সিঙ্গুরের ডাকাত কালী, ৫৫০ বছর পেরিয়ে আজও জেগে আছে ভয়াল এক ইতিহাস

Singur Dakat kali: পরদিন সকালে এলাকার মানুষজন মন্দিরের সামনে এসে  দেখলেন রক্তারক্তি কাণ্ড। সারি সারি ডাকাতের মৃতদেহ পড়ে মন্দিরের চাতালে।

 হুগলি জেলার সিঙ্গুর অঞ্চল তখন গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ। আশেপাশে গ্রাম কিছু আছে বটে, তবে তার বাসিন্দাদের অবস্থা বড়ই সঙ্গীন। একদিকে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, আরেক দিকে অন্নাভাব। এর মধ্যে একরকম ভূতের মতোই বেঁচেবর্তে ছিলেন তাঁরা। সে গ্রামের এক ধার দিয়ে সোজা চলে গেছে তারকেশ্বরের রাস্তা, তারই পাশে একটা ছোট্ট কালীমন্দির। স্থানীয়রা বলেন, 'ডাকাত কালীর মন্দির'। দিনের বেলায় মন্দির প্রাঙ্গণে কিছু ভক্ত সমাগম ঘটে ঠিকই, কিন্তু বিকেল গড়াতেই এলাকায় শ্মশানের নিস্তব্ধতা নামে। তখন জেগে থাকে কেবলই ভীষণদর্শন কালীমূর্তি, আর মন্দিরের পশ্চিমদিকে সনাতন বাগদীর বসত বাড়ি। ডাকাত সর্দার সনাতন বাগদী, সিঙ্গুরের ত্রাস। অবশ্য, যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন সে আর বেঁচে নেই, কালীমন্দিরও পরিত্যক্ত। তবু, তাকে কেন্দ্র করে লোকের মুখে মুখে প্রায় রূপকথার মতোই গড়ে উঠেছিল গল্প। সে গল্প যেমন ভয়ের, তেমনই বিস্ময়ের। 

দিনটা ছিল চৈত্র মাসের, ঘোর অমাবস্যা।  জংলা রাস্তাঘাটে কোথাও কোনও মানুষজনের দেখা নেই। অন্ধকার হলে তখন এমনিতেই পথঘাট ফাঁকা হয়ে আসত, তার উপর সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল ঝমঝমিয়ে। দূর থেকে ভেসে আসছিল কেবল একটা ঘণ্টার শব্দ, আর চাপা হৈ হট্টগোল। রাত্রির গাঢ় অন্ধকারে তখন উৎসবের রঙ লেগেছে কালী মন্দিরে। চারিদিক প্রদীপের আলোয় সুসজ্জিত। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে আছে পুজোর সরঞ্জাম। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদেহী সনাতন বাগদী। মায়ের ভোগের সময় হয়ে এল। হাঁড়িকাঠে তাজা প্রাণ চড়িয়ে, কপালে তার রক্তের জয়তিলক কেটে সনাতন দলবল নিয়ে বেরোবে ডাকাতি করতে। সময় আগত প্রায়। কিন্তু বলি দেবে কাকে? শিকার কোথায়? সনাতন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো এদিক ওদিক। মা নররক্ত চায়, অথচ তার কোনও ব্যবস্থাই করেনি দলের ফাজিল ছোঁড়ারা। হুঙ্কার দিয়ে উঠল সে। যেমন করে পারো শিকার ধরে নিয়ে এসো, মা কি অভুক্ত থাকবে নাকি? দলের লোকেরা অবশ্য নির্লিপ্ত। সর্দারের অমন নরম গরম প্রচুর দেখেছে তারা। সোজা হিসেব, বৃষ্টি বাদলার দিন কেউই ঘর থেকে বের হয়নি, কাজেই বলির শিকার যদি চাও, নিজে ধরে নিয়ে এসো গে। একে ভাগের টাকা দেবে না সময় মতো, তার উপর হুজ্জুতি? সনাতনও দমবার পাত্র নয়। বলির শিকার আজ না পেলে স্যাঙাতদের মাথাগুলোই নামিয়ে ফেলবে সে। 

আরও পড়ুন-কেউ বলে দেবতা, কেউ বলে শয়তান, কেন বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত মানুষ এলন মাস্ক

এরই মধ্যে কয়েকজন জুনিয়র ডাকাত প্রতিবাদ জানাল। খেলা তো মন্দ নয়। হকের টাকা চাইতে গেলে সে বেলায় অষ্টরম্ভা, এদিকে আবার চোখ রাঙানো? আগে পয়সা ছাড়ো, তারপর অন্য কথা। নইলে আজ সবাই মিলে এখানেই কেটে পুঁতে দেব তোমায়। জোর দাঙ্গা লাগল সনাতন আর তার দলবলের মধ্যে। এমন সময় কিছু দূরে শোনা গেল শব্দ। একদল মানুষ শিবের দর্শনে চলেছেন তারকেশ্বর। তাঁরাই সমবেত কণ্ঠে বলে উঠছেন, 'বম বম তারক বম, শিব শঙ্কর ভোলা বম'। সনাতনের মুখে হাসির ঝিলিক খেলে গেল। ভোগের ব্যবস্থা মা নিজেই করে নিয়েছেন। দলের লোকদের সে নির্দেশ দিল তরোয়াল হাতে তীর্থযাত্রীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে, কিন্তু, তারা নাছোড়বান্দা। আগে টাকা, পরে কাজ। কী আর করার, অস্ত্র হাতে সনাতন নিজেই এগিয়ে গেল। কিন্তু সে জানত না, তীর্থযাত্রীরা নেহাত নিরীহ ছিলেন না। তাঁদের সঙ্গে ছিল জমিদার বাড়ির পাইক, বদকন্দাজ, এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র। শুরু হল ভয়াবহ যুদ্ধ। একা মানুষ আর কতজনের সঙ্গেই বা লড়তে পারে? কিছুক্ষণ পর বাঘা বাঘা লাঠিয়ালদের হাতে প্রতাপশালী সনাতন বাগদী ঘায়েল হয়ে মন্দিরের সামনেই পড়ে রইল। মৃত্যু হল তার।এবার দলের অন্যান্যদের পালা। কারো মাথা কাটা গেল, কেউ বা পালিয়ে বাঁচল। রবীন্দ্রনাথ থাকলে হয়তো বলতেন, 'কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে, শুনলে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা'। 

পরদিন সকালে এলাকার মানুষজন মন্দিরের সামনে এসে  দেখলেন রক্তারক্তি কাণ্ড। সারি সারি ডাকাতের মৃতদেহ পড়ে মন্দিরের চাতালে। কারো মাথা টেনে নিয়ে গেছে শেয়ালে, কারো আবার হাত পা নেই। তারপর কালের বিবর্তনে সনাতন বাগদী হয়ে উঠল লোকগাথার খলনায়ক। মন্দিরের আশেপাশে জমতে থাকল লতাপাতার জঙ্গল। যে পাথুরে প্রতিমা একসময় ছিলেন ডাকাতদের জাগ্রত দেবী, তিনি ক্রমে পরিণত হলেন বেওয়ারিশ জংলা মূর্তিতে। তারপর একদিন ঘন গাছপালায় ঢেকে গেল চারপাশ। কমে এল ভক্তের আনাগোনা। শীত যায়, গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষাকাল আসে। রক্তরাঙা জিভ মেলে একা দাঁড়িয়ে থাকেন সিঙ্গুরের ডাকাত কালী।

আজ অবশ্য এসব অতীত। আজকের ঝকঝকে মন্দির দেখে কেউ হয়তো ঠাওরও করতে পারবেন না সেই ভয়াল ইতিহাস। তবে সেই রোহমর্ষক কাহিনি বেঁচে আছে, স্থানীয়দের জীবনের ঘুমপাড়ানি গল্পকথা হয়ে।

More Articles