হাড়-হিম করা ভানগড়, সন্ধে হলেই শুরু আতঙ্কের প্রহর গোনা...

আজকের দিনে ভানগড়ের নাম শোনেননি—এমন লোক খুব কমই আছেন। বিশেষত ভৌতিক গল্প, সিনেমা যাদের পছন্দ! রাজস্থানের আলওয়ার জেলার এই দুর্গটি ভারতের অন্যতম ভৌতিক জায়গার তকমা পেয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা মান সিংহ তাঁর নাতি মাধো সিংহের জন্যে এই দুর্গ গড়ে তোলেন। দুর্গটি এক কথায় অনবদ্য, পরতে পরতে ছায়া কলঙ্কের। সেই ইতিহাসের লম্বা ছায়া আজও জেগে আছে। ভয়াবহ ভানগড় সম্বন্ধে অজানা কয়েকটি তথ্য আজ; যা পাঠককে জাগিয়ে রাখতে পারে সারারাত!

রাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ:

রাজস্থানের আর চার পাঁচটা দুর্গের থেকে এই দুর্গ আলাদা। অ্যাম্বার ফোর্ট যেখানে রাতের আলোতেই ফুটে ওঠে, সেখানে ভানগড়ে সূর্যাস্তের পর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। শোনা যায় বহু স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটক রাতের বেলা দুর্গের ভিতরে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন, আর ফেরেননি তারা। এমনকি আই স আই বা আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া এই অঞ্চলে বহু সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে এই নিষেধাজ্ঞাকে বলবৎ করার জন্য!

 

গুরু বালু নাথের অভিশাপ:

এই অভিশপ্ত দুর্গের পিছনে রয়েছে এক বহু পুরনো অভিশাপের গল্প। বর্তমানে যে অঞ্চলে দুর্গটি অবস্থান করছে, শোনা যায় সেই অঞ্চল ছিল গুরু বালু নাথের ডেরা। তিনি এখানে বসে সমাধিস্থ হতেন। রাজা মান সিংহ এই জায়গাটিতে দুর্গ করার জন্য এই সাধুর কাছে আবেদন করেন। বালু নাথ রাজিও হন। কিন্তু তাঁর একখান শর্ত ছিল! দুর্গের ছায়া যেন তাঁকে স্পর্শ না করে! রাজা রাজড়ার উপর খুব বিশ্বাসও ছিল না সাধুর। তাই তিনি সাবধান করেছিলেন, এমনটা যদি না হয়, আশেপাশের গোটা অঞ্চল ছারখার হয়ে যাবে তাঁর অভিশাপে। দুঃখের বিষয় তাই হল। কথা রাখেননি রাজা। দুর্গের ছায়া গুরু বালু নাথকে স্পর্শ করেছিল।

 

শয়তান জাদুকর ও তার বীভৎস মন্ত্র:

এই দুর্গের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরেকটি অভিশাপের কাহিনি। রত্নাবলী নামে ভানগড়ের এক রাজকুমারী ছিল। সিঙ্ঘিয়া নামে এক জাদুকর তার রূপে মুগ্ধ হয়ে রাজকুমারীকে বশ করতে চায়। সিঙ্ঘিয়া ছিল শয়তানের উপাসক। তন্ত্র মন্ত্রের দ্বারা রাজকুমারীকে কাছে টেনে আনার ছক কষতে থাকে সে। কিন্তু কোনো উপায়ে এই ষড়যন্ত্রের কথা জেনে যায় রত্নাবলী। আর যায় কোথায়! বিচারে জাদুকরের মৃত্যুদণ্ড হয়। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে সে এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ দিয়ে যায় ভানগড়ের উপর। সেই থেকেই এই দুর্গ অভিশপ্ত। জাদুকর বধের কিছুদিনের মাথায় রাজকুমারী খুন হয়ে যান আততায়ীর হাতে।

 

যে গ্রামে ছাদ নেই:

ভানগড় দুর্গের কাছেই রয়েছে একটা ছোট্ট গ্রাম। কিন্তু কোনও এক আশ্চর্য কারণে এ গ্রামের কোনও ঘরেই ছাদ নেই! গ্রামবাসীরা জানান, এ গ্রামে ছাদ থাকে না। যখনই কেউ ছাদ তোলার চেষ্টা করে বা তুলেও ফেলে, সেই ছাদ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। বহুবার বহুলোক চাপা পড়ার পরে ওঁরা এখন আর ছাদ তোলার চেষ্টাও করেন না। কেন এমনটা হয় তার সদুত্তর দিতে পারেননি কেউই।

 

ভৌতিক উপদ্রবে নিরুদ্দেশ বহু পর্যটক:

দুর্গটিকে ঘিরে নানা গা ছমছমে গল্প শোনা যায়। দুর্গে এসে নিরুদ্দেশ হয়েছেন বহু পর্যটক। শোনা যায়  একবার নাকি দু'টি ছেলে রাতে থাকবে বলে দুর্গে গিয়েছিল, তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আরেকবারের ঘটনা! তিনটি তরুণ থেকে গিয়েছিল রাতে দুর্গের ভিতরেই। ওদের মধ্যে একজন হাতে টর্চ থাকা সত্ত্বেও কুয়োর মধ্যে পড়ে যায়। বাকি দু'জন ছেলেটিকে উদ্ধার করে বহাল তবিয়তে হাসপাতালের দিকে রওনা হয়েছিল। কিন্তু ভবিতব্য! হাসপাতাল অবধি তারা পোঁছতে পারেনি। এক বীভৎস পথদুর্ঘটনায় তিনজনই মারা যায়।

 

অশরীরী উপস্থিতি:

যতই দুর্গ সুন্দর হোক, তাকে প্রাণভরে উপভোগ করা যায় না। সারাক্ষণ উদ্বেগ পর্যটকদের তাড়া করে ফেরে। দুর্গে ভিতরে ঢুকেই পর্যটকরা এই অস্বস্তি ও স্নায়ুর চাপে ভোগেন! কেউ কেউ অশরীরী উপস্থিতিও টের পান। ছায়ার মতো কিছু একটা তাদের অনুসরণ করে ফেরে, এ কথা বলেছেন বহু পর্যটক । প্রচণ্ড জনপ্রিয় এই দুর্গে তাই খুব বেশিক্ষণ কাটাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না বেশিরভাগ পর্যটকই!

 

চলমান দেওয়াল এবং গা হিম করা আর্তনাদ:

এ কথা আগেই বলেছি যে বহু লোকই দুর্গে রাত কাটানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন অবধি পেরে ওঠেননি কেউ। কেবলমাত্র একটি দল ছাড়া! স্থানীয়রা জানান, কয়েকটি কমবয়েসী ছেলেপিলে আশেপাশের লোকেদের সমস্ত ওজর আপত্তি সত্ত্বেও সন্ধের পরে ভানগড়ের দুর্গে ঢোকে। কিন্তু মাঝরাতে এক নারীকণ্ঠের আর্তনাদে চমকে ওঠে তারা। এই আর্তনাদ উত্তরোত্তর এমন বেড়ে চলে যে ভয়ে দিশাহীন হয়ে ছুটোছুটি শুরু করে সবাই। এইসময়ে হঠাৎ তাদের মনে হতে থাকে চারপাশের দেওয়াল গুলো যেন ক্রমে চেপে আসছে! কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসে তারা। আর কোনোদিন দুর্গের মুখোমুখি হয়নি দলটির কোনও সদস্য।

 

বিদেশি পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ:

ভারতের বাদবাকি ঐতিহাসিক স্থাপত্যে যেমন বিদেশি পর্যটকেরা প্রচুর ভিড় করেন, ভানগড়ে তাদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য! কেন? কারণ বিদেশি পর্যটকদের এই দুর্গ দেখার জন্যে এক বিশেষ পারমিট লাগে। সরাসরি কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও এই পারমিট পান হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র! বিদেশি পর্যটকদের এই অঞ্চলে বেড়ানোর সুযোগ ভারতীয় সরকারই এইভাবে দুঃসাধ্য করে তুলেছে। আগে এমনটা ছিল না। তবে দীর্ঘদিন থেকে নিখোঁজ হতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই বিদেশি পর্যটক হওয়ায় এই পথ বেছে নিতে হয়েছে।

 

নিরাপত্তার জন্য দেবদেবীর মন্দির:

অশুভ নানা ঘটনার মোকাবিলার জন্য, অলৌকিকের হাত থেকে বাঁচতে দুর্গের চারপাশে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বহুমন্দির। মনে করা হয়, এই মন্দির অশুভ শক্তিকে বেঁধে রাখে। দুর্গে ঢোকার মুখেই একটি হনুমান মন্দির পড়ে। দুর্গ চত্বরের ভিতরে রয়েছে আরো নানা মন্দির। স্থানীয় মানুষেরা বলে থাকেন, মন্দিরের জন্যই অশুভ শক্তির যাবতীয় কার্যকলাপ দুর্গের ভিতরেই সীমাবদ্ধ, নইলে আশেপাশের গ্রাম ছারখার হয়ে যেত!

এই সমস্ত নানা ঘটনা বছরের পর বছর ভানগড়ের বিভীষিকাকে আরও জোরালো করে তুলেছে। ধরা যাক, এই সমস্ত ঘটনা পড়ে আপনার দুর্গটাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করল! ধরা যাক, আপনি চলেই গেলেন আলওয়ারের সেই অনিন্দ্যসুন্দর দুর্গ দেখতে, সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ওই এলাকা থেকে ফিরে আসুন। নইলে কী হবে কেউ বলতে পারে না! 

তথ্যঋণ-

  • “8 Haunting Facts about Bhangarh Fort In Rajasthan.” 2020. Stories for the Youth! (blog). January 23, 2020.
  • “Bhangarh Fort: 5 Mysterious Facts about Bhangarh That Will Scare You to Bits | Times of India Travel.” n.d. Accessed December 11, 2021.
  • Maheshwari, Swati. 2018. “12 Mysterious Facts About Bhangarh Fort That Will Give You Goosebumps.” February 3, 2018.

 

More Articles