একুশে বইমেলার কান্ডারী চিত্তরঞ্জন, ফিরে দেখা এক বিস্মৃত অধ্যায়

বারো মাসে তেরো পার্বণ বাঙালির। একটু ভুল বলা হলো, বারো মাসে তেরো নয় আরো একটা বেশি পার্বণ বাঙালির। বৈশাখের শুরুর দিনে সোদা মাটির গন্ধের সঙ্গে যে পার্বণের শুরু তার শেষ এই বইমেলার মধ্য দিয়ে। শীতের মিঠে কড়া রোদ্দুর অথবা শেষ বিকেলের হিমেল হাওয়াকে সঙ্গে নিয়ে বইমেলা যেন বাংলা ও বাঙালিকে দিয়ে যায় একঝলক মুক্তির বিশ্বাস। বইমেলার হাত ধরে যুক্তিবাদী মন হয়ে ওঠে আরো চিন্তাশীল। নতুন বা পুরাতন বইয়ের তত্ত্বতালাশ নিয়ে নতুন আঙ্গিকে হাজির হয়  পুস্তকমেলা। অবশ্য শুধুমাত্র বাঙালি বললে ভুল বলা হবে- বইমেলার গল্প তো এখন ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। কলকাতার পুস্তকমেলা এখন আন্তর্জাতিক। ফলে বইমেলার কয়েকটা দিন মেলা চত্বর যেন হয়ে ওঠে সব দেশের সব ধর্মের মিলনক্ষেত্র, ভিড় জমে আট থেকে আশি সমস্ত বইপ্রেমী মানুষদের।

ফ্রাঙ্কফুর্ট । আলফা ওয়ার্ল্ড সিটির অন্যতম একটি শহর। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিখ্যাত মূলত তিনটি কারণে। কি সেই কারণ?-বানিজ্য,বারবনিতা এবং বইমেলা। হ্যাঁ, বিশ্ব বইমেলা অনু্ঠিত হয় এই ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরেই। ছবির মত সুন্দর এই ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর। মাইন নদী যেন সর্বক্ষণ আলতো চুম্বন করে চলেছে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের তটে। না শুধু সুন্দরী নয়, ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের মুকুটে যোগ হয়েছে আরো এক নতুন পালক। কি সেই নতুন গৌরব? হ্যাঁ ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরকে বলা হয় মেলার শহর। ইন্টারন্যাশনাল মোটর শো থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট ট্রেড ফেয়ার সমস্ত কিছুর মূল কর্ণধার এই ফ্রাঙ্কফুর্ট। 

সালটা ১৯৪৭। ব্রিটিশ শাসকের দর্পচূর্ণ  করলো ভারত, বহুকাঙ্খিত স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করলো আপামর ভারতবাসী। তবে এই স্বাধীনতা লাভের মধ্যে দিয়েই ভাগ হয়ে গেল একটি দেশ। কাঁটাতারের বেড়া দূরে ঠেলে ছিল একসময়ের প্রিয়জনকে। তৈরী হলো ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি আলাদা রাষ্ট্র। একসময়ের হরিহর আত্মা হয়ে উঠল পরস্পরের শত্রু। এরপর থেকেই কাঁটাতারের দোরগোড়ায় শোনা যেতে লাগল যুদ্ধের ঢক্কানিনাদ,অস্ত্রের ঝনঝনানিতে কেঁপে উঠল সীমান্তের মানুষগুলো। গুলি - বোমা - মৃত্যু দেখতে দেখতে বেড়ে উঠতে লাগল শৈশব।

দেশভাগের সময় বাংলার পূর্ব অংশ অন্তর্ভুক্ত হল পাকিস্তানের সঙ্গে। আর এতেই হল হিতে বিপরীত। জীবনযাত্রা থেকে সংস্কৃতি সবেতেই বাংলার পূর্বাংশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ছিল আকাশ - পাতাল পার্থক্য। এমনকী একসময় এই অঞ্চলের মানুষদের অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত করা শুরু হলো। এরপর ১৯৭০সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামি লীগের জয়লাভ বাংলার পূর্বাংশের মানুষকে খুশি করতে পারেনি। ক্ষোভের আগুন জমা হচ্ছিল। ধীরে ধীরে সেই আগুনেই নতুন ঘৃতাহুতি করল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে মার্চের গণহত্যা 'অপারেশন সার্চলাইট ' বাংলাদেশ গঠনের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ নামে এক চোয়াল চাপা  লড়াই। ২৬শ মার্চ মুজিবর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। অবশেষে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সহায়তায় স্বাধীনতা লাভ করল বাংলাদেশ।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে সোনার বাংলার বুকে শুরু হল একুশের বইমেলা। ভাঙাচোরা বাংলাদেশের বুকে যেন ডাক শোনা গেল নতুনের যার কান্ডারী হল একুশের বইমেলা। উত্তপ্ত যৌবন তখন কিছুটা শান্ত, ফিকে হয়ে এসেছে বাংলাদেশের বুকে বারুদের গন্ধও। তৎকালীন সময়ে একুশের বইমেলার হাত ধরেই যেন শুরু হল স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজ, যার পুরোভাগে ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সাল নাগাদ বর্ধমান হাউসের সামনে ৩২ টি বই নিয়ে বইমেলার সূচনা করেন চিত্তরঞ্জন। এমনকি এই চিত্তরঞ্জন সাহা যোগ দিয়েছেন ফ্রাঙ্কফুর্ট এর বইমেলাতেও। ১৯৭২-৭৬ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন সাহা বইমেলা আয়োজনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সাল থেকে বইমেলা আয়োজনের দায়িত্ব গ্রহণ করল বাংলা। চিত্তরঞ্জন। না, চিত্তরঞ্জনের গল্প এখানেই শেষ নয়। বইমেলার পাশাপাশি ' মুক্তধারা ' নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা তৈরি করেন চিত্তরঞ্জন।

বইমেলাকে কেন্দ্র  করে জানা অজানা গল্প ভিড় জমায় বইমেলার আনাচে-কানাচে। আনকোরা বইয়ের ডালি সাজিয়ে প্রতিবারই যেমন হাজির থাকেন দেশ-বিদেশের প্রকাশক তেমনি নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে দেশের আনাচে-কানাচে থেকে বইমেলায় ছোটেন পাঠকরা, ব্যতিক্রম নন বিদেশের বইপ্রেমীরাও। সোনার বাংলার বুকে অনুষ্ঠিত এই বইমেলার আরেক গর্বের বিষয় বৈকি!

More Articles