বাংলা ও বাঙালিকে কখনই ভুলতে পারেনি বাপ্পি লাহিড়ি

‘আমি ভারতীয় কিন্তু আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন বাঙালি। আমি গর্বিত বাঙালি হিসেবে '- আগাগোড়া এমনটাই বলে এসেছেন ডিস্কো কিং বাপ্পি লাহিড়ী। কলকাতার কানাগলি থেকে এক বাঙালি ছেলের বলিউড জয়ের কাহিনি খানিকটা স্বপ্নের মতোই রঙিন। তাঁর সুরের জাদুতে মিঠুন চক্রবর্তী থেকে মাইকেল জ্যাকসন নেচে উঠেছেন সকলকেই। কিন্তু হৃদয়ের বাঙালিয়ানা কমেনি এক রত্তিও। বরং সকলকে দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছেন, আমি তো কলকাতারই ছেলে।

বাবা অলকেশ লাহিড়ী এবং মা বাঁশরী লাহিড়ী দুজনেই গানের জগতের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। তাই তাঁদের একমাত্র সন্তান বাপ্পির সুরের জ্ঞান ছিল রক্তেই।তবে বাংলায় নয় তাঁর বরাবর ইচ্ছা ছিল হিন্দী ছবির গানের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার। তাই মাত্র ১৯ বছর বয়সেই পাড়ি জমিয়েছিলেন মুম্বইয়ে। সঙ্গীতের জগতে রীতিমত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বাপ্পি দা। তবে ভোলেননি বাংলাকে, বার বার ফিরে এসেছেন আর ঝুলি ভরিয়ে দিয়েছেন বাংলা সিনেমার। হিন্দী ছবিতে কাজ শুরুর ঠিক এক বছর আগে বাংলা সিনেমা 'দাদু' দিয়ে সঙ্গীত পরিচালনায় হাতেখড়ি। এরপর শুধু একের পর হিট গান দিয়ে ঝুলি ভরিয়ে দিয়েছেন বাংলা সিনেমার। উত্তম কুমার অভিনীত ' ওগো বধূ সুন্দরী' ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন বাপ্পি দা। প্রসেনজিতের 'অমর সঙ্গী' ছবিতে আশা ভোঁসলে ও কিশোর কুমারের গলায় 'চিরদিনই তুমি যে আমার' গানটি আজও ভোলেনি বাঙালি। ১৯৮৭ সালে সুর বেঁধেছিলেন তাপস পাল অভিনীত 'গুরুদক্ষিণা' সিনেমার জন্য। ছবির প্রতিটি গান বোধহয় বাঙালি আজও অনায়াসেই গেয়ে উঠবে। ' উরি উরি বাবা', ' কলকাতার রসগোল্লা', ' একটু তো নেশা করেছি ', ' গা ছমছম কী হয় কী হয়', ' যাদু যাদু ' সব সুপারহিট গান দিয়েছেন বাঙালি এই রকস্টার।

বাংলার টানে বারে বারে ফিরে আসার পাশাপাশি তাঁর ভিতরের বাঙালি সত্বাকে প্রত্যহ যাপন করেছেন বাপ্পি দা। বাঙালি যেভাবে ভাঙা হিন্দি বলে অর্থাৎ বাংলার সাথে হিন্দি মিশিয়ে কথা বলেন তাঁর পেটেন্ট দেওয়া যেতেই পারে বাপ্পি লাহিড়িকে। দীর্ঘকাল মুম্বইতে থাকলেও মাতৃভাষায় টান স্পষ্টভাবেই রয়ে গেছে তাঁর কথায়। এ প্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,' হ্যাঁ অবশ্যই আমার হিন্দি কথার সাথে বাংলা মিশে আছে বা বাংলার টান রয়েছে। আপনি দক্ষিণের সঙ্গীত শিল্পী বা মানুষদের সাথে কথা বলে দেখবেন তাঁদের কথাতেও তো দক্ষিণ ভারতীর টান থাকে।আমি বাঙালি বাংলার টান তো থাকবেই।অনেকই এ নিয়ে আমাকে বলেছেন। আমি তাঁদের এই উত্তরই দিয়েছি'।

কথায় আছে ভোজনরসিক বাঙালির কাছে সাদা ভাত আর মাছের ঝোল হল আবেগ। বাপ্পি দা-ও তাঁর ব্যতিক্রম নন। তাঁর প্রিয় খাবার ছিল মাছ ভাত।তবে সামুদ্রিক মাছের তুলনায় নদীর মাছ খেতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। শোনা যায়, তিনি কলকাতায় এলেই ইলিশ, রুই এবং ভেটকি মাছ নিয়ে যেতেন মুম্বইয়ে। চিতল মাছ খেতেও খুব ভালোবাসতেন। শিলিগুড়িতে মাসির বাড়ি এলে তাঁর পাত সাজানো থাকতো হরেক রকম মাছে। কোনো অলিভ ওয়েল নয় সর্ষের তেলে মাছ ভাজা ছাড়া তিনি তা মুখেও তুলতেন না। পাঁঠার মাংস খেতেও খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য একসময় ছাড়তে হয়েছিল সে খাবার।

তবে সপ্তাহে একদিন নিরামিষ খেতেন তিনি। লুচি- বেগুনভাজাও ছিল তাঁর প্রিয় খাদ্যের তালিকায়। আলু পোস্তও বাদ পড়েনি সেই তালিকা থেকে। এ প্রসঙ্গে বাবুল সুপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের কাছে আফ্রিকার একটি ঘটনার কথা অবতারণা করেছেন। ১৯৯৫ সালে আফ্রিকায় অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এক বাঙালি দম্পতিকে ধরে আলু পোস্ত আনিয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ি।এই হচ্ছে বাঙালি!

সারাদিন যেমনই খাবার খান রাতে বাঙালি খাবারই চাই তাঁর। তবে পনির খেতে একেবারেই পছন্দ করতেন না বদলে খেতেন ছানা। আলু, পটল ও লাউয়ের তরকারি খেতেও বেশ পছন্দ করতেন গোল্ড ম্যান।  রাবড়ি, সন্দেশ ও রসগোল্লা ছিল বাপ্পিদার পছন্দের মিষ্টি। ফুচকা, ঝালমুড়ি, তেলেভাজার স্বাদও টানত তাঁকে।

ঘাড় অবধি চুল, গলায় সোনার চেন, চোখে কালো সানগ্লাস- বাঙালি রকস্টারের হৃদয় কখনই ভুলতে পারেনি তাঁর শিকড়কে। তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত দেখে বাঙালির চোখে জল নেমে আসে অজান্তেই।

More Articles