এগারো বছর বয়সে প্রথম গানের সুর, অভিনয়ও করেছেন বাপ্পি লাহিড়ি

ফার্দিনান্দ দে লেসপস মেজর উইলিয়াম টলি। নামটা অচেনা লাগছে? তা অচেনা লাগারই কথা। ইনি জব চার্নকের মত হোমরাচোমরা কেউ নন। আবার নেহাত অবজ্ঞা করার মতোও কেউ নন। সালটা ১৭৭৫ কিংবা ৭৬, মেজর টলি একটা প্রায় অবাক করা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন খাস কলকাতায়। আসাম এবং পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে শুরু করলেন একটি নালা খননের কাজ। নালাটি ছিল প্রায় সতেরো মাইল দীর্ঘ। এই মেজর উইলিয়াম টলির নামেই নামকরণ হয় টালিগঞ্জের।

গানের শহর কলকাতা। কফিহাউসের সেই আড্ডাটা না থাকতে পারে, কিন্তু কিশোর হেমন্ত অথবা মান্না দে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এই নামগুলো শ্রোতাদের মনের মনিকোঠায় অমলিন হয়ে থাকবে আজীবন। এমনই আর একটি নাম বাপ্পি লাহিড়f, তিনি ডিস্কো কিং। ক্লাসিক্যাল বা সেই অর্থে মেইনস্ট্রিম সঙ্গীতচর্চা থেকে সচেতন দূরত্ব বজায় রেখেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন লিজেন্ড। আশির দশকে বাপ্পি লাহিড়ির উত্থান প্রায় ধূমকেতুর মতোই। এই সময়েই একের পর এক হিট গান তিনি উপহার দিয়েছেন দর্শকমণ্ডলীকে - ' ডিস্কো ড্যান্সার' থেকে ' পেয়ার কভি কাম নেহি কারনা' অথবা হালের ' এল লাগ গ্যায়ে' থেকে ' তুনে মারি এন্ট্রি ', তালিকা ক্রমশ লম্বা হতে থাকবে অথচ গুনে শেষ করা যাবে না বাপ্পির সৃষ্ট মাইলস্টোন।

টালিগঞ্জের নাম কেন এই প্রতিবেদনে? তার সঙ্গে বাপ্পির সম্পর্কই বা কি? না, সম্পর্ক নেই ভাবলে পাঠকগণ ভুল ভাববেন। আজকের বাপ্পির পথচলা শুরু টালিগঞ্জের সেই কানাগলি থেকে। কলকাতা থেকে মুম্বাই - স্বপ্নের এই দৌড়ের স্টার্ট আপ তো হয়েছিল টালিগঞ্জের সেই নাম-না-জানা গলিতেই। জীবনের এতগুলো বসন্ত  পেরিয়ে এসেও বাপ্পি কি ভুলতে পেরেছিলেন স্কুলের সেই দিনটার কথা? না বোধহয়, ভুলবেন কি করে? সেই তো তার স্বপ্ন দেখার শুরু। টালিগঞ্জের সেই স্কুল আর তার হেড মাস্টারমশাই সেদিন যদি না থাকতেন তাহলে বোধহয় অলোকেশ লাহিড়ী নামের সেদিনের ছোট্ট ছেলেটার কোনদিনই আজকের বাপ্পি লাহিড়ী হওয়া হয়ে উঠতো না। ক্লাসে বাপ্পি ছিলেন একপ্রকার লাস্ট বয়। পড়াশোনার তুলনায় গান-বাজনায় বেশি মনোযোগ তার। অমনোযোগী ছাত্রকে চিনতে ভুল হয়নি অভিজ্ঞ মাস্টারমশাইয়ের। ফলশ্রুতি - গার্জেন কল। তবে তা অলোকেশের বিরুদ্ধে অভিযোগের জন্য নয়। সেদিন বাঙুর স্কুলের হেড মাস্টারমশাই বাপ্পি লাহিড়ির বাবা অমরেশ লাহিড়িকে বলেছিলেন ছেলের গান বাজনার প্রতি আগ্রহের কথা। আসলে ক্লাসে ছাত্রদের ভিড়ের মাঝেও মাস্টারমশাইয়ের জহুরীর চোখ চিনে নিয়েছিল পরবর্তী সময়ের 'ডিস্কো কিং'- কে। সেদিনের এই ঘটনার জন্য নিশ্চয় পরবর্তী জীবনে অলোকেশ কৃতজ্ঞ ছিলেন তার মাস্টারমশায়ের কাছে।

টালিগঞ্জের সেই আপাত অখ্যাত স্কুল থেকে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। এ যেন এক স্বপ্নের উড়ান। অবশ্যই সোজা ছিল না পথটা। কিন্তু তিনিও যে বাপ্পি লাহিড়ী, স্বয়ং কিশোর কুমারের ভাগ্নে। শিল্প! সে তো তার রক্তে। তবে বাপ্পি যে শুধু ক্যামেরার পিছনেই থেকেছেন এমন নয়, অভিনয়ও করেছেন তিনি।১৯৭৪ সাল, মামা ভাগ্নের যুগলবন্দির সাক্ষী থেকেছিল দর্শক। তাও ক্যামেরার সামনে। 'বড়তি কা নাম দাড়ি' ছবিতে কিশোর কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেন বাপ্পি। ছবিটির পরিচালকও ছিলেন স্বয়ং কিশোর কুমার। প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই শুরু হয় বাপ্পি লাহিড়ীর স্বর্ণযুগ। রোল - ক্যামেরা - অ্যাকশন বলার সঙ্গে সঙ্গেই কি ক্যামেরার সামনেও একইরকম ভাবে সহজ হয়ে উঠতেন বাপ্পি? যেমন হয়ে উঠতেন গানের ক্ষেত্রে!উত্তর অমিল, তবে অভিনয় নয়, গানই ছিল বাপ্পির কমফোর্ট জোন।এ নিয়ে বিতর্কেরও অবকাশ নেই।

১৯৭৩ সালে ' নানহা শিকারি' নামক চলচ্চিত্রের জন্য প্রথম গান রচনা করলেন তিনি, সেইসঙ্গে এই বঙ্গতনয় বুঝিয়ে দিলেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া।অবশ্য বলিউডের আগেই টলিউড প্রথম ব্রেক থ্রু দিয়েছিল বাপ্পি লাহিড়ীকে। ১৯৭২ সালে ' দাদু ' ছবির কিছু গানে সুরারোপ করেন তিনি। কিন্তু কল্লোলিনীর প্রেমে বেশিদিন হাবুডুবু খাননি বাপ্পি। পিছুটান ভুলে পাড়ি জমিয়েছিলেন মুম্বই। ওই যে বললাম তিনি ছিলেন লম্বা রেসের ঘোড়া। বলিউড কিন্তু হতাশ করেনি এই বঙ্গতনয়কে, তিনি যে ঐশ্বরিক প্রতিভার অধিকারী। এগারো বছর বয়স থেকেই সুর দিতে পারতেন গানে, তবলার সহজ পাঠ গ্রহণ করেছিলেন মাত্র তিন বছর বয়সে।

বলিউডের দর্শকরাও বাপ্পির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন আর এক বাঙালির হাত ধরেই - শমু মুখোপাধ্যায় ছিলেন ' নানহা শিকারি ' ছবির পরিচালক। তার হাত ধরেই বাপ্পি প্রথম পা রাখেন বলিউডের রংমহলে... বাকিটা ইতিহাস। এখানেই শেষ হয়নি বাপ্পির যুদ্ধজয়। ১৯৮৬ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ওঠে তার নাম।৩৩ টি ছবির জন্য ১৮০ টি গান রেকর্ড করে।

টালিগঞ্জের সেই ঠিকানা না মেলা গলিটাও আজ শোকাহত। বাঙ্গুর স্কুলের লাস্ট বেঞ্চটাও আজ একা হয়ে পরলো। শোকাহত গোটা বাংলা, তথা গোটা ভারত। লতা, সন্ধ্যার পর বাপ্পি। যেন গানের জগতে এ এক কালবেলা। শুধু যখন কোন বোহেমিয়ান যুবক টালিগঞ্জের ওই গলিটা ধরে উদাত্ত কণ্ঠে গাইতে গাইতে যাবে ' পেয়ার কভি কম নেহি করনা ' তখন রাতের তন্দ্রা ছুটে গিয়ে পুনর্বার জেগে উঠবে কারও অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকা স্কুলবাড়িটা।

More Articles