বিকল্প সরকার গঠন থেকে ট্রেন লুঠ, রামচন্দ্র লাড ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অকথিত অধ্যায়

মহারাষ্ট্রের সাতারা এবং সংলি অঞ্চলে গড়ে উঠেছে এক সমান্তরাল সরকার, স্থানীয়দের ভাষায় 'প্রতিসরকার'। ইংরেজদের পুলিশ সেখানে ঢুকতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের তৈরি কোনও আইন কানুনও খাটে না সেখানে। 'প্রতি সরকারে' থাকা মানুষজন মুলস্রোতের থেকে খানিক আলাদা হয়েই বানিয়ে ফেলেছেন নিজেদের দিনযাপনের নিয়মাবলী। তাঁদের এলাকা পাহারা দেন 'তুফান সেনা'র সশস্ত্র কর্মীরা। এমনটাই ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়কার সাতারা এবং সংলির চিত্র। মহারাষ্ট্রের একদল মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতার জন্য। ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী পদক্ষেপে তাঁদের একাংশ সদ্য প্রতিষ্ঠিত 'তুফান সেনা' দলে যোগ দিতে লাগলেন। ইতিহাসের অলাতচক্রে যুক্ত হল একের পর এক বিপ্লবীর নাম, নানা পাতিল, নাগনাথ নায়কওয়াড়ি, গণপতি দাদাসো লাড। এ ছাড়াও ছিলেন রামচন্দ্র শ্রীপতি লাড, পরবর্তীকালে যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন 'ক্যাপ্টেন ভাউ' নামে। 

 ১৯৪২ সালে গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। তাঁর 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে'র অঙ্গীকার উদ্বুদ্ধ করছিল সকল মুক্তিকামী মানুষকে। এ অবস্থায় মহারাষ্ট্রের এক যুবক পণ করলেন, 'আর নয়, অনেক হয়েছে। এবার সত্যিই হয় স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু।' সংলির কুণ্ডল গ্রামের এই যুবককে সকলে চিনতেন রামচন্দ্র নামে। অল্পবয়সেই বাবাকে হারিয়েছেন তিনি এবং তাঁর ভাই গণপতি। মায়ের উদয়স্ত পরিশ্রমে বড় হচ্ছিলেন তাঁরা। দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার। গান্ধীজী তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন আগেই, কিন্তু এবার ইংরেজ হুকুমতের বিরুদ্ধে তাঁরা এমন এক পন্থা অবলম্বন করলেন যাকে ঠিক গান্ধীবাদী বলা চলে না। 

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কাজকর্ম করতে করতেই রামচন্দ্র একটা সৈন্যদল তৈরির পরিকল্পনা করলেন। ভাই গণপতির সাহচর্য তো ছিলোই। এবার তাঁদের সঙ্গে এসে যুক্ত হলেন নানা পাতিল নামে আরও এক সুহৃদ, গড়ে উঠল 'তুফান সেনা' দল। কিন্তু প্রশ্ন হল 'তুফান সেনা'রা কাজ করবেন কীভাবে? কাদের জন্যই বা তাঁরা লড়বেন? ইংরেজ সরকার সে সময় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের চাপে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন। তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে যে আরও এক অভ্যুত্থান গড়ে উঠবে এমনটা তাঁরা কল্পনা করতে পারেননি। ১৯৪৩ সাল নাগাদ 'তুফান সেনা'র সদস্যরা ঘোষণা করলেন যে তাঁরা ইংরেজদের আইন মানেন না। তাঁরা এ কথাও জানালেন যে সাতারা এবং সংলির বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে  তৈরি হবে এক বিকল্প সরকার, যার নাম  'প্রতি সরকার'। 

'প্রতি সরকারে'র মূল দায়িত্বে ছিলেন রামচন্দ্র, গণপতি এবং নানা ছিলেন তাঁর সহযোদ্ধা। প্রায় ১৫০ গ্রামের মানুষজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিয়েছিলেন এই বিকল্প সরকারকে। ইংরেজ আইন কানুনের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হেঁটে গেরিলা পদ্ধতিতে গড়ে ওঠা এই সরকারের লক্ষ ছিল সমন্বয় ব্যবস্থা স্থাপন করা। লাগাতার চেষ্টায় নিজেদের অধীনস্থ এলাকাগুলি থেকে তাঁরা অস্পৃশ্যতার সমস্যা কিছুটা দূর করতে পেরেছিলেন। গ্রামের প্রতিটা ছেলেমেয়ের হাতে তুলে দিতে হবে খাতা কলম, এমনটাই ছিল তাঁদের নীতি। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, চারদিকে শস্যের অকাল। কী করা যায়? ভালভা অঞ্চলের একদল মানুষ সিদ্ধান্ত নিলেন, 'বড়লোকদের গুদাম লুট করো। দরকারের সময় একদল মানুষ নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত শস্য সঞ্চয় করে রাখবেন, তা চলবে না।' রামচন্দ্রের মাথা থেকেই বেরোচ্ছিল এমন সব দুঃসাহসী কাজকর্মের প্ল্যান। 'প্রতি সরকার' ইংরেজ পুলিশের বুকে থরহরি কম্প ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রায় কারুরই হিম্মত হয়নি 'তুফান সেনা'র সতর্ক বলয় ভেদ করে তাঁদের মুক্তাঞ্চলে প্রবেশ করার। 

স্বাধীনতার জন্য জান কবুল করার নীতিতেই বিশ্বাস করতেন রামচন্দ্র। দিনের পর দিন তাঁর নেতৃত্বে যে বিকল্প শাসনব্যবস্থা চলছিল, তার টাকাপয়সাও তিনি জোগাড় করেছিলেন এক দুঃসাহসী অভিযানের মধ্যে দিয়ে। দিনটা ছিল ১৯৪৩ সালের ৭ জুন। রামচন্দ্র খবর পেলেন একদল ইংরেজ কর্মচারীর মাইনের টাকাপয়সা বোঝাই একটা ট্রেন যাবে শেনোলি গ্রামের উপর দিয়ে। রামচন্দ্র ভাবলেন, 'ভারতবাসীদের থেকে লুঠ হওয়া এতগুলো টাকা ইংরেজদের পকেট অবধি পৌঁছতে দেওয়া যাবে না। ট্রেন থামিয়ে টাকাগুলো ছিনিয়ে নিতে হবে।' দুটো দলে সকলকে ভাগ করে দিলেন তিনি। প্রথম দলের দায়িত্বে তাঁর ভাই, দ্বিতীয় দলের মাথার উপর তিনি নিজে। অস্ত্র বলতে রয়েছে কিছু কাস্তে, লাঠি আর হাত বোমা। কেবল বুদ্ধির জোরেই সেদিন কার্যসিদ্ধি করেছিলেন তাঁরা। প্রথমেই লাইনের উপর বিছিয়ে দিয়েছিলেন বড় বড় পাথর, যাতে ট্রেনের গতিরোধ হয়। তারপর বন্দুকধারী গার্ডকে চমকে দিয়ে ট্রেনের উপর চড়াও হয়েছিলেন। গার্ডসাহেব এমন ভয় পেয়ে গেলেন যে বন্দুক চালানোর কথা তাঁর মাথাতেও এলো না। লুঠের টাকা খরচ হয়েছিল 'প্রতি সরকারে'র কাজে। 

প্রায় বছর তিনেক রামচন্দ্রর বিচক্ষণতায় 'প্রতি সরকার' চলেছিল সগৌরবে। তারপর এল '৪৬ সাল। মানুষ অনুমান করলেন স্বাধীনতা  প্রায় দোরগোড়ায়। রামচন্দ্ররা বুঝলেন বিকল্প সরকারের প্রয়োজন এবার ফুরিয়েছে। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে দাঁড়াননি তিনি। বামপন্থী মতাদর্শে দীক্ষিত রামচন্দ্র এবং তাঁর ভাই দুজনেই যোগ দিয়েছিলেন 'পিজেন্টস এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টি'তে।  গত ৬ ফেব্রুয়ারি একশো বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে রামচন্দ্র লাডের। ভাই গণপতি গত হয়েছিলেন আগেই। যে বিল্পবীর অগ্নিগর্ভ দৃষ্টিতে কেঁপে উঠত ইংরেজ সাম্রাজ্য, তাঁর শেষ যাত্রা ছিল অনাড়ম্বর। অবশ্য আড়ম্বর হবেই বা কী করে, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে তো তিনি বরাবর উপেক্ষিতই থেকে এসেছেন। ২০১৬ তে সাংবাদিক পি. সাইনাথ কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকরে তিনি জানিয়েছিলেন, 'মানুষের স্বার্থে তুফান সেনা আজও জীবিত। প্রয়োজন পড়লে আমরা আবার জেগে উঠব।' 

তথ্যঋণ: 'Captain Elder Brother' And The Whirlwind Army: P. Sainath 

Prati Sarkar Against British In Maharashtra : Dr. Hari Desai 

চিত্র ঋণ: facebook

More Articles