ভানগড় এবং রোমহর্ষক গল্প

রাজস্থান পর্যটন তার মরুভূমি, রাজকীয় আচার এবং ঐতিহাসিক দুর্গগুলির জন্য বিখ্যাত।  আপনি যদি এখানকার দুর্গ এবং প্রাসাদগুলি সম্পর্কে মুগ্ধ হয়ে থাকেন, তবে এমন একটি জায়গা সম্পর্কে আপনার জেনে নেওয়া প্রয়োজন যা আপনার রাজস্থান সম্পর্কে ধারণা এক্কেবারেই বদলে দিতে পারে। নীচে বর্ণিত কোনও ঘটনার কোনও প্রমাণ বা দলিল আমাদের কাছে নেই, সমস্ত কিছুই লোকমুখে প্রচলিত এবং এর কোনও ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা এই সমস্ত ঘটনার কোনও রকম সত্যতার দাবী বা বিজ্ঞাপন করি না, শুধু মাত্র এখানকার মিথ, রহস্য ও বিশেষজ্ঞদের দ্বারা বর্ণনা করা কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করলাম।

রাজস্থানের আলওয়ার জেলায় সরিস্কা রিজার্ভের সীমান্তে আরাবল্লি পর্বতমালায় অবস্থিত একটি গ্রামের নাম হল ভানগড়। নিকটতম গ্রাম গোলা কা বাস। এই রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ পাহাড়ের নীচে অবস্থিত; এখানে একটি পুকুর রয়েছে, যাকে ঘিরে রয়েছে কিছু গাছ এবং প্রাসাদের চত্বরে রয়েছে একটি প্রাকৃতিক ঝর্না। ভারতের সব চেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গা হিসাবে খ্যাত এই গ্রাম একসময় ভীষণ সমৃদ্ধ একটি শহর ছিল। সম্রাট আকবরের দরবারের নয়টি রত্নের অন্যতম মান সিংহের জন্য তাঁর পিতা মাধো সিংহ ১৭ শতাব্দীতে এই প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। ভানগড় দুর্গটি এক সময় সৌন্দর্যের জন্য এবং শক্তিশালী হিসেবে বিখ্যাত ছিল। ধারণা করা হয় যে রাতারাতি নির্জন হওয়ার আগে ভানগড়ে ১০,০০০ জনের বেশি লোক বাস করতেন! কিন্তু বর্তমানে এর করুণ অবস্থা দেখে এই সত্যি সম্পর্কে বিশ্বাস করা শক্ত। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে রাজস্থান সরকার এবং আর্কিওলোজিকাল সার্ভে অফ্ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে একটি নির্দেশাবলী এই প্রাসাদের বাইরে ঝোলানো রয়েছে, তাতে লেখা আছে সূর্য ওঠার আগে এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার পর কেউ যেন এই অঞ্চলে প্রবেশ না করে, যদি কেউ প্রবেশ করতে চান তবে তার সরকারি ভাবে অনুমতি নেওয়া আবশ্যিক। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া এখানে প্রবেশ করেন তা সম্পূর্ন বেআইনি এবং এইরূপ কোনও প্রবেশের দায়িত্ব সরকারি কর্তৃপক্ষের নয়।

শোনা যায় এখানে সাহস দেখিয়ে রাত কাটাতে আসা বহুমানুষ আর ফিরে আসেন নি, অনেক সময় উদ্ধার হয়েছে তাদের মৃতদেহ। আবার কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনায় বলা হয়, তিন যুবক এই প্রাসাদে রাত কাটাতে এলে তাদের মধ্যে থেকে একজন প্রাসাদের ভেতরে থাকা একটি কুয়োয় পড়ে যান। কোনও ভাবে বাকিরা তাকে উদ্ধার করেন এবং সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। এইঘটনার কদিন পর একটি দুর্ঘটনায় তিনজনেরই মৃত্যু হয়। যদিও উপরের কোনও ঘটনার কোনও লিখিত প্রমাণ বা দস্তাবেজ আমাদের কাছে উপস্থিত নয়। এই জায়গার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তলিয়ে দেখতে গেলে দুটি গল্প আঞ্চলিক মানুষের কাছে সব থেকে বেশি শোনা যায়। জনশ্রুতি অনুসারে, ভানগড় দুর্গ যে ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে একসময় বালু নাথ বা বালক নাথ নামে এক সাধু বাস করতেন।

ভানগড় এবং রোমহর্ষক গল্প

চিত্রঋণ : Google

মাধো সিংহ দুর্গটি নির্মাণের সময় এই সাধু তাকে জানিয়েছিলেন যে অঞ্চলের কোনও প্রাসাদ যেন উচ্চতায় সন্ন্যাসীর বাড়িকে ছড়িয়ে না যায়! যদি এইরকম কোনও ঘটনা ঘটে এবং সন্ন্যাসীর বাড়ির ওপর সেই বাড়িটির ছায়া পড়ে তাহলে সন্ন্যাসীর অভিশাপে ভানগড় রাতারাতি শূন্য এবং ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু মাধো সিংয়ের উচ্চাভিলাষী এক উত্তরসূরী নাকি এই সতর্কবার্তা এড়িয়ে আরও উচু মহল তৈরি করেন এবং এই প্রাসাদের ছায়া সন্ন্যাসীর বাড়িতে পড়লে অভিশাপ ফলে গিয়ে রাতারাতি উজাড় হয়ে যায় ভানগড়। আরও একটি গল্প, যা আরও বেশি প্রচলিত, সেখান থেকে জানা যায় রত্নাবতী নামের একজন অসম্ভব সুন্দরী রাজকন্যা এই নগরে বাস করতেন এক সময়ে। সিনহাই নামের একজন কালো জাদুর বিদ্যায় পারদর্শী তান্ত্রিকের নজর পড়ে এই সুন্দরীর ওপর এবং তার সাধ হয় ওই মহিলাকে পাওয়ার। এমনই একদিন তিনি লক্ষ্য করেন রত্নাবতী তাঁর সখীদের সঙ্গে বাজারে এসেছিলেন চুলে লাগানোর তেল অথবা সুগন্ধি আতর কেনার জন্য। তান্ত্রিক এই সময় ছল করে এই বোতলে কালো জাদুর মন্ত্র মিশিয়ে দেন। কিন্তু রাজকুমারী মহলে পৌঁছে এই বিষয় সম্পর্কে খবর পেয়ে যান। প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, এই মন্ত্রে রাজকুমারীর বশীভূত হয়ে তান্ত্রিকের কাছে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাজকুমারী খবর পাওয়া মাত্রই এই শিশি ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং তা গিয়ে পড়ে একটি পাথরের ওপর। তান্ত্রিকের কালো জাদুতে বশীভূত হয়ে পাথরটি তান্ত্রিকের কাছে গড়িয়ে যেতে আরম্ভ করে এবং তান্ত্রিকের বুকের ওপর গিয়ে থামে। মৃত্যুর ঠিক আগে তিনি অভিশাপ দেন যে ভানগড় ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার কথামতই আগামী বছরে শত্রুপক্ষের হাতে ভয়ানক হারের সম্মুখীন হন স্থানীয় রাজা। রাতারাতি গ্রামের সমস্ত মানুষের মৃত্যু হয়, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এই নগরী।

ভানগড়ের রহস্যগুলি শুরু ঠিক এইখানেই। শোনা যায় পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে যারাই বসবাস করার চেষ্টা করেছেন তাদের প্রত্যেকেই কোনও না কোনও কারণে এখানে থাকতে পারেন নি। একবার বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে ছাদ ধসে পড়ে এক দুর্ঘটনায়, যার ফলে মৃত্যু হয় বহুমানুষের। তারপর থেকে এই এলাকার আসে পাশে কেউ বাড়ি তৈরি করলেও ছাদ বানানোর সাহস করেন নি, এবং এই এলাকার কাছাকাছি বাড়ি গুলি বেশিরভাগই ছাদ ছাড়া। এই অঞ্চলে বিদেশি পর্যটকদের যাতায়াত একবারেই নিষিদ্ধ। অঞ্চলের ভেতরে উদ্ধার করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট মন্দির, যার মধ্যে হনুমান, সোমেশ্বর, গোপীনাথ মন্দির, কেশব রায় মন্দির রয়েছে। প্রাসাদের বাইরের দিকে একটি পুরোহিতের ঘর রয়েছে, যাকে পুরোহিত কী হাভেলি বলা হয়। লোকালয়ে যারা থাকেন, তাদের মুখে শোনা যায় রাতের সময় দুর্গ চত্বরের ভেতর থেকে অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাওয়া যায় এবং বাতাস অস্বস্তিকর ভারী হয়ে ওঠে। কেউ কেউ রাতের সময় অদ্ভুত বোটকা গন্ধের কথাও উল্লেখ করেন। কিন্তু বহু সাংবাদিক বা গবেষকরা এই অঞ্চলে প্রবেশ করে কোনওরকমে অশরীরী সংকেত কে স্বীকার করে নেন নি। উল্লেখ্য ২০১৩-১৪ সাল নাগাদ একটি বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমের জনৈক সাংবাদিক কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সমেত এই প্রাসাদে প্রবেশ করেন এবং রাত কাটিয়ে অক্ষত বাইরে আসেন। একজন বিশেষজ্ঞ অসুস্থ বোধ করেন বলে দাবী জানালেও ওই সাংবাদিক কোনওরকম অশরীরী শক্তির কথা নাকচ করেন। বরং তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে বহু বছর থেকে এভাবে পড়ে থাকার কারণে এই জায়গাটিতে নেগেটিভ শক্তির উৎপত্তি হয়েছে, যা প্রেতাত্মা একেবারেই নয়। অক্সিজেনের অভাবে কিছু কিছু জায়গায় দম বন্ধ হয়ে আসা বা গা ছমছমে পরিবেশে ভয় পাওয়া ভীষণ স্বাভাবিক। বর্তমানে বহু মানুষ দাবী করেন যে তারা এই দুর্গে রাত কাটাতে চাইলেও স্থানীয় মানুষরা রীতিমত ঠেলে এই এলাকা থেকে ভ্রমণকারী বা উৎসাহীদের বের করে দেন।

এতো কিছুর পরও ভানগড় একটি অপূর্ব জায়গা যা আপনি চাইলে দিনের বেলায় ভ্রমণ করতেই পারেন। দিল্লিতে থেকে এখানে পৌঁছতে আনুমানিক পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। কখনও রাজস্থান গেলে জয়পুর, উদয়পুর, পুষ্কর, যোধপুর, বিকানের, জয়শলমেরের সাথে আপনি ভানগড়কেও জুড়ে নিতে পারেন। বলা যায় না এই রোমহর্ষক ভূতের গল্পে আপনিও কোনও রহস্য উন্মোচন করে ফেললেন!

 

তথ্য সূত্র :

  • https://youtu.be/yI2NkJ0-nUc
  • https://en.m.wikipedia.org/wiki/Bhangarh_Fort
  • https://m.daily-bangladesh.com/english/The-cursed-fort-where-no-roof-sustains/29604

More Articles