স্কুলে 'অন্ধ' বলে খ্যাপাত বন্ধুরা, আজ দুনিয়াকে সাফল্যের আলো দেখাচ্ছেন ভবেশ ভাটিয়া

৯৭০০-এরও বেশি বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ এই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদেরকেও নিজের পায়ে দাঁড়াবার যুযোগ দিচ্ছেন ভবেশ।

“মঞ্জিলোঁ কো কভি ইয়ে না বাতাও কি তুমহারি তকলিফ কাহাঁ হ্যায়… লেকিন তকলিফ কো জরুর ইয়ে বাতাও কি মাঞ্জিল কাহাঁ হ্যায়”— বলেন ভবেশ ভাটিয়া। অর্থ, গন্তব্যর কাছে বাধার গল্প করতে নেই, বরং বাধার কাছে গন্তব্যের গল্প করো। বহু বছর হয়ে গেল, এই ‘অন্ধজন’ নিজেই হাজার হাজার মানুষকে আলো সরবরাহ করছেন। দানে আলো পাওয়ার অপেক্ষা তাঁর ছিল না কোনওদিনই। নিজে চোখে দেখতে পান না, তাতে কী, সেই অক্ষমতাকেই নিজের শক্তিতে পরিণত করেছেন ভবেশ। কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে মোমবাতি বানাতে শিখেছেন, তা বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে নিজের ব্যবসা শুরু করেছেন, এখন সেই ব্যবসা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বজোড়া বাজার তার। ভবেশ ভাটিয়ার গল্প রইল সকলের জন্য।

গুজরাটের অঞ্জর গ্রামে জন্ম ভবেশের। ১৯৫৬ নাগাদ প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয় গুজরাটে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল মানুষের। সেই কারণেই গ্রাম ছেড়ে মহাবালেশ্বরে চলে আসতে হয় ভাটিয়া পরিবারকে। জন্মান্ধ ছিলেন না ভবেশ। তবে রেটিনা ম্যাকিউলার ডিজেনারেশনে আক্রান্ত হন। বয়স যখন কুড়ি, ভবেশ তখনই সম্পূর্ণ দৃষ্টি হারান। ভবেশের মা বরাবরই চেয়েছিলেন, ছেলে যেন ‘স্বাভাবিক’ স্কুলে পড়ে। দৃষ্টিহীনতার কারণে ছেলেটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে– এ তিনি কোনও মতেই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু স্কুলের প্রথম দিন থেকেই তাঁকে আলাদা করে দেওয়া হয়। শিক্ষকরা বলতেন, “তুমি পড়তেও পারবে না, খেলতেও পারবে না– ওদিকে গিয়ে বোসো।” ক্লাসমেটরা তাঁকে 'অন্ধ', 'অন্ধ' বলে খেপাত। বাড়ি এসে মাকে সব খুলে বলতেন। মা তাঁর চুলের ভেতর বিলি কেটে দিতেন হাত দিয়ে। বলতেন, “তুই চোখে কাউকে দেখতে পাস না বাবা, কিন্তু এমন কাজ কর যাতে সব্বাই তোকে একদিন দেখতে পায়।”

বরবারই ছেলেকে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন তিনি। ভবেশের যখন বয়েস ষোলো, তখন স্কুলের পাট চুকল। একদিন এক বন্ধুকে নিয়ে সাইকেলে বেরিয়ে পড়লেন ভবেশ। বন্ধুটির একটি পা নেই। তার কাজ ছিল সাইকেলের হ্যান্ডেল সামলানো। আর ভবেশ করতেন প্যাডেল। ৪৫ দিনে ৬০০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে নজির গড়েছিলেন তাঁরা। এই প্রথম সাফল্যের স্বাদ পাচ্ছিলেন ভবেশ। মন বলছিল, আরও আরও এগিয়ে যেতে হবে।

আরও পড়ুন: ভারতে ইন্টারনেটের জনক, মন্ত্রী-আমলাদের বিরোধিতাতেও অটল ছিলেন বিকে সিঙ্গাল

একটা হোটেলে টেলিফোন অপারেটরের কাজ নিলেন। কিন্তু এসময় ধীরে ধীরে দৃষ্টি সম্পূর্ণই নিভে গেল। বাধ্য হয়ে কাজটা ছেড়ে দিতে হলো। কিন্তু ঘরে বসে থাকার মানসিকতা ছিল না। এদিক-ওদিক কাজ খুঁজছেন। এরই মাঝে মা মারা গেলেন ক্যানসারে। মানসিকভাবে খানিকটা ভেঙে পড়লেন তিনি। মাথার ওপর তখন প্রচুর ঋণের বোঝা। কিছু একটা না করতে পারলে চলবে কী করে? বছর ২৪ বয়স যখন তাঁর, তখন সেই পথের হদিশ পাওয়া গেল। ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ব্লাইন্ড অ্যান্ড ট্রেইন্ড’ সংস্থা থেকে মোমবাতি তৈরির প্রক্রিয়াটা রপ্ত করলেন ভবেশ। নানা খুচরো কাজের সঙ্গে সঙ্গে নিজের তৈরি মোমবাতি বিক্রি করতে শুরু করলেন ভবেশ। বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। নাম দিয়েছিলেন 'সানরাইজ ক্যান্ডেলস'। মহাবালেশ্বরে যে সানরাইজ পয়েন্ট রয়েছে, তারই নামে।

সেই সময়ই নীতার সঙ্গে আলাপ। মহাবালেশ্বরে ঘুরতে এসেছিল সে। একটি অন্ধ ছেলেকে রোজ দরজায় দরজায় মোমবাতি দেখে কৌতূহল হয় নীতার। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি– ছেলেটি ঠিক আসবে মোমবাতি হাতে বাড়ি বাড়ি। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, বাধা জয় করে খেটে খাওয়ার মানসিকতা নীতাকে মুগ্ধ করল। তিনিও রোজ বেরিয়ে পড়তেন ছেলেটির সঙ্গে। টুকটাক সাহায্য করত। এভাবে কাটল প্রায় আঠারো-উনিশ দিন। নীতা ভবেশকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন। ভবেশের কাছে এ একেবারেই অপ্রত্যাশিত। হাতে চাঁদ পেল সে। একমাসের মধ্যেই বিয়ে করে ফেললেন তাঁরা। মোমবাতি তৈরির কাজ আরও সংঘবদ্ধ হল। রাস্তাঘাটে বহু অন্ধ মানুষকে ভিক্ষা করতে দেখতেন তাঁরা। এঁদের কেউ কাজ দেয় না। মোমবাতি বেচার কাজে তাঁদের পাঁচ জনকে নিযুক্ত করলেন ভবেশ। ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়ল, বিক্রি বাড়ল, বাজার তৈরি হলো। তাঁর ভাষায়, “একটি একটি করে ইট গেঁথে, একটি একটি করে মোমবাতি বেচে আমি আমার কোম্পানি তৈরি করলাম।”

প্রথম প্রথম অন্ধ বিক্রেতা দেখে ঠকিয়ে নিত বেশ কিছু মানুষ। ছেঁড়া টাকা দিত, পুরনো টাকা দিত। তখন ভবেশের ছেলে কুণাল পরামর্শ দিল, সমস্ত স্টলে একটা করে পেটিএম সাউন্ডবক্স লাগানো হোক। এর ফলে চাকা ঘুরে গিয়েছিল। প্রত্যেকটি পয়সার হিসাব সঠিকভাবে পাওয়া যেত। যেহেতু সবার সামনেই কীভাবে কত টাকা দেওয়া হচ্ছে, তা বলে দেওয়া হতো, ফলে আর কেউ ঠকাবার সাহস করত না। ব্যবসা হু হু করে বাড়তে লাগল। ১০ কেজি মোম দিয়ে ভবেশ ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আজ প্রতি মাসে তাঁর কারখানায় ২০০ টনের বেশি মোম ব্যবহার করা হয়।

'সানরাইজ ক্যান্ডেলস' এখন রিলায়েন্স এবং বিগ বাজারের মতো ক্লায়েন্টকে মোমবাতি সরবরাহ করে। “রিলায়েন্স একবার আমাদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য অনুদান দিতে চেয়েছিল। আমরা সেই অফার ফিরিয়ে দিয়েছি। বলেছি সত্যিই সাহায্য করতে চাইলে আমাদের আরও বেশি কাজ দিন,” বলেছিলেন ভবেশ। এখন তাঁদের ৭২টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট। স্কিল ডেভেলপমেন্টের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন তাঁরা। ৯৭০০-এরও বেশি বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ এই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদেরকেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যুযোগ দিচ্ছেন ভবেশ। ইতিমধ্যে তিনটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, এবং বিশেষভাবে সক্ষমদের স্পোর্টসে ১১৭ খানা মেডেল জিতেছেন ভবেশ। তাঁর দৃষ্টি আরও এগিয়ে যাওয়ার দিকে।

 

 

More Articles