অলৌকিক সংলাপ: শিশিরকুমার দাশের অত্যাশ্চর্য কীর্তি

ধরা যাক, আমরা পিছিয়ে গেলাম আজ থেকে তিন হাজার বছর আগেকার কোনো সময়ে। তখনও মানুষ বসবাস করত এ পৃথিবীতে – তারা কৃষিকাজ করেছে, নগরপত্তন করেছে, যুদ্ধ করেছে, অন্য মানুষকে হত্যা করেছে; আবার একইসাথে, কেউ কেউ কবিতা লিখেছে, তৈরি করেছে সুর। ধরা যাক, সেই সময়ের পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগলিক অবস্থান থেকে যদি নির্বাচন করা হয় কিছু চরিত্র – কেউ কেউ হয়তো রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষ, আবার কেউ কেউ হয়তো সেই রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষদের সৃষ্ট কল্পনা – তেমনই কিছু চরিত্র যদি নিয়তির পরিহাসে পরষ্পরের মুখোমুখি হয়? যদি মহাভারতের অন্ধ সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেন সফোক্লিস সৃষ্ট গ্রিক ট্র্যাজেডির বিখ্যাততম চরিত্র রাজা ওয়েদিপাউস, আর তাঁদের কথোপকথনে যুক্ত হন সেই একই লেখকের সৃষ্টি অন্ধ-ত্রিকালজ্ঞ তেইরেসিয়াস? যদি প্রাচীন ভারতের প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার কালিদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তৎকালীন গ্রিসের তাত্ত্বিক-দার্শনিক অ্যারিস্টটলের? যদি গ্রিক এপিক ইলিয়াডের অন্যতম প্রধান চরিত্র প্যারিস, যার উদ্দাম প্রেম এবং হেলেনকে নিয়ে ট্রয় থেকে পালিয়ে আসার কাহিনি দিয়ে সুত্রপাত দীর্ঘ মহাযুদ্ধের, তার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে যায় দেবরাজ ইন্দ্রের, কেমন কথোপকথন জন্ম নেবে সে সাক্ষাৎ থেকে? 

বাস্তবে এ সাক্ষাৎ হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু বস্তুজগতের বাস্তবতায় মানুষ আর কতদিনই বা নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে পেরেছে? কল্পনার বাস্তবতা চিরকালই বস্তুজগৎ ছাড়িয়ে ডানা মেলেছে অসীম শূন্যতায়। শিশিরকুমার দাস তাঁর অলৌকিক সংলাপ বইয়ে নথিভুক্ত করেছেন এমনই দশটি কাল্পনিক সংলাপ যেখানে একাকার হয়ে মিশে গেছে গ্রিস থেকে ভারতবর্ষ, হেলেন থেকে সীতা, ঊর্বশী থেকে অ্যাফ্রোদিতে। প্রাচীনকালের মহাকাব্য চিরকালই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী মাত্রেই তার সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। কিন্তু অ্যাকাদেমিক পরিসরের বাইরে, মুখে মুখে জনশ্রুতির মধ্যে মিশে থাকা বিরাটাকার এই কাহিনিদের সচরাচর খুব বেশি লেখক তাঁদের সৃষ্টিশীল কাজের আওতায় নিয়ে আসেন না। শিশিরকুমার দাস সেই বিরলতম লেখকদের মধ্যে অন্যতম, যিনি আজীবন অ্যাকাদেমিক পরিসরে নিরলস পরিশ্রম করেও একের পর এক সৃষ্টিশীল সাহিত্যকীর্তি রচনা করে গেছেন, লিখেছেন কবিতা। একদিকে যেমন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পত্তন এবং ঊনিশ শতকের বাংলা নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ লিখেছেন তিনি, তেমনই গ্রিক থেকে সরাসরি অনুবাদ করেছেন অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স, সাফোর কবিতা। পাণ্ডিত্যের এমন বৈচিত্রপূর্ণ প্রসারণের মধ্যেই অলৌকিক সংলাপ একটি আশ্চর্য সৃষ্টি, যেখানে মিশে গিয়েছে তাঁর অগাধ জ্ঞানের ভাণ্ডার এবং সেই ভাণ্ডার থেকে তুলে আনা কবির মনন। 

যেমন ধরা যাক কালিদাস আর অ্যারিস্টটলের সংলাপটি, যা দিয়ে এই বই শুরু হয়। কোনো নাটকের উৎসব হচ্ছে, যেখানে কালিদাসের শকুন্তলা অভিনয় চলছে, আর অ্যারিস্টটল সেই উৎসবের বিচারক – এমন প্রেক্ষিতে কথাবার্তা শুরু দু'জনের। দুই মহীরূহের এই কাল্পনিক সংলাপে শিশিরবাবু খানিক গল্পের ছলেই দেখিয়ে দেন গ্রিক এবং ভারতীয় নাটকের কাঠামোর মূল পার্থক্যটি – যেটুকু হয়তো করা যেতে পারত কোনোপ্র গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ দিয়েও, যা আমরা সচরাচর পড়েই থাকি। কিন্তু শিশিরবাবুর মুন্সিয়ানা এখানেই – এই সূত্রটুকু তাঁর যাত্রার সূচনামাত্র, এর পরে তিনি পাড়ি দেবেন অসীমত্বে। নাটকের নন্দনে শুরু যে আলোচনা, সেই আলোচনা মোড় নেবে জীবনের দর্শনে, অ্যারিস্টটল কালিদাসকে জিজ্ঞেস করবেন, প্রেম কাকে বলে তুমি জানো কালিদাস? আর কালিদাসের উত্তর চকিতে নিয়ে যাবে সাফোর কবিতার কাছে, “পাহাড়ের গায়ে অরণ্যের ঝড় যেমন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে”, অ্যারিস্টটল চমকে সাফোর কবিতার কথা মনে করেই বলবেন, প্রেমের মতোই, “মানুষের কঠিন সমস্যা কী ভাবে তাঁকে যুক্তি, নীতি, কর্তব্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, কী ভাবে মানুষ সহজকে পরিত্যাগ করে কঠিনের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে”। আর কালিদাসের উত্তর হয়তো মনে করিয়ে দেবে জীবনানন্দকে, “দেখেছি, কিন্তু বুঝেছি জীবন আরও বড়।… মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু তার পরেও জীবন থেকে যায়”। 

প্রাচীনকালের এই চরিত্রদের শিশিরবাবু এমন জাদুতে পরিবেশনা করেন, মুহূর্তে যেন ছিন্ন হয়ে যায় দেশ-কাল-ভূগোলের গণ্ডী, মনে হয় তাঁরা কথা বলছেন এই সমসময়ের মানুষের যন্ত্রণা, দুঃখ, আনন্দ, কষ্ট নিয়ে। কালিদাসের অনুভব, হেলেন, অ্যাফ্রোদিতে, ইন্দ্র, প্যারিস, ধৃতরাষ্ট্রের অনুভব স্পর্শ করে হাজার হাজার বছর পরবর্তী মানুষকেও, তাদের জীবনের জটিল আবর্তে তারা ছুঁয়ে যেতে পারেন অতীতের এই বাস্তব বা কল্পনার মানুষদের। অলৌকিক সংলাপ বইটির এই নিতান্ত লৌকিক কাব্যিক স্পর্শই তার প্রধানতম সার্থকতা।

More Articles