গরিবি বা জাতপাত, উপশম কি 'বিয়ে'? প্রশ্ন তুলছে ‘দহাড়’

Dahaad: উচ্চকণ্ঠ চিৎকার হয়তো এবার সর্বভারতীয় দর্শকদের ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে।

মাঝে মাঝে জরুরি প্রশ্নগুলিকে থ্রিলারের মতো জনপ্রিয় টানটান শিল্পরূপের সঙ্গে গেঁথে দেওয়া ভালো। ‘দহাড়’ ওয়েব-সিরিজটি সেই কাজটাই করেছে। দহাড় মানে গর্জন, পুকার। উচ্চকণ্ঠ চিৎকার হয়তো এবার সর্বভারতীয় দর্শকদের ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে। বিবাহ নামক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাটি প্রয়োজনীয় না প্রয়োজনীয় নয় – তার কোনও একমাত্রিক উত্তর হয় না। অথচ বয়সের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করেছে বলেই সেই প্রতিষ্ঠানে বিবাহযোগ্যা মেয়েদের ঢুকিয়ে দিতে হবে। আর তাতেই যেন নিরুপায়, দরিদ্র, জাত-পাতের বিচার নিয়ে ব্যস্ত থাকা ভারতীয় পরিবারগুলির নিশ্চিত মোক্ষ লাভ। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই বা কেন, ছেলেদের ক্ষেত্রেও বিবাহের অনিবার্য শর্তপালনের কথা ঘুরে-ফিরে ওঠে। পারিবারিক অর্থনীতির রকমফের থাকলেও বিবাহের প্রয়োজনীয়তাকে সবাই যেন স্বীকার করে নিচ্ছেন।

‘দহাড়’ চিৎকার করে এ-কথাই জিজ্ঞাসা করছে, বিবাহই কি একমাত্র উপায়? পাশাপাশি স্বেচ্ছা নির্বাচিত বিবাহবন্ধনকেও এই ওয়েব-সিরিজটি উপেক্ষা করছে না। এ-ভাবেই নর-নারীর যৌন ইচ্ছা ও অধিকারকে নানা দিক দিয়ে বুঝতে চাইছে এই চমৎকার নির্মাণ। বিবাহ-প্রসঙ্গে কতগুলি সমান্তরাল কাহিনি বোনা হয়েছে এখানে। উচ্চবংশীয় ঠাকুর পরিবারের মেয়েটি যখন মুসলমান ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়, তখন রাজনৈতিক প্রতাপ-পরায়ণ পরিবারটি এই লাভ-জেহাদের বিপক্ষে থানা ঘেরাও করে। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের একসঙ্গে স্বেচ্ছায় থাকার মৌলিক অধিকারকে খারিজ করে দিতে চায়। যেহেতু উচ্চবর্ণীয় হিন্দু পরিবারটি রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী, তাই পুলিশ মহলে প্রভাব খাটিয়ে মুসলমান ছেলেটির মুখে চুনকালি মাখাতে সময় লাগে না। তাঁকে দোষী বলে হাজতে ঢোকাতে পারে। এই ক্ষমতাতন্ত্রের মধ্যে থাকা ভালো-পুলিশেরা অবশ্য মুসলমান ছেলেটিকে জেল ভেঙে বাইরে এনে পালিয়ে যেতে উৎসাহিত করে। শেষ অবধি এই মুসলমান ছেলেটিকে ঠাকুর পরিবারের মেয়েটি পুনরায় বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের এই বিদ্রোহী সাফল্য ধর্ম ও জাতপাতের বিরোধিতা করছে। আবার যে পুলিশ কর্মচারী সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর সঙ্গে অ-সহজ ব্যবহার করেন, তিনি নিজেকে ক্রমে বদলে ফেলেন। অ-সহজ ব্যবহার করার কারণ তিনি ভাবছিলেন পাপে-ভরা দুর্বিনীত এই পৃথিবীতে সন্তানের জন্ম দেওয়া ঠিক নয়, তার থেকে ঢের ভালো গর্ভপাত। শেষ অবধি তাঁর মত বদল হয়। এই পুলিশকর্মীর ঊর্ধ্বতন কর্তা যিনি, তিনি ঠাণ্ডা-মাথার যুক্তিবাদী মানুষ। তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। কিছুতেই মেয়েকে একা দিল্লি যেতে দিতে চান না মা, বক্তৃতা-প্রতিযোগিতায় দিল্লি গিয়ে কী হবে! বলিয়ে-কইয়ে, চাকরি করা মেয়ের বিয়ে হয় না। স্ত্রীর সঙ্গে লড়াই করে মেয়েকে শেষ অবধি দিল্লি পাঠালেন বাবা। পুলিশে চাকরি পাওয়ার পর মায়ের চাপে সম্বন্ধ করে বিয়ে, মানিয়ে নিয়ে আছেন। স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, যৌনজীবন শরীরের ধর্ম মেনে বহাল – তবু ফাঁক থেকে যায়। বাবার লক্ষ একটাই, সন্তানদের ঠিক মতো গড়ে তোলা।

আরও শুনুন: সব নিয়ম মেনে নিজেকেই বিয়ে, গুজরাতের এই মেয়ে যে পথ দেখাচ্ছেন

বিবাহের চারপাশে এই সব কাহিনির ঘুরপাক, মূল কাহিনি বিয়েকে ঘিরেই আবর্তিত। বিবাহযোগ্যা নিম্নবর্ণের মেয়েদের কীভাবে প্রেমের নাটক করে বাড়ির বাইরে এনে সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলার খুন করে তাই নিয়ে ক্রাইম-সিরিজ, টানটান সুঅভিনীত। তার গল্প বলে দেওয়ার মানে হয় না। শুধু কথা একটাই। এই সিরিজের নায়ক এক অবিবাহিত মহিলা পুলিশ। স্বাধীনচেতা রমণীয় মোটরবাইকবাহনা এই মেয়েটিকে তাঁর বাবা মাথা নত করতে নিষেধ করেছিলেন। তাই পা ছুঁয়ে প্রণাম তিনি করেন না – দেবতায় মতি নেই। মেয়েটির মা এই দুর্বিনীত মেয়ের বেহায়া আচরণে নাজেহাল। যা-ও বা এক পাত্রকে দেখতে আসতে বললেন, মেয়েটি উলটে সেই পাত্রকে প্রশ্ন করে নাকাল করে দিল। মেয়েটির একজন বয়ফ্রেন্ড আছে। তাঁর সঙ্গে নিভৃত ছাদে তাঁর ব্যক্তিগত-যাপন, অনুতাপহীন ইচ্ছে মতো আচরণ। বয়ফ্রেন্ড কেরিয়ারের টানে অন্য-শহরে যাবেন। যাওয়ার আগে তাঁদের যৌনক্রিয়া। সেই পরিকল্পনাহীন যৌনক্রিয়ার সময় যেহেতু ছেলেটি নিরোধ ব্যবহার করেননি, তাই ভালোবাসার যৌনসঙ্গীকে গর্ভনিরোধক পিল কিনে দেন তিনি। আর সেই ক্রিয়া থেকেই খুলে যায় খুনের জট।

সেই জটের গল্প থাক। এই যে আবেগের হাবুডুবু স্রোতহীন বিবাহ নামক প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্যে না-গিয়ে সম্মত স্বাধীন যাপনের ছবি, দুই প্রাপ্তবয়স্ক স্বনির্ভর নর-নারীর এই স্বাধীনতার ছবি অনেক কিছু না-বলেও বলে। তারা একবারও বলে না এ-সম্পর্ক চিরন্তন, প্রেম অমর ইত্যাদি। এসব নয় ভেবেও তো যতক্ষণ সম্পর্ক জীবিত ততক্ষণ উপভোগ্য দ্বিরালাপ, সর্বার্থেই। রাজস্থানের ভৌগোলিক পটভূমিতে গড়ে তোলা এই গল্প আদতে থ্রিলারের জামা পরে একটা কথাই বলতে চায়। ভাবতে হবে, বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে খোলা মনে ভাবতে হবে। মেয়েদের, ছেলেদের। কোনও একরকম সিদ্ধান্তে যাওয়ার উপায় নেই।

আরও শুনুন: পুরনো মদ নতুন বোতলে: যে কারণে এত আগ্রহ এই ওয়েব সিরিজগুলি নিয়ে

কথাগুলো যে খুব নতুন তা নয়। তবু কেন পুরনো কথাগুলো চিৎকার করে বলতে হল! কারণ একটাই। যে কোনও দেশে ধর্মধ্বজী রাজনীতি যখন ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চায়, তা কিন্তু বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে তার যুক্তি সাজায়। বিবাহের বিশেষ রূপকে একমাত্রিক করে তোলে। ভারতবর্ষের মতো জাত-পাত ধর্মের দেশে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের সঙ্গে রাজযোটক – আর এই যুগলবন্দী বলে বিয়ে ধর্ম, বিয়ে কর্ম। বিয়ে ছাড়া কিছু নেই। বিয়ে যৌনতার পারিবারিকতার মধ্য দিয়ে নর-নারীর মনে পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষবৃক্ষের গোড়ায় জল দেয়। বিয়ের একটাই রূপ – ছেলে উপরে, মেয়ে নীচে। বিয়ের একটাই রূপ – চুপ করে স্থিতাবস্থা মেনে নেওয়া।

চিৎকার করে নিচুজাতের সফল মেয়েটি পুলিশ অফিসার হিসেবে একথাই শুধু বলছে এসব চলবে না, ভাবতে হবে। আসুন তাঁর সঙ্গে চিৎকার করি – আমরা সবাই।

More Articles