ভেলি গুড় পাইল করেছে বোধহয়। ভাতের পাতে এমন করে বাজারের ফর্দ আর দোকানদারের কারসাজি একটা আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে একেকদিন। সে আলোচনায় ফুলকির ঠাম্মা বড় বেশি ঢুকতে চান না। ছেলেদের আপিসের ভাত নামলে পর তিনি একেকদিন ফুল-পঞ্জিকাখানি খুলে দেখতে বসেন। আসছে পূর্ণিমার দিনক্ষণ, একাদশী কটায় লাগছে এসব নিয়েই ওর মাথা ব্যাথা। ছেলেরা মনে করে কাওনের চাল এনেছে কিনা সেসব চোদ্দবার করে জিগেস করেও ওনার পেত্যয় হয় না। ফুলকির জেঠি কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কত আর উত্তর করতে পারে মানুষ!

কথা ঘোরানোর জন্য বলে, আপনার ভাত দিই মা? বেলা হয়ে যাচ্ছে তো! ঘড়ি ধরে সাড়ে এগারোটায় ভাত খান ফুলকির ঠাম্মা। আলো চালের ভাতই ব্যবস্থা করেছে ছেলেরা। মাছ না, ডিম না অন্তত একটু ভালো চালই খাক না হয়। এই ব্যবস্থায় ছেলেদের মা খুব যে খুশি তা বলা যায় না। ছেলের বউরা অবশ্যি বলে না তা নয়। একেকদিন বলেই ফেলে, আপনি তো মাছ ভালোইবাসতেন, খান না একটু। ইচ্ছে হয়তো করেও কিন্তু মুখে কিছু বলেন না। বরং একেকদিন বলেন, জলঢালা ভাত খেতে বড় ইচ্ছা যায়। আলো চালে কি জলঢালা ভাত সোয়াদ লাগে! কবিরাজ শালের ভাত পান্তা করে খাই না কত কাল! ছাতু দে, ছাঁচি প্যাঁজ দে, মট মট করে মরিচ ডলে। এমন ফাল্গুন চৈতের দিনে জলঢালা ভাতে কলজে জুড়িয়ে যায় রে বউ। ফুলকির জেঠি এসব কথা শুনে শুনে ক্লান্ত। বলে, আজ না হয় সেদ্ধ চালই খান মা। জল ঢেলে দিচ্ছি।

এতে বুড়ি খানিক খুশি হয় বোধহয়। তবু, প্যাঁজ ছাড়া কি আর ছাতু মাখা ভালো লাগে! প্যাঁজ আবার গুরুদেবের বারণ। এসব বারণের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতে ইচ্ছে করে ওঁর। তবু, মুখে খানিক বিরক্তি গোপনের চেষ্টা করেন। বলেন, কী চাল গো বড় বউ? বড় বউ বলে, বললাম তো আপনাকে সেদ্ধ চাল দিচ্ছি। বুড়ি তো এমন উত্তর চায় না। বলে, চালের নাম নাই? অত শত জানি না বাপু। নিজের নামটুকু মনে আছে এই ঢের। এমন জবাবের পরে বুড়ো মানুষের আর কথা কইতে ইচ্ছে করে না। পোয়াতি বেলায় মা রেঁধে দিতেন দুধেবোলতার ভাত, নৈচি চালের ভাত সেসব মনে পড়ে বুঝি ওঁর। বড় বড় মাটির জালায় বচ্ছরকার চাল ভাগে ভাগে রাখা থাকতো ভাঁড়ার ঘরে। সেসব মনে পড়ে যায় আরকি। মানুষে মানুষে যেমন ভেন্নতা, চালে চালেও তেমনি। মানুষের নাম নিয়ে তোদের এত আদিখ্যেতা, চাউলের নাম জানার ইচ্ছেটুকু নাই তোদের! ভাবতে ভাবতে ফটাস করে মরিচ ভাঙেন, নুন দে লেবু দে কচলে কচলে ভাতও মাখেন। শুনতে ভারী বিচ্ছিরি, তবু, বুড়ি এবারে আওয়াজ করে আমানি খাবে চুমুক দে। খায়, এমন করেই খায়, ফুলকির ঠাম্মা। খেতে খেতে নিজের মনেই গজর গজর করেন বোধহয়। সোয়াদ লাগে না, সোয়াদ লাগে না। এসব স্বগোতক্তি আর কেউ শুনতে পায় না ভাগ্যিস।

More Articles