বেজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিক, যে ভাবে পরিবেশ ধ্বংসের নজির গড়ছে চিন...

আপনি কি আইস হকি, স্কি, স্কেটিং- এই ধরনের ক্রীড়ার ভক্ত? তার মানে নিশ্চয়ই আপনি এই মুহূর্তে বেজিং শীতকালীন অলিম্পিক দেখছেন? আপনি কি জানেন এই শীতকালীন অলিম্পিকে যে বরফের ট্র্যাক দেখছেন এগুলি সব কৃত্রিম বরফ? হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে আপনাকে স্বাগতম। আপনাকে স্বাগত জানাই ২০২২ সালে, যখন বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্কবার্তা দিচ্ছেন, তখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ পরিবেশ ধ্বংস করে হাজার হাজার কোটি টাকার অলিম্পিক আয়োজন করছে।

চলুন যাই বেজিংয়ে। শীতকালীন অলিম্পিকে যাওয়ার আগে কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়া একটু প্রয়োজন। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই, বলা যায় ২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক চলাকালীনই চিনের কমিউনিস্ট সরকারের মুখ পুড়েছিল শহরের চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর বাতাসের জন্যে। দিনের পর দিন কুয়াশায় ঢাকা ছিল বেজিংয়ের বাতাস। ২০১৩ সালে দূষণের মাত্রা ওঠে চরমে এবং সেই বছরেই ২০২২ শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজন করার জন্যে বিড দেয় চিন। আন্তর্জাতিক মহল নিশ্চিত ছিল চিন দূষণ এবং যে অঞ্চলে চিন অলিম্পিক করতে চায় তার প্রাকৃতিক বরফের চাদরের অভাবের কারণে এই মহাক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনের দায়িত্ব পাবে না। কিন্তু ২০১৫ সালে কাজাকিস্তানের আলমাটি শহরকে হারিয়ে গোটা দুনিয়াকে চমকে দেয় চিন। বেজিং অলিম্পিকের ইতিহাসে প্রথম শহর হিসেবে গ্রীষ্ম ও শীত, দুই ধরনের অলিম্পিকই আয়োজন করার শিরোপা পায়।

তখন থেকেই পরিবেশবিদরা প্রমাদ গুণছিলেন। প্রথম চিন্তার কারণ ছিল বায়ুদূষণ, দ্বিতীয় হল কৃত্রিম বরফের পরিকল্পনা। ২০১৫-তেই তারা আশঙ্কা করেছিলেন এর ফলে ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলের ভাণ্ডার চূড়ান্ত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আরো চিন্তা ছিল কারণ ওই অঞ্চল শুষ্ক এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন সেই বিপদ আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বেজিং এর চারপাশে পাহাড় আছে বটে, কিন্তু শুষ্কতার কারণে বরফ জমে না। চিন্তার কারণটা একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। আপনার বাড়ির এসি মাসে ৩০ দিন চললে কী পরিমান বিদ্যুৎ খরচ হয় ভাবুন? এবার ভাবুন, বিশাল বিশাল কোর্স, পাহাড়ের পর পাহাড় কৃত্রিম বরফ দিয়ে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা! কত জল, কত শক্তি, কত অর্থের প্রয়োজন।

৩৫০ টি বরফ তৈরি করার যন্ত্র, ১০ লিটার বরফ প্রতি সেকেন্ডে তৈরি করে বরফের চাদরে ঢেকেছে ইয়াংঙ্গিং, সেন্ট্রাল বেজিং এবং হেবেই প্রদেশের ঝাংজিয়াকৌ এর পাহাড়কে। খরা কবলিত এই অঞ্চলকে বরফের চাদরে ঢাকতে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৯ মিলিয়ন গ্যালন জল, যা প্রায় ৭৪ টি অলিম্পিক সাইজ সুইমিং পুলের সমান।

পরিবেশের কী পরিমাণ ক্ষতি, তা একটা বাচ্চাও আজ বুঝবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রথমত এই কৃত্রিম বরফ মাটির জন্যে মোটেই ভাল নয়, দ্বিতীয়ত এই বিশাল পরিমাণ জল প্রাকৃতিক ভাণ্ডার থেকে নেওয়ার ফলে এই অঞ্চল আরো ক্ষয় ও ধস প্রবণ হয়ে পড়বে। আরো শোনা যাচ্ছে, যে সংরক্ষিত অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে গাছ কাটা হয়েছে এমনকী ম্যাপেও বদল করেছে সরকার, এই অভিযোগও উঠে এসেছে।

এবার আসি বায়ুদূষণের কথায়। ২০১৫-তে আয়োজন করার দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই নড়েচরে বসে সি জিংপিং এর সরকার। রিপোর্ট বলছে, খেলা শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই চূড়ান্ত কড়াকড়ি করেছে তারা। বন্ধ হয়েছে অনেক কারখানা, নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে যানবাহনও। তাতে নীল আকাশ দেখেছেন বটে বেজিং এর বাসিন্দারা। দূষণ কমেছে অনেকটাই, কিন্তু যা কমেছে তাও কি যথেষ্ট? AQI ঘোরা ফেরা করছে ৩০-৫০ এর ভিতর, কখনো কখনো তারও ওপরে। হ্যাঁ, আগে যা থাকত ১০০-র ওপরে, সেই তুলনায় অনেক উন্নত। কিন্তু অ্যাথলিটদের শরীরের জন্যে এই পরিমাণ পি এম ২.৫ ও পি এম ১০ ভালো? যে দেশে বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ মারা যান, সেখানে অ্যাথলিটদের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তার কারণ থেকেই যাচ্ছে।

চিনের প্রেসিডেন্ট সি জিংপিং এই প্রতিযোগিতার আয়োজনে যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে তার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন। প্রশ্ন উঠেই আসে, এত গুরুত্বপূর্ণ কেন এই বিষয়টা? এক ধাপ এগিয়ে বিজ্ঞানীরা এই অলিম্পিক গেমসেরই যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিন সপ্তাহের এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জন্যে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ, সম্পদ, শক্তি খরচ হয় এবং গেমস শেষ হওয়ার পর অলিম্পিক ভিলেজগুলির পরিণতি, পরিবেশের চূড়ান্ত ক্ষতি, সবটাই খুব বিতর্কিত। সব সরকারই দাবি করে, তারা পর্যটনে আয় করে, খেলা শেষ হওয়ার পর স্টেডিয়াম এবং ভিলেজগুলি বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করে, কিন্তু এই দাবিগুলি কোনো দিনই বাস্তবে রূপান্তরিত হয় না। তাই চিনও এই পরিকাঠামোকে যে উপায়ে কাজে লাগাবে বলছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাদের মতে, ২০২২ শীতকালীন অলিম্পিক চিন সরকারের, বা আরো ভালো ভাবে বললে, সি জিংপিং এর ব্যক্তিগত গরিমা প্রদর্শন হয়েই থেকে যাবে।

More Articles