মঞ্চ থেকে চলচ্চিত্র, স্মৃতিকথায় বর্ণময় শাঁওলি মিত্র

স্তব্ধ হয়ে  গেলেন 'নাথবতী অনাথবৎ'। ৭৪ বছর বয়সে জীবনাবসান ঘটল প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্রের। বাবা শম্ভু মিত্রের মতোই সকলের অলক্ষে শেষকৃত্য সম্পন্ন হল তাঁর।  মৃত্যুপথ যেন পুষ্পরঞ্জিত না হয়, এমনটাই ছিল তাঁর ইচ্ছে। রীতিমত সরকারী কাগজের সিলমোহরে সেই নির্দেশ দিয়ে গেছিলেন তিনি। তাঁর প্রয়ানের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল হাজার হাজার সুখস্মৃতি। পার্ক সার্কাসের গর্ভে ১১ এ নাসিরুদ্দিন রোড। এখান থেকেই বাবা মায়ের সযত্ন লালন পালনে যাত্রা শুরু। তারপর জীবনের অনাবিল বহতায় গড়ে উঠেছে কত গল্প। নিকটজনদের স্মৃতিচারণে সে সমস্ত গল্প আজও অমলিন। 

'গালিলেওর জীবন' নাটকে ভার্জিনিয়া চরিত্রে শাঁওলি মিত্রের অভিনয় মুগ্ধ করেছিল বিজয়লক্ষ্মী বর্মণকে। ব্রেশটের এই নাটকটি ছাড়াও 'রাজা' নাটকে তাঁর অভিনয় দেখেছিলেন তিনি। সেখানে অবশ্য মা তৃপ্তি মিত্রের পাশে মেয়ে যেন খানিকটা কম উজ্জ্বল। তারপর কেটে গেল কিছুদিন। এমন সময়ে শোনা গেল, 'নাথবতী অনাথবৎ' নামক একটি নাটকে হাত দিয়েছেন তিনি। বিজয়লক্ষীর সঙ্গে শাঁওলির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সে সময়ে ছিল না। সে সুযোগ ঘটল সুব্রত পালের দৌলতে। মুখোমুখি হলেন দু'জন। প্রথম দিন কথা বলেই শাঁওলিকে ভালো লেগে গেল তাঁর। তাঁকে জানালেন, "আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই"। নতুন নাটক নিয়ে তখন জল্পনা তুঙ্গে। প্রয়োজন বেশ কিছু নতুন মুখের। এ অবস্থায় শাঁওলি মনস্থির করলেন বিজয়লক্ষীকে দিয়ে 'নাথবতী'তে অভিনয় করাবেন তিনি। অবশেষে নাটকটি মঞ্চস্থ হল। তখনও অবশ্য 'পঞ্চম বৈদিক' তৈরি হয়নি। 'সারথি' নামক এক আবৃত্তি সংস্থার ব্যানারে অভিনীত হল ঐতিহাসিক সেই নাটক। তবে সকলেই বুঝলেন নিজেদের প্রয়োজন। দল ছাড়া আর কতদিন এভাবে অভিনয় চলবে? স্থাপিত হল 'পঞ্চম বৈদিক' এবং তার প্রায় পরে পরেই 'পঞ্চমবেদ চর্যা'। অভিনয় বা আবৃত্তির প্রথাগত কোনও তালিম এর আগে বিজয়লক্ষী পাননি। তাঁর কথায়, "সেখান থেকে যে শিক্ষা আমি পেয়েছি, তা কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছি জানি না, কিন্তু ওখান থেকেই শিখেছি।"

সে সব ছিল যৌথ জীবনের, সমবেত হাসিকান্নার দিনকাল। ঘনিষ্ঠতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে শাঁওলির সঙ্গে একদিনও দেখা না হলে দিন কাটে না। 'কথা অমৃত সমান' নাটকের মহলা তখন হয় বিজয়লক্ষী বর্মণের বকুলবাগান রোডের ফ্ল্যাটে। ঠিক রাত ৯ টা পর্যন্ত চলে রিহার্সাল, তারপর তাঁর আড্ডার ঠিকানা শাঁওলি মিত্রের ফ্ল্যাট। শীতের দিনেও রাত দশটা অবধি  দু'জনের গল্প হতো সেখানে। তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ি ফেরার পালা। এমনই এক দিনের গল্প। এলুমিনিয়ামের মই বেয়ে লফটে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন শাঁওলি, শরীরে বেশ ভালোরকম চোট পেলেন। অথচ পরের দিন 'নাথবতী'র শো। কী করা যায়? একরাতের মধ্যেই সকলকে বেশ অবাক করে দিয়ে ব্যথার জায়গাগুলো কিছুটা সামাল দিয়ে অভিনয়টা কী ভাবে করা যায় সেটা তৎক্ষণাত রপ্ত করে নিলেন তিনি।

পরদিন শো হল নির্ধারিত সময়। আগেরদিন যে মানুষটি নাকি পড়ে গিয়ে বেজায় চোট পেয়েছেন, তিনিই পরের দিন শত শত দর্শকের সামনে মঞ্চে তুলে ধরলেন এক পূর্ণাঙ্গ একক অভিনয়। চোখে মুখে যন্ত্রণার লেশমাত্রও নেই। বিজয়লক্ষীর স্মৃতিতে এমনটাই ছিলেন তিনি। কোনও কারণে গলা ধরা থাকলেও রিহার্সাল স্তব্ধ হতো না। গলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ভিন্ন পথে রেওয়াজ চালিয়ে যেতেন তিনি। অভিনয় ছাড়াও তালিম নিয়েছিলেন নাচ এবং গানের, এবং তার সফল প্রয়োগ করেছিলেন 'নাথবতী অনাথবৎ'-এ। বিজয়লক্ষীর মতে, "কথা অমৃত সমান-এ এক জায়গায় খঞ্জনি বাজাতেন 
শাঁওলি। নিজে নিজেই বাজনাটা বেশ রপ্ত করেছিলেন। সময়ানুবর্তিতা, সেটা ওনার থেকে শেখা। শাঁওলির কাছে বারোটা মানে ছিল বারোটাই, সেটা বারোটা পাঁচ হবে না। এমন একজন শিল্পীর চলে যাওয়া আসলে থিয়েটার জগতের খুব বড় ক্ষতি।" 

মঞ্চ থেকে চলচ্চিত্র, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, দুটি মাধ্যমেই ছিল শাঁওলীর স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। তাঁর চোখে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত "এফর্টলেস" অভিনেত্রী। বাবার মতোই তাঁর শিরদাঁড়া সোজা ছিল। স্পষ্ট কথা স্পষ্টভাবে বলতেন। এবং ছিল প্রচন্ড জেদ। ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে দিয়ে কেউ কোনও কাজ করাতে পারতেন না। দেবেশবাবুর কাছে  শাঁওলী ছিলেন "একেবারে অন্যরকম"। অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি গবেষণা চালিয়ে গেছেন নিরন্তর। অন্য ভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন গণনাট্য, নবনাট্য, এই ধারাগুলিকে।  দেবেশ মনে করেন, "তাঁর যে বাচিক, মানে যেটাকে আমরা শম্ভু মিত্রের ঘরানা বলি আর কী, এ ছাড়াও তাঁর অনুশীলন আর শেখানোর পদ্ধতি, আমাদের এই প্রজন্মের কাছে অনেক বড় পাওয়া ছিল।" 

ঋত্বিক ঘটকের 'যুক্তি তক্কো গপ্পো' ছবিতে দর্শকেরা  দেখছিলেন নীলকন্ঠ বাগচীর মুখোমুখি এক মেয়েকে। বহুদূর দেশ থেকে কাঁটাতার পেরিয়ে এপারে এসেছিলেন তিনি।  আর আজ, দুই বাংলার মানচিত্র কে সঙ্গে নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন সেই বঙ্গবালা। মৃত্যুই তো ধ্রুবসত্য, তার সামনে এসে অমরত্বও দু'দণ্ড থমকে দাঁড়ায়। তবু, জীবনানন্দের মতো শঙ্খচিল বা শালিকের বেশে ধানসিড়িটির তীরে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি নিয়েই পথিক পথ মেপে নেয় অনন্তযাত্রার। বাংলাই বোধহয় একমাত্র দেশ, যেখানে "আসি" বলে অবলীলায় চলে যাওয়া যায়। 

More Articles