চাপড় ঘণ্ট থেকে মোচার ডালনা, পটলের দোলমা থেকে ওলের আচার, কুসমি শিখছে...

পথের দু'পাশ বরাবর ঘেঁটু ফুলের জঙ্গল। জঙ্গলই বটে। এমন করে বেড়ে উঠেছে যে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। গাছ ভরে কুঁড়ি এসেছে, ওদের বনজ গন্ধে মাতাল করে দেবার দেরী নেই বেশি। এমন ফাগুন দিনে মানুষ কী করে? করে তো কত কিছুই, সেসবের কী আর হিসেব আছে! যাদের রান্নাঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে বুনজ কুসুমগন্ধে মাতাল হওয়ার ফুরসৎ নেই তারা তখন বসে বসে এক মনে উনোনের উত্তাপ পোহায়। দেশ ঘরে কি আর ঘেঁটু ফুল নিয়ে উতলা হওয়া মানায়! মানুষ তো এমন গাছগাছালির মধ্যেই বেড়ে উঠছে, বুড়ো হচ্ছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফাগুনের দিন তাই ওর আলো ওর হাওয়া ওর রেণু ঝরানো দুপুর নিয়ে জানলার বাইরে, মজা পুকুরের পাড়ে পাক খেয়ে বেড়ায়। ঘরের মানুষকে সে পথে বের করতে চাইলেই আর পারছে কই বলো! তার যে সিছটির কাজ পড়ে আছে সে খবর রাখো, দখিন হাওয়া? সে কাজের কথা আর কী বলি তোমায়!

এই তো আমাদের কুসমি এখন বসে বসে পাকা কামরাঙা কাটছে, তারার মতো ওর চাক চাক কামরাঙা কালো লবন দে জাড়িয়ে রাখতে রাখতে ওর স্বদ কোরক ভিজে উঠছে নিজের খেয়ালেই। এসব হলে প্পর ও একবার বেরিয়ে পড়তে চাইবে বই কী! আর ঠিক তক্ষুণি মায়ের গলা শুনতে পাবে কুসমি। কুসমি বেগুন কটা কেটে গিয়ে যা মা। কী আর করে আমাদের বাসন্তী কন্যে! কন্যে তখন বসে বসে নিম বেগুনের জোগাড় এগিয়ে দেয় মায়ের হাতের গোড়ায়। মা’র কি ইচ্ছে করে না, ওই বেগুনি কাঞ্চনের তলে বসে আকাশ দেখতে! তা নইলে কেমন করে মা গড়গড়িয়ে বলেই চলে চলে… জানিস কুসমি, নিমবেগুন খেতে হয় এমন সময়ে। আর কদিন পর যুক্তিফুল উঠলে তোকে সুক্তো রেঁধে খাওয়াবো। ধুর, যুক্তিফুলের সুক্তো খেতে বয়েই গেছে কুসমির। অমন থোকা থোকা ফুল দেখলেই কুসমির ইচ্ছে করে বেণীতে অমন ফুল জড়িয়ে ওলটকম্বল গাছের তলে বসে গপ্পো করতে। তবে, কুসমি বেশ টের পাচ্ছে, মা এত সহজে এখন ছাড়বে না। মা এখন বকবক করে মাথা খাবে, হাজারটা আলতুফালতু কথা বলবে। সেসব কথায় ঘুরে ফিরে রান্না আর হেঁশেল পেরিয়ে সাত পাঁক ঘুরে আবার এই রান্নাঘরেই এসে ফুরোবে।

মায়ের ভারী অদ্ভুত ধারণা, এসব না শিখলে নাকি নিন্দে করবে লোকে। ওসব কথায় কান দিতে বয়ে গেছে কুসমির। আসুক তো কেউ, কুসমির মতো করে কুল ছেঁচে দেখাক তো! পারবে কেউ অমন আলগা হাতে নুন লঙ্কা দে তেঁতুল ছড়া জাড়িয়ে নিতে? কুসমি বলে, জানি তো মা, মাছের ঝাল আর কাঁচা তেঁতুলের অম্বল তো শিখেছি! সেদিন তুমি ছিলে না, বাবাকে আমি কুর্তি কলাই বেটে দিইনি বুঝি! এসব শুনলে কুসমি ঠিক জানেন, মা হেসে সারা হবে। মায়ের ইচ্ছে, যত উদ্ভট রান্না শিখে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিক কুসমি। চাপড় ঘণ্ট থেকে মোচার ডালনা, পটলের দোলমা থেকে ওলের আচার যতকিছু মায়ের পছন্দ সেসব শেখানোর কী যে ব্যাকুলতা! সত্যি কুসমি এসব বুঝতে পারে না। রুটি নাকি গোল হতেই হবে। আরেবাবা একটু ব্যাঁকা হলেই বা অসুবিধা কী! সেই তো ছিড়েই খাবে। কুসমির বেলা রুটি মা তাই বাবাকে দিতে চায় না। অথচ বাবা হয়তো খুশিই হতো, কে জানে! মায়ের মনের ভেতরটায় ঢুকে একবার চোরা কুঠুরির দরজা গুলো খুলে দিতে ইচ্ছে করে কুসমির। রান্না তো পারেই কুসমি, তাই বলে সব কি শিখতেই হবে? এই এক্ষুনি!

লালটুর মা কি এমন করে সারাদিন! কুসমি তাই মুখ ভার করে সজনে ফুল বাছে। আলু কড়াইশুঁটি দে সজনে ফুলের চচ্চড়ি রাঁধবে মা, মাখো মাখো করে কালিবাউসের রসা রাঁধবে এরপর। তাতেও মায়ের মন ভরবে না, মা তখন বলবে, যা তো কুসমি, শিম কখান তুলে আন। শিম তোলা হলে ধনেপাতা বাটা দে শিম হবে। রাঁধতে রাঁধতে মায়ের বকবক চলবেই, চলবে। বলবে, তোর বাবা একপদে খেতে পারে না রে।

কুসমি জানে, বাবা মোটেও এমন না। মায়ের ভিতরে আস্ত একখানা নারীজম্ম থমকে আছে। সেই জন্মে কেবল নিপুণ গোল রুটি বেলতে হয়, চন্দনের মতো মোলাম করে বাটনা বাটতে হয়, বড়ি দিতে হয় হাতের টানে বড়িদের নাক তুলে তুলে। রুটি খানিক গোল না হলে কীই বা যায় আসে! সবাই কি আর চন্দনের মতো জিরে বাটতে পারে? লালটু, পলটু কেউ কি পারে? পারে না। এসব কথা মাকে বলা শক্ত। কুসমি জানে, লালটু পলটুর চন্দনের মতো জিরে বাটা না শিখলেও ক্ষতি নেই। এমন করে আসলে ওর মা ভাবে। ভাবতে ভালোও বাসে নিশ্চয়ই। কুসমি কিন্তু এমন করে ভাববে না। কুসমি এমন ফাগুনের ভোরে শিরশিরানি না কাটতেই দোলাই গায়ে ওই দূরে সর্ষের মাঠের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আহিরিকলাইয়ের বেড়ার পাশটিতে বসে টিয়াপাখি দেখতে যায় একেকদিন। ঝাঁকে ঝাকে সবুজ টিয়ারা কেমন একমনে শুঁটি খায়, সেসব দেখতে ওর ভারী মজা লাগে। খানিক খানিক খাওয়া হলে, ওরা কেমন আশমানি রঙে ধানি সবুজ ডানা ডুবিয়ে উড়ে যায় ওই দূরে! কুসমিরও ইচ্ছে করে অমন করে উড়ে যেতে। সেসব তো আর হবার নয়, কুসমি তাই খানিক পলাশ ফুল কুড়োয়, দু’একটা পিচিকিরি ফুলের কুঁড়ি পেলে সযত্নে তুলে নেয়।

ইস্ লালটু আর পলটুর মতো ওর জামায় যদি পকেট থাকত। রুটি বেলা মেয়েদের বুঝি পকেটের প্রয়োজন নেই! যারা জামা বানায় তারা যেন কেমন! তারা কি মায়ের মতো করে ভাবে? এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে এসে পরে কুসমি। আজ সকাল সকাল গরম মুড়ি ভাজছে মা। গরম মুড়ি দে পাটালি গুড় খেতে ভারী মজা। মায়ের হাতে কুচিকাঠি কেমন ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে। কুসমিও একদিন শিখবে এসব। নিশ্চয়ই শিখবে। গরম মুড়ি খেতে কে না ভালোবাসে বলো! কেবল অন্যকে খাওয়াতে হবে বলেই কি মানুষ থোড় ছেঁচকি রাঁধতে শেখে? নিজের জন্য শিখতে নেই বুঝি!

More Articles