কলকাতার দুই চিনেপাড়া, আজও যে স্বাদের জুড়ি নেই...

খাবার কী ভাবে দুটো অন্য মেরুকে মিলিয়ে দিল, ভেবেছেন কখনও!

কলকাতার মতো শহর হয়তো আর দু-টি নেই ভূ-ভারতে, অন্তত পকেটের সাপেক্ষে ভাবলে, খিদের সাপেক্ষে ভাবলে। এখনও দশটাকায় পেট ভরানো যায় এই শহরে।  কত ভিন্ন পেশা, ভিন্ন ইচ্ছে, রুচি, খাদ্যাভ্যাস এই শহরের জলহাওয়ায় একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে।  এই ফিরিস্তিটা স্রেফ দেশের গণ্ডীতে আটকে রাখলে চলবে না।  খাদ্যের প্রশ্নে কলকাতা সত্যিই আন্তর্জাতিক।
পারস্য, পর্তুগিজ, বিলিতি, চিনা, দিশি কত ঘাটের রান্নার স্রোত এসে মিলেছে বাঙালির পাতে। সকাল বা দুপুরে বাড়ির খাবার খেলেও বিকেল হলেই বাঙালির মন হুহু করবেই বাইরের খাবার খাওয়ার জন্য। তাই সন্ধেতে বেরিয়ে একটু অন্যরকম খাওয়া দাওয়া বলতে বাঙালি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘চাইনিজ’  বোঝে। চাইনিজ খাবারের সাথে বাঙালির সম্পর্ক আজকের নয় অনেক যুগ আগের। তাকে সে নিজের মতো গড়েপিটেও নিয়েছে।

আমরা অনেকেই বাড়িতে চাইনিজ বানিয়ে খাই। নুডলস, ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিলেন, ডিমসাম ইত্যাদি এখন বাঙালি বাড়িতে 'ইন'। কিন্তু কলকাতার মধ্যে যে এক টুকরো চিন কোথা থেকে এল তা সমন্ধে অনেকেই জানি না বলতে গেলে। চিনে খাবার কী ভাবে কলকাতায় এল তা নিয়ে বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে প্রথম চিনারা বাংলার মাটিতে পা রাখে। শোনা যায়, ভারতে ‘চিনি’ প্রথম চিন দেশ থেকে চিনাদের হাত ধরেই আসে। এরপর পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতের বিভিন্ন বন্দরে শ্রমিক হিসেবে আসেন চিনের নাগরিকরা। ছড়িয়ে পরেন আসাম, পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। এই ভাবেই ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে যায় চিনা সংস্কৃতি থেকে শুরু করে রান্না।

চিনের চেয়ারম্যান আমার চেয়ারম্যান বলা বাঙালিমাত্রেই জানে কলকাতার বুকে দু-দুটো চায়না টাউন রয়েছে। একটা টেরিটি বাজারে, আরেকটা ট্যাংরায়।খাস কলকাতার বুকে ছোট্ট বেজিং আর পিকিং। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ,১৯২৫ নাগাদ কলকাতার বুকে ভারতের প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠে নাম ‘নানকিং রেস্টুরেন্ট’ কিন্তু ১৯৭০ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯০ আর ২০০০ এর দশক জুড়ে বাঙালির চাইনিজ খাওয়ার ঠিকানা হয়ে উঠল এই চিনেপাড়া। একটা সময় এসেছিল, তৎকালীন সরকার ঠিক করেছিল এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হবে ‘চাইনিজ হেরিটেজ কলোনি’।

তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুরও প্রিয় খাবার ছিল এই চাইনিজ। জনৈক এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের কাছ থেকে জানা যায়, চায়না টাউন গড়ে ওঠার পিছনে নাকি জ্যোতি বাবুর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তবে কি চায়না টাউন মানেই অথেনটিক খাবার, সেই ম্যানেজারের উত্তর ছিল ‘না’। তিনি বললেন, চিনা অথেনটিক খাবার একমাত্র তাদের নিজেদের বাড়িতেই হয়, রেস্টুরেন্টে যা সার্ভ করা হয় তা হল ‘ইন্ডিয়ান চাইনিজ’ অর্থাৎ কলকাতার খাবারের সাথে চাইনিজ খাবার মিলিয়ে তৈরি হয়। আর সেখানে চাইনিজ ফুডে মশলার পরিমাণ বেশি, কারণ বাঙালি ঝাল খেতে ভালোবাসে।

কলকাতা ছেয়ে আছে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে, কোনটা ছেড়ে কোনটায় যাবেন? বেজিং, গোল্ডন জয়, মিং গার্ডেন, ইউ চিউ, আই লেউং, চাং ওয়া, ফুং ফা আরও অনেক। তবে এর মধ্যে থেকে ইউ চিউকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ (ইনট্যাক) এর তরফ থেকে ‘হেরিটেজ’ তকমা দেওয়া হয়েছে। গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউর উপরে কঅবস্থিত সবচেয়ে পুরোনো এই রেস্টুরেন্ট আপনি দেখতে পাননি। কারণ এর বাইরেটা তেমন সুন্দর নয় কিন্তু ভেতরে ৫৫ জনের বসার জন্য টেবিল, রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুন্দর পরিবেশ। এই রেস্টুরেন্ট স্যুপের জন্য বিখ্যাত - সব্জি, মাংস এবং ডিম সহ ধোঁয়া ওঠা স্যুপ, যা আমাদের মন ভুলিয়ে দেবেই।

বেন্টিক স্ট্রিটে রয়েছে তাই সেন, নানা মাংসের পদ, নুডলস খেতে তাই সেন যেতে পারেন। নিরাশ করবে না খাবারের অথেন্টিক স্বাদ। যেতে পারেন নয়া চিনেপাড়ার ফু-ফাতেও। মধু-মরিচ মাখানো চিকেন কিস্তিমাত করবে। গত কয়েক বছরে প্রবল জনপ্রিয় হয়েছে বিগবস, গোল্ডেন জয়ের মতো রেস্তরাঁগুলি। এজেসি বোস রোডের ধারের জিমিস কিচেনের কথাও বলতে হয়। শম্ভু মিত্র, অন্নদাশংকর রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা নাকি এই দোকানের চাইনিজ ভালোবাসতেন। যেতে পারেন প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট লাগোয়া চাংওয়াতেও। ভোজনের সঙ্গে পানের ব্যবস্থাও আছে সেখানে।

কলকাতায় যে শুধু বাঙালিরা চাইনিজ খাচ্ছে তেমন নয়। কোনও দেব দেবীকে চাইনিজ খেতে দেখেছেন? কলকাতার বুকে ‘চাইনিজ কালি টেম্পল’ আছে যেখানে মা কালিকে ভোগ হিসেবে প্রত্যেক দিন চাইনিজ খাবার পরিবেশন করা হয়। মনে হচ্ছে না, এ কী করে সম্ভব? কিন্তু এটাই সত্যি। ভোগ হিসেবে মাকে অর্পণ করা হয় স্টিকি রাইস, সব্জি, চাউমিন। শেষে বলা যায়, আজকের ইন্টারনেটের যুগে সব খাবারই প্রায় বলতে গেলে আমাদের হাতের মুঠোয়। তাই এখন বাইরে না গিয়েও নিজের হেঁশেলেই বাঙালি বানিয়ে নেয় চাইনিজ খাবার। কেউ কেউ দু পা এগিয়ে বলে, চিনের কোনো শহরের পরে কলকাতাই এমন শহর যেখানে চিনে খাবারের জনপ্রিয়তা এত বেশি।

এমনকী বাড়িতেও চিনে খাবার বানানোর ঝোঁক বেড়েছে গত কয়েক দশকে। তেমনই একটি চিনে খাবারের সন্ধান থাক শেষপাতে। 

সেজওয়ান শ্রিম্প

উপকরণ : চিংড়ি আধা কেজি। শুকনো লঙ্কা ৪টি। কাচা পেঁয়াজ ১০টি। তেল ৪ ভাগের ১ কাপ। টমেটো সস ২ টেবিল-চামচ। অর্ধেক ক্যাপসিকাম টুকরা। সয়াসস দেড় টেবিল-চামচ। আদা মিহিকুচি ১ চেবিল-চামচ। রসুন কুচি ২ টেবিল-চামচ। চিনি ২ টেবিল-চামচ। লবণ স্বাদমতো।

পদ্ধতি: চিংড়ির মাথা বাদ দিয়ে খোসা ছাড়ান তারপর ধুয়ে রাখুন। শুকনো লঙ্কা লম্বায় ৪ ফালি করুন। পেঁয়াজপাতাসহ পেঁয়াজ নিন। পাতা অল্প লম্বা করে টুকরো করুন। পেঁয়াজ লম্বায় ২ টুকরা করুন। কড়াইয়ে তেল গরম করে চিংড়ি দিয়ে নাড়ুন। চিংড়ি কুঁকড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকনো লঙ্কা, টমেটো সস, আদা কুচি, রসুন, চিনি ও লবণ দিয়ে নেড়ে এমন আন্দাজে জল দিন যেন জল ২ মিনিট পরে টেনে যায় আর চিংড়ি মাখা মাখা হয়। সয়াসস, ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজপাতা দিয়ে নেড়ে ৩ থেকে ৪ মিনিট রান্না করুন। তারপর নামিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।

কলকাতার চিনাপাড়ার দৌলতেই বাঙালি খাচ্ছে চাউমিন, মাঞ্চুরিয়ান থেকে শুরু করে সেজোয়ান চিকেন আর অন্যদিকে চিনে পরিবারে রান্না হচ্ছে কোপ্তা থেকে শুরু করে বাঙালি মাছের ঝোল। খাবার কী ভাবে দুটো অন্য মেরুকে মিলিয়ে দিল, ভেবেছেন কখনও!

More Articles