বোয়িং মানেই কি ঝুঁকি? চিনের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় উঠছে প্রশ্ন

মেলেনি কোনও যাত্রীরা দেহ। কয়েকশো উদ্ধারকর্মী লাগিয়েও চিনের বিমান দুর্ঘটনায় খুঁজে পাওয়া যায়নি একজন জীবিত যাত্রীকে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিমানে থাকা ১৩২ জন যাত্রীর আর কেউই বেঁচে নেই। তবে মৃতের সংখ্যা এবং দুর্ঘটনার কারণ এখনও অজানা। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর আড়াইটে নাগাদ দক্ষিণ চিনের গুয়াংশি প্রদেশের উঝাও প্রদেশের কাছে তেং কাউন্টিতে ভেঙে পড়ে বোয়িংয়ের যাত্রাবাহী বিমান। 

কী ঘটেছিল সেদিন? 

দুপুর ১ টা ১১ মিনিটে ১২৩ জন যাত্রী ও ৯ জন বিমানকর্মী সহ ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং থেকে যাত্রা শুরু করেছিল চিনা ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের বিমান এমইউ -৫৭৩৫। গন্তব্যস্থল গুয়াংডং প্রদেশের রাজধানী গুয়াংঝাও পৌঁছানোর কথা দুপুর ৩ টে বেজে ৫ মিনিটে। মাত্র ১ ঘণ্টা ৫৪ মিনিটের আকাশ সফর ছিল উড়ানটির। কিন্তু দুপুর ২ টো ২২ মিনিটের মাথায় বিমানটির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের। বিমানটি সেসময় ছিল উঝাও শহরের আকাশে। সময় পেরিয়ে গিয়েও বিমানবন্দরে না পৌঁছতেই শুরু উদ্বেগ বাড়তে থাকে যাত্রীর পরিজনদের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিনা বিমান পরিবহণ মন্ত্রক জানায়, উঝাওয়ের কাছে ভেঙে পড়েছে বিমানটি। দুর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়া বিমানটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের, যার বয়স ছিল মাত্র ছ'বছর। 

বিমানের গতিবেগ নির্ধারণকারী সংস্থা জানিয়েছে, শেষ কয়েক মিনিটে কার্যত হু হু করে মাটিতে আছড়ে পড়েছে বিমানটি। জানা যায় কুনমিং থেকে ওড়ার ১ ঘণ্টা ৯ মিনিটের মাথায় বিমানটি ২৯ হাজার ১০০ ফুট উচ্চতায় ছিল। এর ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই সেটি নেমে আসে ৯ হাজার ৭৫ ফুটে। আরও ২০ সেকেন্ড পরে বিমানটি ৩২২৫ ফুট উচ্চতায় নেমে আসে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই মিনিটের মধ্যে ২৯ হাজার ফুট থেকে ৩ হাজার ফুটে নেমে আসে বিমানটি। 

বিমানের চালক পরিবহণ মন্ত্রককে কোনো বিপদ সংকেত পাঠায়নি বলে জানা গেছে। দুর্ঘটনার সময় আকাশে সামান্য মেঘ থাকলেও দৃশ্যমানতা নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না বলেই জানিয়েছেন আবহাওয়া দপ্তর। বিমান পরিবহণ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ লি শিয়াওচিনের মতে,' যে সময় ঘটনাটি ঘটেছে ,তখন বিমান অটোপাইলট মোডে থাকার কথা।সেক্ষেত্রে যান্ত্রিক ত্রুটির সম্ভাবনা কম'। বিমানটি মাটিতে আছড়ে পড়ার আগের মুহূর্তের যে ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দেখা গেছে বিমানটি নাক বরাবর সোজা মাটির দিকে নেমে এসেছে। পাহাড়ে ঘেরা ঘন জঙ্গলে বিমানটি ভেঙে পড়তেই চারিদিক কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। 

ইউএস-ভিত্তিক বিমান দুর্ঘটনা বিশ্লেষক রবার্ট মান সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, 'এই বিমান দুর্ঘটনার তদন্তকারীদের ব্ল্যাক বক্স বা ডেটা রেকর্ডারের প্রয়োজন হবে'। তবে এখনও পর্যন্ত কোনও ব্ল্যাক বক্সের হদিশ মেলেনি বলেই জানা গেছে।বিমান দুর্ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেণ্ট শি জিনপিং। 

বোয়িং মানেই কি ঝুঁকি? ফিরে দেখা ইতিহাস 

চিনের বিমান পরিষেবা বিশ্বের অন্যতম সুরক্ষিত বলে মনে করা হয়। এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে বোয়িং ৭৩৭ বিমান মডেলকে নির্ভরযোগ্য পরিবহনকারী বিমান হিসেবে গণ্য করা হয়। এমনকি ভারতে টাটা এয়ার ইন্ডিয়া, স্পাইসজেটের মত কোম্পানিগুলিও যাত্রী পরিবহণের জন্য এই বোয়িং ৭৩৭ ব্যবহার করে। সোমবার চিনের দুর্ঘটনার খবর আসতেই ভারতের বোয়িং ৭৩৭ বিমানগুলির ওপর অতিরিক্ত নজরদারি শুরু করেছে বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। তবে এই বিমান প্রস্তুতকারী কোম্পানির বিভিন্ন মডেলের দুর্ঘটনার ইতিহাসও রয়েছে। ২০১০ সালের পর চিনে এত বড় আকারের বিমান দুর্ঘটনা ঘটল। সেই দুর্ঘটনায় ৪৪ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। 

সোমবার পর্যন্ত, বোয়িং ৭৩৭ বিমানের ২৫ বছরের ইতিহাসে এক ডজন মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে এই উড়ান।সর্বপ্রথম ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাজারে আসার মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ব্রাজিলে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এই বিমান। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান অন্তত ১৫৪ জন। পরের বছর ৫ মে ক্যামিরুনে কিনিয়া এয়ারওয়েজের একই মডেলের বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান একশোর অধিক মানুষ।২০০৯ সালে তুর্কিতে ভেঙে পড়ে অ্যামস্টারডাম এয়ারপোর্টে। ২০২০ সালেও ইউক্রেনে বোয়িং দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৬৭ জন। ইথিয়োপিয়াতে বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়লে চিনে বেশ কিছু সময় বন্ধ করেও দেওয়া হয় এই বিমান। তবে শেষ রক্ষা হল না। বেঘোরে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন ১৩২ জন যাত্রী। 

More Articles